কিছু স্মৃতি এবং জুনিয়র আফরিন: ফারজানা প্রিয়দর্শিনী আফরিন
ফারজানা প্রিয়দর্শিনী আফরিন
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ১২:৩২ এএম, ১০ আগস্ট ২০১৯ শনিবার
মেয়ে কোলে ফারজানা প্রিয়দর্শিনী আফরিন
ডা. আর আর কৈরীর সাথে আব্বার অ্যাপয়েন্টমেন্ট। বসে আছি রাজধানীর গ্রীণ লাইফ হাসপাতালের অপারেশান থিয়েটারের সামনে। দু'ঘন্টার ব্যবধানে প্রায় একই রকম দৃশ্যের মুখোমুখি। খালা কিংবা নানী/দাদীর কোলে টাওয়ালে প্যাচানো নতুন শিশু, তার কিছুক্ষণ পর স্ট্রেচারে শুইয়ে নতুন মাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পোস্ট অপারেটিভ রুমে।
কেমন যেন স্মৃতিময়তা আঁকড়ে ধরলো আমাকে। এই তো মাত্র দুই বছর আগে একই পরিস্থিতিতে ছিলাম আমি, এই হাসপাতালের এই ওটি রুমেই। মাথার অল্প কটা চুল দুই বেণী করে সবুজ পোষাক পরে মুখে জোর করে আনা হাসি আর মনে মনে মরণভয় নিয়ে ঢুকলাম ওটিতে।
দীর্ঘদিনের চেনা ও ভরসার ডাক্তার শিরিন আক্তার বেগম, সেরা অ্যানেসথেশিয়া ডাক্তার বণিক, সাহস দেবার জন্য এলো প্রিয় ছোটভাই ডাক্তার আবির্ভাব নাহা, আমাদের কাছে যে দোলন নামে পরিচিত।
আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে শিরিন আপাকে বলি 'আপা, আমি কি বেঁচে ফিরবো?' আপা দিলেন এক ধমক 'মাঠে-ঘাটে ছুটে বেড়ানো সাহসী মেয়ের মুখে এ কী কথা!'
আমি চুপ করে থাকতে পারি না। ঘাড় ঘুরিয়ে বণিক স্যারকে জিজ্ঞেস করি 'আপনি দেবেন অ্যানেসথেশিয়া? আমার কি জ্ঞান ফিরবে? যদি অবশ হবার আগেই আমার পেটে ছুরি চালিয়ে দেয় ডাক্তার? আপনি কিভাবে বুঝবেন যে আমার শরীর অবশ হয়েছে? ইঞ্জেকশানের সুঁই কি অনেক মোটা? ব্যথা কেমন পাবো?''
উনি ঝটপট করে শিরিন আপাকে বললেন ' ম্যাডাম, এই মেয়ে এতো কথা কয় ক্যান?'
আমি তো আর দমার পাত্রী নই। উনাকে একের পর এক প্রশ্ন করতেই থাকলাম। 'কতক্ষন পর দিবেন ইনজেকশান? কোন জায়গায়টায় দিবেন? আমি শুনেছি অনেকের নাকি অবশ হতে সময় লাগে....'
উনি বললেন, 'হুম, দিয়ে দিসি তো, টের পান নাই?' আমি চমকে উঠলাম। দেখি পায়ের আঙ্গুল নড়াতে পারি না। কী এক দুঃসহ অবস্থা! মাথা উঁচিয়ে পর্দার ওপারে দেখার চেষ্টা করলাম। একজন বয়স্ক সিস্টার এসে একটা ধমক মেরে হাত ধরে রইল। বণিক স্যার আরেক হাত ধরে অনেক গল্প করতে থাকলেন। স্কুলে অনেক খেলাধুলা করতাম কিনা জানতে চাইলেন।
বললাম, আমি খুব ভালো ভলিবল প্লেয়ার ছিলাম। সার্ভ করার জন্য ফেমাস ছিলাম। কথা বলার ফাঁকেই দেখছিলাম দোলন দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে।
হঠাৎ ডাক্তার-নার্সদের কথা-বার্তা বেড়ে গেল, দোলন বেরিয়ে গেল। বণিক স্যারের গল্প করা বন্ধ হলো। আমার বুক ধড়ফড় করতে থাকলো।
কে যেন এসে প্রেশার মাপলো, আমি অসহায় হয়ে গেলাম...কান্না পেতে লাগলো...আম্মার মুখটা ভেসে উঠলো.....কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম মরে যাবার ঝুঁকি নেই আমার।
আপা বললেন, জুনিয়র আফরিন এসেছে, একদম ডুপ্লিকেট কপি। কিন্তু আমি কোন কান্নার শব্দ পেলাম না। আমাকে নাকবোচা, থ্যাবড়া চেহারার একটা বাচ্চা একটুখানি দেখিয়ে কোথায় যেন তাকে নিয়ে গেল। আবছা আবছা শুনতে পেলাম 'বাচ্চার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, অক্সিজেন লাগবে, সুগার টেস্ট করতে হবে....'।
বাচ্চাকে এনআইসিউতে নেয়া লাগবে কিনা জানতে চাইলাম। আপা মৃদু ধমক দিয়ে এতো না ভাবতে বললেন। বেস্ট পেডিয়াট্রিক ডাক্তার শরীফুন্নাহার দেখছেন তাকে।
আমি আর করার মতো কিছু খুঁজে পেলাম না, বলার মতোও কিছু পেলাম না। মনে মনে সিদ্দিককে খুঁজলাম, আমার ডাক্তার বড় ভাইকে খুঁজলাম....কাউকেই পেলাম না। এরই মাঝে বাচ্চার গগনবিদারী কান্নার শব্দ একটানা শুনেই যাচ্ছি.....।
স্ট্রেচারে করে পোস্ট অপারেটিভে যাবার সময় দেখি অফিস কলিগ পারভেজ ভাই, ফাল্গুনি, মাফি দাঁড়িয়ে আছে, ফটোসেশান করছে বাবুর সাথে। ছোট ভাবি কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে গেল। বেশ দূরে আব্বার উদ্বিগ্ন চোখ ছলছল করা মুখ অল্প একটু দেখলাম মনে হলো, ছুটে এসে বড় ভাইয়া ডাক্তারের সাথে কথা বলে নানান ইনস্ট্রাকশান বুঝে নিয়ে আমার সাথে পোস্ট অপারেটিভে ঢুকলো আর বললো 'একদম আম্মার মতো হয়েছে...আম্মা আবার ফিরে আসছে।' আমি তার হাত জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম।
এতো মানুষের মাঝেও যাকে দেখলাম না, সে হলো সদ্য বাবা হওয়া সিদ্দিক। পরে জেনেছি সে তার কন্যা নিয়ে বিহ্বলতায় নাকি হাজার হাজার লোকের কাছে ফোন করছিলো। আর ভ্যালভ্যাল করে হেসে সবার সাথে কথা বলছিলো।
# লেখক: সাংবাদিক