ঢাকা, শুক্রবার ১৯, এপ্রিল ২০২৪ ১৯:১৬:০৯ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
সবজির বাজার চড়া, কমেনি মুরগির দাম সারা দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি কৃষক লীগ নেতাদের গণভবনের শাক-সবজি উপহার দিলেন প্রধানমন্ত্রী চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি, হিট এলার্ট জারি শিশু হাসপাতালের আগুন সম্পূর্ণ নিভেছে শিব নারায়ণ দাশের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক পরলোকে জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ন

ছোট গল্প : নীল প্রজাপতি

সোমা দেব | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১২:১৭ পিএম, ২ অক্টোবর ২০১৯ বুধবার

ছোট গল্প : নীল প্রজাপতি, লেখক : সোমা দেব

ছোট গল্প : নীল প্রজাপতি, লেখক : সোমা দেব

আজ সকালে একটা অদ্ভূত ঘটনা ঘটেছে। ঘুম ভেঙে বারান্দায় যেতেই মালিহা দেখে গাঁদা ফুলের টবের ফুলটার উপরে একটা নীল প্রজাপতি বসে আছে। প্রজাপতিটা এত নীল! এরকম সুন্দর প্রজাপতি মালিহা আগে কোনো দিনও দেখেনি। এমনকি স্বপ্নেও না। ওদের বাড়িতে এরকম প্রজাপতি আগে কখনো আসেনি। কোত্থেকে এলো এটা ভাবতে ভাবতেই মামণির গলার আওয়াজ শুনে দৌঁড়ে গেল সে। স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে। ঝটপট তৈরি হয়ে নিচে নামার আগে একঝলক প্রজাপতিটা দেখতে গেলো। স্বপ্ন নয়তো এটা। নাহ! সত্যি সত্যিই ওটা ফুলের ওপরই বসে আছে। আবার দৌড়ে চলে গেল মালিহা।

স্কুল বাসে বসে বসে প্রজাপতিটার কথাই ভাবল সে। এত্ত সুন্দর! আর কি সুন্দর লক্ষী হয়ে বসে আছে গাছের পাতায়। ওর ডানা দুটোও বিশাল। গাঢ় নীল, তার ওপর হালকা নীল রঙের ফুটকি। আর ডানা দুটোর ধার দিয়ে হালকা নীল রঙের রেখা টানা। মনে হয় যেন প্রজাপতিটার জামায় লেইস লাগানো। এখনও বন্ধুদের কাউকে বলা হয়নি প্রজাপতিটার কথা। টিফিন পিরিয়ডে টিফিন খেতে বসে নীল প্রজাপতিটার কথাই মনে হচ্ছিল বার বার। মনে মনে প্রজাপতিটার জন্য নামও ঠিক করে ফেলেছে ও। নীলমণি।

হঠাৎ মনে পড়ল মালিহার, বেশ কয়েকদিন আগে ছাদে রাখা গাছের পাতায় একটা শুয়াপোকা দেখে মামণি পাতাটা ছিড়ে ফেলতে বলেছিল। পোকাটা নাকি গাছের ক্ষতি করবে। পাতাটা ছিড়ে ফেলতে গিয়েও হঠাৎ করে পোকাটার জন্য এমন মায়া হলো মালিহার! পাতাটা ছিড়তে পারলো না। সেই পাতাবাহার গাছের টবটা ও নিজের রুমের বারান্দায় এনে রেখেছিলো। মাঝে মাঝে দেখতে যেত পোকাটা আছে কিনা। গত কয়েক দিন পড়ার এত চাপ যে যেতেই পারেনি পোকাটার কাছে।

আজকে কি তাহলে ওই পোকাটাই নীল প্রজাপতি হয়ে উঠলো! স্কুল ছুটির পর বাসায় যেতে যেতে ও সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু সায়ন্তীকে ঘটনাটা বললো। সায়ন্তীতো শুনেই অবাক। বাসায় ফিরে মালিহা খাওয়া দাওয়া শেষ করে বারান্দায় গেলো। প্রজাপতিটা ঠিক আগের জায়গায় নেই। পাশের বারান্দার গ্রীলে বসে আছে। এতো সুন্দর প্রজাপতিটা! মালিহা মনে মনে ভাবলো এই প্রজাপতিটা ওর আরেকটা বন্ধু। ও প্রজাপতিটাকে অনেক যত্ন করবে, খেতে দেবে, আর প্রজাপতিটার সাথে ভাব করবে। রাতে নানুমণির কাছে ঘুমাতে গিয়ে ও নানুমণিকে প্রজাপতিটার কথা জানালো। সব শুনে নানুমণি যা বললেন তাতে হতাশই হলো মালিহা।

নানুমণি বললেন, ‘দূর বোকা, প্রজাপতি কি অন্য প্রাণীর মতো পোষা যায় নাকি! কোথায় উড়ে চলে যাবে!’

নীলমণি কি তাহলে চলে যাবে? কি আর করা! নানুমণির কথা শুনে এক বুক অভিমান নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো মালিহা।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই ও বারান্দায় গেলো। বুকটা ধুুকধুক করছিল ওর। ভাবছিল নীলমণি বুঝি কোন্ ভোরে উড়ে চলে গেছে। কিন্তু কি অবাক কান্ড, সে যায়নি, বারান্দায় রাখা ফুলের গাছগুলোর একটাতে বসে আছে পাখা মেলে। মালিহাকে দেখেই প্রজাপতিটা যেন পাখা নাড়ল। মালিহা আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে নীলমণির কাছে গিয়ে বললো, শুভ সকাল নীলমণি। তুমি চলে যেয়ো না কিন্তু।

প্রজাপতিটা যেন মালিহার কথা বুঝতে পারলো। সে উড়ে এসে মালিহার কাছাকাছি আরেকটি গাছের পাতায় বসলো। মালিহা খুব আলতো করে প্রজাপতিটার পাখার কাছে একটু হাত বুলিয়ে দিলো। তারপর স্কুলের জন্য তৈরি হতে চলে গেলো।

এবার সে অন্য বন্ধুদেরও ঘটনাটা জানালো। সবাইতো খুশিতে আত্মহারা। মালিহার অন্য বন্ধুদের মতো নীলমণিও ওর বন্ধু হয়ে গেছে। স্কুল থেকে বাসায় ফিরে ওর প্রথম কাজই হচ্ছে নীলমণির সাথে দেখা করা। তারপর বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে ওর সাথে অনেকক্ষণ গল্প করা। নীলমণির জন্য আনারস, বেদানা, কমলার রস বানিয়ে ছোট্ট বাটিতে করে বারান্দায় রেখে দেয় ও। ভাইয়া বলেছে প্রজাপতিরা ফলের জুস খায়। তবে সেই ফলে কেমিক্যাল থাকা চলবে না। তাই ও দেশি ফলগুলো রস করে নীলমণিকে খেতে দেয়।

সত্যি সত্যি এই প্রজাপতিটা মালিহার প্রিয় বন্ধু হয়ে গেলো। প্রতিদিন ভোরে বিছানা ছেড়ে উঠে সে বিধাতার কাছে প্রার্থনা করে নীলমণি যেন কখনোই উড়ে চলে না যায়। আর মাঝে মাঝে ভাইয়াকে প্রজাপতি নিয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করে। ভাইয়া জীববিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করছে। অনেক কিছুই জানে ও।

বন্ধুদের কাছে নীলমণির অনেক গল্প করেছে ও। তাই বন্ধুরা এবার মালিহার বাসায় এসে নীলমণিকে দেখতে চায়। একদিন ছুটির দিনে মামণিকে বলে সায়ন্তি, মুক্ত, শান্ত আর শ্রাবণীকে নিয়ে এলো বাসায়। নীলমণিকে দেখে তো ওরা মহাখুশি। এত্ত সুন্দর আর নীল রঙের ডানা মেলা প্রজাপতি দেখে ওরা যে শুধু খুশিই হলো তাই নয়। প্রজাপতিটা যে মালিহাকে ছেড়ে কোথাও যায় না, এক্কেবারে পোষা লক্ষীটি হয়ে থাকে তা শুনে ভীষণ অবাক হয়ে গেলো সবাই। অনেকক্ষণ ধরে ওরা প্রজাপতিটার সাথে খেলা করলো। কিন্তু ওকে একদম বিরক্ত করলো না।
প্রজাপতিটা নিয়ে মহানন্দে দিন কাটতে লাগলো মালিহার। এ কদিনে প্রজাপতিটা আরেকটু বড় হয়েছে। মনে হচ্ছে ওর গায়ের রঙ আরও একটু গাঁঢ় হয়েছে। কিন্তু অদ্ভুত কারণে প্রজাপতিটা কোথাও যায় না। গেলেও ঠিক সময়মত উড়ে চলে আসে। বারান্দার গাছে পাখা মেলে বসে থাকে।

দেখতে দেখতে মালিহার জন্মদিন চলে এলো। মালিহা ভাবলো জন্মদিনে বন্ধুদের সবাইকে বাসায় এনে প্রজাপতিটার সাথে ভাব করিয়ে দেবে। ওদের প্রজাপতিটাকে ছুঁতে দেবে। গায়ের রঙ ছুঁয়ে দেখতে দেবে। জন্মদিনে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়লো মালিহা। সকাল থেকেই সে খুব ব্যস্ত। কারণ, সকাল বেলাতেই মামণি আর বাপী এসে ওর ঘুম ভাঙিয়েছেন। তারপর খুব তাড়াহুড়ো করে মালিহাকে নিয়ে বেরিয়ে গেছেন তারা। মামণি আর বাপী আজকে ওকে সময় দেওয়ার জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়েছেন। সারাদিন ওরা ঘুরে বেড়িয়েছে নানা জায়গায়। আইসক্রিম, চকোলেট আর ফুচকা খেয়েছে। তারপর লাঞ্চের সময় চাইনিজ খেয়ে বাড়ি ফিরেছে বিকেলে।

সন্ধ্যায় বন্ধুরা আসবে বাসায়। মামণি ব্যস্ত হয়ে পরেছেন সব আয়োজনে। এদিকে ভাইয়া বলেছে একটা সারপ্রাইজ দেবে ওকে। এটার জন্য তর সইছেনা মালিহার। সন্ধ্যার আগেই সায়ন্তি আর মুক্ত চলে এলো। এরপর এলো শ্রাবণী। একে একে শান্ত, তূর্য, পুষ্পিতা সবাই এলো। বাসাটা ভরে উঠলো কোলাহলে। কেক, রঙবেরঙের বেলুন আর নানা গিফটে ভরে উঠলো মালিহার ঘরে। হৈচৈ আর আনন্দে আতœহারা সবাই।

এক ফাঁকে বন্ধুদের নিয়ে মালিহা বারান্দায় চলে এলো। প্রজাপতির সাথে বন্ধুদের ভাব করাতে হবে যে। সবাই তো আর নীলমণিকে দেখেনি। কিন্তু অবাক ব্যাপার। আজকে কোনো টবের গাছেই নীলমণি নেই। সারাদিন খোঁজ নেওয়া হয়নি, তাই বুঝি রাগ হয়েছে ওর সাথে! সকালে মামণি আর বাপী এতো তাড়াহুড়ো করলেন যে, এক নজর দেখতেও পারেনি নীলমণিকে। কিন্তু কোথায় গেল ও? অনেক খোঁজাখুজি করেও ওর দেখা মিলছে না। তাহলে নানুমণির কথাই সত্যি? নীলমণি উড়ে চলে গেছে? চোখ প্রায় জলে ভরে আসছিল মালিহার।

এ সময় হঠাৎ ভাইয়া ডেকে উঠলো। বললো, তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ  আছে ছোটকু। বলে একটা র‌্যাপিং করা বাক্স তুলে দিল ওর হাতে। খুব দ্রুত প্যাকেটটা খুলতেই হাঁ হয়ে গেল মালিহা। একটা পলিথিনের র‌্যাপিং-এ মোড়া নীলমণি!

ভাইয়া বললো, আমাদের ক্লাসে শিখিয়েছে কীভাবে প্রজাপতি সংরক্ষণ করতে হয়। বারান্দায় এসে দেখলাম সুন্দর একটা নীল প্রজাপতি। তুই তো প্রজাপতি ভালবাসিস। মাঝেমধ্যেই তো জানতে চাস প্রজাপতি সম্পর্কে। তাই ভাবলাম এটা তোকে গিফট দেই। কোনদিনও এটা নষ্ট হবে না। এমন কি পঁচেও যাবে না।

ভাইয়ার কথাগুলো ওর এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেড়িয়ে গেলো যেন। ও কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো নীলমণির দিকে।

ভাইয়ার ব্যস্ততার কারণে এই নীলমণির কথাতো সে ভাবে বলাই হয়নি ওকে। কী করবে ভেবে উঠতে পারলো না মালিহা। বোকার মতো স্তম্ভিত হয়ে দাড়িয়ে রইলো নীলমণির নিথর দেহটা হাতে নিয়ে।

***
মালিহা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে, প্রাণীবিজ্ঞান নিয়ে। বারো বছর আগের সেই নীলমণির নিথর দেহটাকে সযত্নে রেখে দিয়েছে নিজের কাছে। প্রতিদিনই ওকে একবার দেখে। মনে মনে খোঁজ করে এরকম কোনো প্রজাপতি পাওয়া যায় কি না। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের জন্য প্রজাপতি ধরতে হয় ওদের। কিন্তু নীলমণির মতো কাউকে খুঁজে পায় না ও। মালিহা ক্লাসে শেখে কীভাবে প্রাণীদের এই পৃথিবীতে বাঁচার সুযোগ দিতে হয়। শুধুমাত্র একটু মজা পাওয়ার জন্য প্রাণীদের হত্যা না করে ওদেরও নিজেদের মতো করে বাঁচতে দিতে হয়। মালিহার ইচ্ছা প্রজাপতির একটা ফার্ম করবে। সেখানে নানা প্রজাতির প্রজাপতি রঙ বেরঙের ডানা মেলে উড়ে বেড়াবে। কেউ তাদের বিরক্ত করবে না, হত্যা করবে না। শুধু যারা প্রজাপতি ভালবাসে তারাই ওদের দেখতে যেতে পারবে। আর সেই ফার্মটার নাম হবে ‘নীলমণি’।