ঢাকা, বুধবার ২৪, এপ্রিল ২০২৪ ৭:০১:৪৩ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
‘পদ্মশ্রী’ গ্রহণ করলেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা কাতার-বাংলাদেশ ১০ চুক্তি-সমঝোতা সই কয়েক ঘণ্টায় ৮০ বারেরও বেশি কেঁপে উঠল তাইওয়ান ঢাকা থেকে প্রধান ১৫টি রুটে ট্রেনের ভাড়া যত বাড়ল মাকে অভিভাবকের স্বীকৃতি দিয়ে নীতিমালা করতে হাইকোর্টের রুল আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করেছি : শেখ হাসিনা নতুন করে ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি

সমুদ্র ও সাত মানবী

শান্তা মারিয়া   | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১২:২১ এএম, ২৬ জানুয়ারি ২০১৯ শনিবার

উপন্যাস : সমুদ্র ও সাত মানবী ৥ শান্তা মারিয়া (তৃতীয় পর্ব)

উপন্যাস : সমুদ্র ও সাত মানবী ৥ শান্তা মারিয়া (তৃতীয় পর্ব)

।।তৃতীয় পর্ব।।
এমনিতে সুহার্সো অসম্ভব প্রোফেশনাল একজন মানুষ। অবশ্য তিনি যে পোস্টে কাজ করছেন তাতে অপেশাদারের কোন জায়গা নেই তা বলাই বাহুল্য। মিডিয়াকে কীভাবে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে ব্যবহার করতে হয় তা তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন। কঙ্কনা শারমিন যে নামকরা সাংবাদিক এ তথ্য তার অজানা নয়। কিন্তু শুধু সেজন্যই নয়, এমনিতেও ওর সঙ্গে কথা বলতে তার ভালো লাগছে। 

মাত্র তিনমাস হলো বাংলাদেশে এসেছেন সুহার্সো। এর আগে তার পোস্টিং ছিল আমস্টারডামে, তার আগে ছিলেন দিল্লিতে। ঢাকা তার পছন্দ হচ্ছে না একটুও। এত ধুলো, যানজট আর ময়লা যে কোন সভ্যদেশের রাজধানীতে থাকতে পারে তা ভাবতেও পারেননি তিনি। যদিও তার রেসিডেন্স গুলশান, অফিস বনানীতে। কিন্তু কাজের সূত্রে তো যেতে হয় ঢাকার সর্বত্রই। এমনকি ঢাকার বাইরেও প্রোজেক্টগুলো দেখতে প্রায়ই যান তিনি। প্রকাশ্যে তিনি সবসময় বাংলাদেশের প্রশংসা করেন। কারণ সুহার্সো জানেন, কোন বিদেশির মুখে নিজের দেশের প্রশংসা সবাই ভালোবাসে।

তবে এই মূহুর্তে বান্দরবানের প্রকৃতি তার সত্যিই ভালো লাগছে। বান্দরবানে তিনি আগেও এসেছেন। প্রোজেক্টের জন্যই আসতে হয়েছে তাকে। কিন্তু আগে এত ভালো লাগেনি। নাইক্ষাংছড়ির অপরূপ রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে যতই তিনি কথা বলছিলেন কঙ্কনার সঙ্গে ততোই তিনি ভুলে যাচ্ছিলেন যে প্রোজেক্টের প্রচারে এই সাংবাদিককে তার প্রয়োজন হবে। বরং প্রয়োজনের চেয়েও এই রূপসী নারীটিকে ভালো লাগছিল তার। যে সুহার্সো প্রোজেক্ট ও প্ল্যানিং ছাড়া অন্য বিষয়ে কথা বলতে প্রায় জানে না বলেই তার সহকর্মীরা মনে করে সেই গম্ভীর কান্ট্রি ডিরেক্টরকে মিউজিক আর মুভি নিয়ে আলাপ করতে শুনে পিছনের সিটে বসা আলফাজ মনে মনে হাসছিলেন আবার বিস্মিতও হচ্ছিলেন। 

আর আলফাজের পাশে বসে ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড বিরক্তি বোধ করছিলেন নাহিদ ও সুবর্ণা। অধিকাংশ মানুষের চোখে কঙ্কনা যথেষ্ট সুন্দরী হিসেবে প্রশংসিত হলেও নাহিদের সবসময়েই মনে হয় ও যত না রূপসী মানুষ তার চেয়ে বাড়িয়ে বলে। আসলে কঙ্কনা বেশি ন্যাকামি করে। আর হাসি হাসি মুখ করে পুরুষদের পটাতে ওর জুড়ি নেই। সুবর্ণাও নাহিদের সঙ্গে এ বিষয়ে সম্পূর্ণ একমত। কঙ্কনার ন্যাকামিতে তারা আড়ালে হাসাহাসিও করেন। কিন্তু এখন আলফাজ সামনে থাকায় প্রকাশ্যে বলা যাচ্ছে না কিছুই। শুধু চোখের ইশারায় একে অপরকে দেখাচ্ছেন সামনের সিটে বসা কঙ্কনা আর সুহার্সোর অনর্গল কথোপকথন। 

আলফাজ নিজেও প্রথমদিন কঙ্কনার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সুন্দর একটি মুখ পুরুষের দৃষ্টি কেড়ে নেবে এতো প্রকৃতির স্থায়ী বিধান। এমনকি আজকে সকালেও হোটেলের লবিতে জিন্স আর ফতুয়া পরা কঙ্কনার মেদহীন দেহ দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারেননি আলফাজ। বিশেষ করে তার হাসি আর কপালের লালটিপটা বারে বারে দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছিল। কিন্তু পিআরওকে শুধু একজনের প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করলেই চলে না্ সবাইকে সমান গুরুত্ব দিতে হয়। এই দায়িত্ব দিয়েই প্রতিষ্ঠান তাকে এখানে পাঠিয়েছে। আলফাজ একটু অবাক হয়েই সুহার্সোর আচরণ দেখছিলেন। বসকে এত উচ্ছ্বল সহজে দেখা যায় না। বসের আজকে হলো কি? যাই হোক না কেন সেটা ওর ব্যাপার। মাথা থেকে এই চিন্তা দূরে সরিয়ে আলফাজ পাশে বসা দুই সহযাত্রীর দিকে মন দিলেন। বস যদি কঙ্কনাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চান তো থাকুন। এরা দুজনও যেন নিজেদের কোনভাবেই অবহেলিত বোধ না করেন সেটা দেখা আলফাজের কর্তব্য। 

কঙ্কনারও খুব ভালো লাগছিল সুহার্সোর সঙ্গে কথা বলতে। সাংবাদিকতার পেশায় আলাপ তো আর কম মানুষের সঙ্গে হয় না। তাদের মধ্যে অনেকেই তাকে দেখে মুগ্ধ হয়, কেউ কেউ মুগ্ধ হওয়ার ভান করে। আবার অনেকেই শুধু পত্রিকায় কভারেজ পাওয়ার জন্য তোষামোদ করে। সুহার্সোও তার এনজিওর প্রচার চায় এটা কঙ্কনা জানে। তবে সুহার্সো এমনি একটি বড় আন্তর্জাতিক এনজিওর কান্ট্রি ডিরেক্টর যে কঙ্কনার মতো মাঝারি খ্যাতির একজন সাংবাদিককে তার এতটা খাতির না করলেও চলে। ওর চেয়ে অনেক বড় সাংবাদিকের সঙ্গেই সুহার্সার বন্ধুত্ব রয়েছে। কঙ্কনা প্রায় নিশ্চিত হয়ে উঠছিল যে পত্রিকায় শুধুমাত্র কয়েক ইঞ্চি জায়গা পাওয়ার জন্য এই কথোপকথন নয়। সেও মুগ্ধ হচ্ছিল সুহার্সোর প্রাণবন্ত আলাপে। শুধু কথাই নয়, ওর ভালো লাগছিল সুহার্সোর হাসি, ওর প্রতি সবিশেষ মনোযোগ। সুহার্সোর দৃষ্টি যেন বলছিল কঙ্কনাকে দেখে সে মুগ্ধ। বহুদিন কোন পুরুষকে তার এত ভালো লাগেনি। সুহার্সোর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই নিজের মনকে বিশ্লেষণ করছিল সে। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ দিয়ে গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছিল আলিকদমের দিকে। আলিকদমের একটি ছোট প্রজেক্ট দেখে তারপর নাইক্ষাংছড়ি। 

নাইক্ষাংছড়ির ছাগলখাইয়া পুরোপুরি মারমা গ্রাম। মাত্র পঞ্চাশটি পরিবার থাকে এ গ্রামে। হেডম্যান বুঝিয়ে বলছিল গ্রামের মানুষের অবস্থা। যথারীতি সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন করছিল সামিরা। পাহাড়িরা আতপ চাল খায় শুনে তার প্রশ্ন আতপ চালও ধান থেকে হয় কিনা। এছাড়া জুম চাষ কেন সমতল ভূমিতে হয় না, পাহাড়িদের ঘরবাড়ি ইট সিমেন্টে তৈরি হলে ক্ষতি কি এমন একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছিল সে। এসব প্রশ্ন শুনে অন্যরা হাসি চাপতে না পারলেও একমাত্র আলফাজই তার মুখকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন প্রশ্নগুলোর। 

উর্মি ইসলামের খুব ভালো লাগছিল পাহাড়ি গ্রামের পরিবেশ। মাটি থেকে বেশ উচুঁতে বাঁশের মাচার উপরে তৈরি পাহাড়ি ঘর। পাহাড়ি ঢল, বন্যজন্তু সবকিছু থেকেই বাঁচার সুব্যবস্থা। এমনি ঘরে কি সমাজের হাত থেকেও বাঁচা যায়? উর্মির মনে পড়ছিল রোহানের কথা। রোহান আর সে পরষ্পরকে পাগলের মতো ভালোবাসে। ফুপাতো ভাই থেকে স্বামী হওয়া জাভেদ কখন দূরে সরে গেছে আর আর তার সমস্ত অনুভূতিগুলো অধিকার করে নিয়েছে রোহান তা সে নিজেও জানে না। কিন্তু দশ বছরের ছোট সহকর্মী রোহানের প্রতি এই ভালোবাসাকে সমর্থন করা একটি মানুষকেও যে সে কখনও খুঁজে পাবে না একথা উর্মি ভালো করেই জানে। এমনকি তার নিজের সন্তান সুকন্যাও হয়তো বড় হয়ে মাকেই চরিত্রহীন বলে মনে করবে। যেমন এখনই মনে করে জাভেদ। প্রায়ই বিশ্রীভাষায় গালাগাল করে তাকে। আপন ফুপু হওয়া সত্ত্বেও শাশুড়ি তার চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করেন প্রায়ই। অথচ ছোটবেলায় বাবা হারানো উর্মিকে নিজের মৃত ভাইয়ের চেহারা মনে করেই ঘরে এনেছিলেন ফুপু।  শাশুড়ি হওয়ার পর তার সেই স্নেহ কোথায় মুখ লুকালো কে জানে। তাও তো জাভেদ এখনও জানে না রোহানের সঙ্গে তার সম্পর্ক কতটা গভীর। শুধু সন্দেহ থেকেই জাভেদ তার সঙ্গে যে আচরণ করছে প্রমাণ পেলে হয়তো খুনই করে ফেলবে। নিজের অজান্তেই কপালের পাশের কালসিটেতে হাত বুলালো উর্মি। এই ট্যুরে আসার তিনদিন আগের ঘটনা। কথা কাটাকাটির এক পর্যয়ে হাতে থাকা মোবাইল ফোনটা দিয়েই উর্মিকে বাড়ি দিয়েছিল জাভেদ। কপালটা না ফাটলেও ফুলে গিয়েছিল তীব্র ব্যথায়। অফিসে যদিও বলেছে দেয়ালে বাড়ি খেয়েছে বেখেয়ালে চলতে গিয়ে। পুরুষ যে কতটা হিংস্র ও নির্মম হতে পারে,  কতটা পালটে ফেলতে পারে নিজের চেহারা তা উর্মির চেয়ে বেশি আর কে জানে। রুচিবান জাভেদের কুশ্রী রূপ অনেকবারই দেখতে হয়েছে উর্মিকে। বলতে গেলে বিয়ের প্রথম থেকেই জাভেদের আচরণ উর্মির কাছে ভালো লাগতো না। পরে তো রীতিমতোই ভয়ই পেত সে ওকে। উর্মি বড় হয়েছে সিলেটে। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মামাবাড়িই হয়ে উঠেছিল তাদের নিজেদের সংসার। ঢাকায় বড় হওয়া ফুপাতোভাই জাভেদের সঙ্গে তাই তেমন ঘনিষ্টতা হয়নি কখনও। বিয়ের পর, একটু একটু করে চিনেছে ফুপু ও জাভেদকে। রেগে গেলে মাথার ঠিক থাকে না জাভেদের। বিয়ের তেরদিনের মাথায় উর্মিকে চড় মারার ঘটনাটা মনে পড়ে আজকেও তিক্ততা আর অপমানের ক্ষতটা দগদগে হয়ে উঠলো আবার। কথায় কথায় উর্মিকে মারধোর জাভেদের কাছে ছিল ডালভাত। ডিভোর্স করতে পারেনি সুকন্যাকে নিয়ে কোথায় যাবে সেই চিন্তায়। মিডিয়ার চাকরির উপরে ভরসা করা চলে না একটুও। আজ আছে কাল নেই। বিশেষ করে তখন সে চাকরি করতো ছোট একটি পত্রিকায়। আজকের এই টিভি চ্যানেলের চাকরিটা তাকে অনেক আত্মবিশ্বাসী করেছে সন্দেহ নেই। এই চ্যানেলেই রোহানের সঙ্গে দেখা। তবে রোহানের সঙ্গে আলাপের অনেক আগে থেকেই জাভেদের প্রতি তার ঘৃণা ছিল তীব্র। তাদের দুজনের ভাঙা দেয়ালের এই পথেই না রোহানের প্রবেশ। রোহান আর সে যদি এই রকম একটি বাড়িতে সমাজের সবার চোখ এড়িয়ে থাকতে পারতো। উর্মির সঙ্গে এই সম্পর্ক নিয়ে রোহানের বাড়িতেও অশান্তি কম হচ্ছে না। ওর বাবা-মায়ের ধারণা অফিসের একজন দুশ্চরিত্র মহিলার জন্য রোহানের সমস্ত ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ওকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন তারা। কিন্তু সে রাজি নয়। উর্মিও চায় রোহান বিয়ে করুক। সুন্দর স্বাভাবিক একটি জীবন তার প্রাপ্য। সে কেন উর্মির জন্য কষ্ট পাবে। রোহানের চিন্তাভাবনা অন্য রকম। উর্মিকে সে সম্পূর্ণ নিজের করে পেতে চায়। সাতাশ বছরে মানুষের আবেগগুলো যে এমনি লাগামছাড়া থাকে তা উর্মি জানে। কিন্তু সে তো সাঁইত্রিশ বছর ধরে জীবনকে জেনেছে। সে জানে সমাজের সপ্তরথীর মার যখন শুরু হয় তখন চক্রব্যূহে প্রবেশ করা অভিমন্যু কত অসহায় হয়ে পড়ে। চাকরি চলে যাবার মারটাই যে প্রথম শুরু হবে সেও তো জানা কথা। এতদিনে সেটা শুরু হয়েও যেত যদি না চিফ রিপোর্টার এবং হেড অফ নিউজ দুজনেই উর্মি আর রোহানের প্রতি সহানুভূতিশীল হতেন। কয়েকদিনের জন্য ঢাকার বাইরে এসে সে এসব চিন্তা থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিল। কিন্তু পারছে কই? ঘুরে ফিরে রোহানের চেহারাই চোখে ভাসছে। জোর করে রোহানের চিন্তা দূর করে উর্মি হেডম্যানের সঙ্গে আলাপ শুরু করলো। রিপোর্ট তৈরির জন্য ফুটেজ ও বাইট লাগবে। এটা অবশ্য তেমন হার্ড রিপোর্ট হবে না। ফিচারড নিউজ হবে। খবরের শেষে সময় থাকলে যা দেখানো হয় দর্শকদের ধরে রাখার জন্য। তাছাড়া পুরস্কার টুরস্কারও অনেক সময় জুটে যায় এই সব মানবিক রিপোর্টের সুবাদে। এ ধরনের পুরস্কার অনেকবারই পেয়েছে উর্মি। বাচ্চা কোলে মারমা নারী, হেডম্যানের কথা, পাহাড়িদের বাড়িঘর, রিপোর্ট তৈরির প্রয়োজনীয় উপাদান সে সংগ্রহ করে নিচ্ছিল। রিপোর্টার হিসেবে উর্মি খুবই প্রফেশনাল। এখানে সে কোনরকম ছাড় দেয় না, যতই কেন না মনখারাপ হোক। হেড অফ নিউজ কি সাধে তাকে এত পছন্দ করেন। 
চলবে...