ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৮, মার্চ ২০২৪ ২১:১৬:৪২ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

তরুণ লেখক প্রকল্প: সেই সব জলপতনের গান-৪

শান্তা মারিয়া

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০২:৩১ পিএম, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ মঙ্গলবার

শান্তা মারিয়াসহ তরুণ লেখক প্রকল্পের কয়েকজন বন্ধুর আনন্দ আড্ডা।

শান্তা মারিয়াসহ তরুণ লেখক প্রকল্পের কয়েকজন বন্ধুর আনন্দ আড্ডা।

এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনায়। না ঠিক বৈশাখে নয়। সম্ভবত চৈত্র মাসে দেখা হলো শাহিন রিজভির সঙ্গে। বাংলা একাডেমির বইমেলায় শাহিন রিজভি একটি কবিতার ক্যাসেটের স্টল নিয়েছিলেন। সে সময় বইমেলার পরিধি ছিল টি এস সি থেকে দোয়েল চত্বর অবধি।

সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে বই মেলা বসতো না। বাংলা একাডেমির ভিতরে মূলত ছিল বইয়ের স্টল। আর বাইরে সড়কের উপর কবিতার ক্যাসেট, গানের ক্যাসেট, পোস্টার ইত্যাদির স্টল। খাবারের স্টলও ছিল অনেক। তবে নব্বই দশকের শুরু থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত বইমেলায় বিভিন্ন স্টলে বিশেষত খাবারের স্টলের নামকরণ ছিল অতি অদ্ভুত। যেমন ‘আয় মন প্যাচ খাই’, ‘খাবি না কেন খা’, ইত্যাদি। প্রথম প্রথম অপরিণত মনে ও চোখে সেগুলো ভালো লাগলেও পরে আমার কাছে এসব নাম অতি অরুচিকর বলে মনে হতো। বইমেলার ভাব গাম্ভীর্য  ও ঐতিহ্যকে নষ্ট করে সেটাকে একটা বারোয়ারি মেলার চেহারা দেওয়ারও চেষ্টা ছিল যেন তখন।

বইমেলায় তখন গানের ক্যসেটের সঙ্গে কবিতার ক্যাসেটের গলাবাজির পাল্লা চলতো। কবিতার ক্যাসেটের জন্য যেসব কবিতা বাছাই করা হতো তার মধ্যে ভালো ও ক্ল্যাসিক কবিতা যেমন ছিল তেমনি ছিল চটুল ও ছ্যাবলা ধরনের কিছু কবিতাও। মুশকিল হলো, চটুল ও ছ্যাবলা কবিতার শ্রোতাই ছিল বেশি। তাই আবৃত্তিকাররা তেমন না চাইলেও ক্যাসেট কোম্পানিগুলো তাদের কাটতি বাড়ানোর জন্য চটুল কবিতাগুলোই বেছে নিত। এ ছিল এক সর্বনাশা প্রবণতা। যা কবিতাকে সস্তা বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করতে যাচ্ছিল প্রায়। অবশ্য সেসময় প্রসূনের জন্য প্রার্থনার মতো উন্নত মানের আবৃত্তির ক্যাসেটও চলেছিল বেশ।

যাহোক ধান ভানতে শিবের গীত আর না গাই। বলছিলাম শাহিন রিজভির কথা। বইমেলায় শাহিন তার নিজের কবিতার ক্যাসেটের জন্য একটা স্টল নিয়েছিল। স্টলটির নাম ছিল অবাঞ্ছিত ভালোবাসা। সেখানে তার সঙ্গে আলাপ হয় প্রকল্পের কয়েকজন কবির। তাদের সূত্রেই মার্চ মাসে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজের বারান্দায় আমার সঙ্গে তার পরিচয়। এরপর থেকেই আমাদের প্রকল্প-বন্ধু মহলে শাহিনের উপস্থিতি নিশ্চিত হয়ে যায়। আমি ছিলাম প্রকল্পের দ্বিতীয় ব্যাচে। শাহিন যোগ দেয় তৃতীয় ব্যাচে। শাহিনের সূত্র ধরে তৃতীয় ব্যাচের লেখকদের সঙ্গেও আমার পরিচয় গড়ে ওঠে। এই প্রকল্পের সূত্র ধরেই শামীম সিদ্দিকী, মনিরা মীম্মুর সঙ্গেও আলাপ ও বন্ধুত্ব।

বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজের সিঁড়িতে, লাইব্রেরির সামনে, পুকুর ঘাটে, বটতলায়, বহেড়া তলায়, এবং সবুজ ঘাসের বুকে আমাদের আড্ডা চলতো অবিরাম। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু কানিজ ফাতেমা জলিও সেই আড্ডায় যোগ দিত মাঝে মধ্যে। তরুণ লেখক প্রকল্পের প্রতি এখানে আরেকবার ঋণ স্বীকার করছি। লেখক অঙ্গনে আমার অনেক ভালো বন্ধুকে আমি পেয়েছি প্রকল্পের সূত্র ধরেই।

এর আগে যে লিখতাম না তাতো নয়। আমার প্রথম বই ‘মাধ্যাকর্ষণ’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৯ সালে (৯ বছর বয়সে)। খেলাঘর, কচি কাঁচার আসরে কবিতা ছাপা হতো। ভারত বিচিত্রা, সোভিয়েত নারীতে লিখতাম প্রায়ই। কিন্তু লেখক প্রকল্পে এসে যেটা হলো তা একেবারেই অন্য রকম। বলতে গেলে আমার জীবনের মোড় ঘুরে যায় এই প্রকল্প থেকে। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের বিষয় লোকপ্রশাসন। স্বাভাবিকভাবেই সাংবাদিকতা আমার গন্তব্য ছিল না। হয়তো ব্যাংক, এনজিও বা কোন প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক বিভাগেই চাকরি করার কথা ভেবেছিলাম। বিদেশে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণের জন্যও প্রস্তুতি চলছিল। অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগও পেয়ে গিয়েছিলাম। পুরো নয় হাফ স্কলারশিপ।

কিন্তু লেখক প্রকল্পের পর মনে হলো লেখালেখিতেই থাকতে হবে। তখনই সংবাদপত্রে যোগ দেওয়ার ভুত কাঁধে চাপে। কারণ আমার একটা ধারণা হয়েছিল যে, (খুব হাস্যকর ধারণা যদিও) পত্রিকাতে চাকরি করলে নিজের লেখা প্রকাশ করা সহজ হবে। প্রকল্পের ছয় মাস ততোদিনে শেষ হয়ে গেছে। জুনের ৩০ তারিখে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলো আর ১ জুলাই (১৯৯৬) আমি লাইসিয়াম ইন্টার ন্যাশনাল স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেই। তাতে কিন্তু প্রকল্পের সঙ্গে যোগাযোগ মোটেই বন্ধ হয়নি। স্কুলের কাজ শেষ করে দুপুরের পর গিয়ে যোগ দিতাম একাডেমির আড্ডায়। তাছাড়া, প্রকল্পের নির্ধারিত বইটি প্রকাশের কাজ চলছিল তখন। প্রুফ সংশোধন, নতুন কবিতা যোগ করে, পুরনোগুলোকে ছাঁটাই, পরিমার্জন এসব চলছিল।

সেসময় দেখলাম, শাহিন রিজভির সঙ্গে আমার মতামতের খুব মিল হচ্ছে। আমি নিজেকে যেমন পছন্দ করি, সেও আমাকে তেমনই পছন্দ করে। আমার কাব্যপ্রতিভা সম্পর্কে নিজের যেমন উচ্চ ধারণা (সে সময় ছিল, সকল তরুণ কবিরই থাকে), শাহিনের আমার সম্পর্কে ধারণা তারচেয়েও উচ্চ। আমার কবিতাগুলো সম্পর্কে তার মতামত খুবই মনোগ্রাহী বলে মনে হতে লাগলো।
লেখক প্রকল্পের অনেক বন্ধু তখন বিভিন্ন সংবাদ পত্রে চাকরি করতেন, চাকরি খুঁজছিলেন বা কনট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করতেন।

বিকেলের দিকে সকলেই আসতেন বাংলা একাডেমির বটের ছায়ায় আড্ডা দিতে। মুজিব ইরম ভাই তখন বাংলা বাজার পত্রিকায় ছিলেন(?)। প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিলাম এ কারণে যে আমি ঠিক নিশ্চিত নই। স্মৃতি তো অনেক সময়ই বিভ্রম ঘটায়। যাহোক সে সূত্রে বাংলা বাজারে কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয়।

জনকণ্ঠ অফিস তখন ৫৫, মতিঝিলে। জনকণ্ঠের সাহিত্য সম্পাদক তখন কবি নাসির আহমেদ। মতিন রায়হান এবং আরও কয়েকজনের সঙ্গে তার বেশ সুপরিচয়। তাদের কবিতা জনকণ্ঠে প্রকাশিত হচ্ছে। আমিই বা বাদ যাই কেন? বাবার সঙ্গে গেলাম জনকণ্ঠ অফিসে। ফিচার বিভাগের প্রধান ছিলেন শিশুতোষ সাহিত্যের নামকরা লেখক এখলাসউদদীন আহমেদ যিনি অনেক ছোটবেলা থেকেই আমাকে চেনেন (অবশ্যই পারিবারিক পরিচয়ের কারণে)। পরিচয় ঘটলো নাসির ভাইয়ের সঙ্গেও। জনকণ্ঠে কবিতা প্রকাশিত হলো। লেখক বন্ধুদের মধ্যে একটু সম্মান বাড়লো।

মতিন রায়হান তখন একটি ম্যাগাজিনে চাকরি শুরু করেন। তার সূত্রেও কয়েকটি কবিতা সেই ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হলো। একটি কবিতা প্রকাশ হলে কি যে আনন্দ হতো তখন।

লেখক প্রকল্পে থাকার সময়ই পরিচয় ঘটে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকদের সঙ্গে। নব্বই দশকে লিটল ম্যাগের অবস্থা খুবই রমরমা ছিল।

(চলবে)