ঢাকা, শুক্রবার ১৯, এপ্রিল ২০২৪ ১৮:৫৪:১০ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

একাত্তরে অামরা কণ্ঠ দিয়ে যুদ্ধ করেছি : শাহীন সামাদ

উইমেননিউজ২৪.কম

প্রকাশিত : ০১:২৩ এএম, ২৬ মার্চ ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ০৮:১০ এএম, ৮ মে ২০১৮ মঙ্গলবার

শাহীন সামাদ কেবল একজন নজরুল সঙ্গীতের কিংবদন্তী শিল্পী নন। ৭১ এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন কণ্ঠযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিসেনারা যেমন অস্ত্র দিয়ে দুর্নিবার গতিতে পাক সেনাদের পরাজিত করেছিল ঠিক তেমনি শাহীন সামাদ যুদ্ধ করেছেন কণ্ঠ দিয়ে। কণ্ঠকে হাতিয়ার বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেছিলেন গানে গানে। বাঙালি জাতির ৪৭তম দিবসের প্রাক্কালে রোববার উইমেননিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এর মুখোমুখি হয়েছিলেন এই কণ্ঠযোদ্ধা। যুদ্ধদিনের নানা স্মৃতি তুলে ধরেছেন স্বাধীনবাংলা বেতারের কেন্দ্রের এই কণ্ঠ যোদ্ধা। বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববতী সময় থেকে বর্তমান সময়ের সম-সাময়িক বিষয়গুলোও। উইমেননিউজের জন্য স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের এই কণ্ঠশিল্পীর বিশেষ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, সালেহীন বাবু।

প্রশ্ন : আপনি তো মুক্তিযুদ্ধের একজন সাহসী যোদ্ধা এবং স্বাক্ষী। ৪৭তম স্বাধীনতা দিবসে আপনার অনুভূতি কী?
শাহীন সামাদ : আমি সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ছিলাম। যুদ্ধের প্রারম্ভে বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির আত্মপ্রকাশ ঘটে যারা তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করত। সেই ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠে বাংলাদেশি মুক্তি সংগ্রামী শিল্প সংস্থা। আমাদের সেই দলে আরও ছিলেন সৈয়দ হাসান ইমাম, মুস্তফা মনোয়ারসহ অনেকেই। এভাবেই শুরু।

প্রশ্ন : যুদ্ধের সময় আপনি দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তরে যেয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করতেন। সে দিনগুলো সম্পর্কে কিছু বলুন।
শাহীন সামাদ : সে সময় আমি অনেক রিফিউজি ক্যাম্পে, যুদ্ধ বিধস্ত গ্রাম, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়েছিলাম। মুক্তিসেনাদের জন্য বিভিন্ন জায়গায় গান গেয়েছি, স্টেজ পারফর্ম করেও যে অর্থ পেয়েছি তা তাদের পেছনে ব্যয় করেছি। তাদের ক্যাম্পে যেয়ে স্বাধীনতার উদ্দমী, জাগ্রত, শ্বাশত, গতিময় গানগুলো গেয়ে তাদের ক্লান্তি, ব্যাথা ভুলিয়ে দিয়েছি যা তাদের নতুনভাবে প্রেরণা যুগিয়ে আরও অপ্রতিরোধ্য, অসীম সাহসী হয়ে পাক-হানাদারদের নিশ্চিহ্ন করার প্রত্যয়ে অগ্রগামী করেছিল। এভাবেই আমরা এগিয়ে গিয়েছিলাম দিনের পর দিন। হাল ছাড়িনি।

প্রশ্ন : একজন নারী হয়েও আপনি থেমে থাকেননি, যুদ্ধে ঠিকই অংশগ্রহণ করেছিলেন। এতটা শক্ত-মানসিকতা কোথা থেকে পেয়েছিলেন?
শাহীন সামাদ : একাত্তরের ২৫ মার্চ কাল রাতের কথা আমি এখনও ভুলতে পারি না। কখনও ভুলতে পারবোও না। যতদিন বেঁচে থাকবো এই দিনটার কথা মনে থাকবে। ওই দিনের গুলির বিদীর্ণ শব্দ এখনও আমার কানে বাজে। চারদিকে আগুন, ধোঁয়া, থেমে থেমে গুলির আওয়াজ। আমরা সবাই ভেঙে পড়েছিলাম আগত দিনগুলোর কথা ভেবে। তারপরেও মনোবল হারাই নি। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দেশের জন্য কিছু একটা করব। অস্ত্র দিয়ে না পারি, কণ্ঠ তো আছে। এই কণ্ঠ দিয়েই যুদ্ধ করব। সেটাই করেছি মহান মুক্তিযুদ্ধে। প্রেরণাদায়ী গান গেয়ে আমাদের মুক্তিবাহিনীর ভাইদের সাহস যুগিয়েছি। এটা রণক্ষেত্রের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

প্রশ্ন : বর্তমান প্রজন্মদের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা, চিন্তা-বোধ কতটুকু কাজ করছে বা দেখছেন?
শাহীন সামাদ : আমি তো মনে করি নতুন প্রজন্মদের মধ্যে স্বাধীনতার চিন্তা-চেতনা পুরোপুরিই কাজ করে। ওরা এখন সবকিছুই বুঝতে পারে, অনেকটাই প্রগ্রেসিভ। ওরা যা করছে ভাল বুঝেই করছে। আমরা যদি ৪৬ বছর আগে এত কম লোকজন নিয়ে দেশ স্বাধীন করে আনতে পারি, এখন তো প্রায় ১৮-১৯ কোটির মত লোক। তাহলে নতুন প্রজন্ম কেন পারবে না? বুঝবে না? তাছাড়া ইন্টারনেটের যুগে তারা এখন সবকিছুই দেখছে, সচেতন হচ্ছে। আমি তো সম্পূর্ণরূপে আশাবাদী।

প্রশ্ন : বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে এ জাগরণের প্রভাব কতটুকু দেখছেন ?
শাহীদ সামাদ : এদেশের মেয়েদের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তারা এখন অনেক বেশি অগ্রগামী। তারা সবকিছু বুঝতে পারে, স্বাধীনতার চেতনা লালন করে। বুঝে তাদেরও দেশের জন্য কিছু করা দরকার এবং তারা করছেও।

প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের কাঙ্খিত বাংলাদেশ কি আমরা পেয়েছি ?
শাহীন সামাদ : অবশ্যই পেয়েছি। আমরা আমাদের দেশকে পেয়েছি। আমাদের দেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। আমাদের নিজস্ব পাসপোর্ট আছে, আগে আমরা কয়টাইবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেতাম। আর এখন বিদেশে সরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে অনেক অনুষ্ঠান হচ্ছে। ৭১-এর পরবর্তী সেই বাংলাদেশ আর বর্তমান বাংলাদেশ অনেক পার্থক্য। আমরা এখন নিজরাই স্বয়ংসম্পূর্ণ ।

প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি সব ভুলে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, বর্তমান এ দেশকে স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে হলে কি কি করণীয় বলে আপনি মনে করেন।
শাহীন সামাদ : সে সময় আমরা ছিলাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ঘোষণা দিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’ তার সেই এক ভাষনে আমরা সব বাঙালি এক মন, এক আত্মা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম মুক্তিযুদ্ধে। সেই সময়ে পারলে এখন কেন পারবো না? এখন আমরা ভাল কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা না করে খারাপ বিষয় নিয়ে বেশি আলোচনা- সমালোচনা করি। খারাপ বিষয়টাই বা কেন বেশি বেশি চিন্তা করি আমি বুঝি না। যাই ইচ্ছে হয়, তাই করতে মন চায়, যেভাবেই হোক পেতে চেষ্টা করি। আমাদের সবার কাছে সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি কে? নিশ্চয় মা। মাকেই কিন্তু আমরা দেখব সবার আগে, জগতে মাকে ভক্তি না করলে কি কিছু পাওয়া যায় ? আমার সোনার বাংলা, আমার মা। আমার মাকে তো আমারই শ্রদ্ধা করতে হবে, মায়ের জন্য সবকিছু করতে হবে। সবার একসঙ্গে থাকতে হবে। আমরা পারলে তোমরা পারবো না কেন?

প্রশ্ন : স্বাধীনতা, দেশপ্রেম বিশেষ দিনগুলোতে মনে না করে ভবিষ্যত প্রজন্মদের অন্তরে কিভাবে লালন করা যায় ?
শাহীন সামাদ : মা-বাবা একটি সংসারের অভিভাবক। মা-বাবাকে সন্তানকে শিখাতে হবে মুক্তিযুদ্ধ কি ? বঙ্গবন্ধু কি ? বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানগুলোতে যেগুলো দেশের সঙ্গে সম্পর্কিত সে অনুষ্ঠানগুলোতে, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ঘুরে দেখানো, তাহলে কিন্তু সন্তান জানতে পারবে সবকিছু। মোট কথা মা-বাবার এখানে ভূমিকা নিতে হবে। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, নিজে মানুষের মত মানুষ না হলে দেশ-দশের সেবা করা যায় না।’

প্রশ্ন : সব মিলিয়ে আপনি আশাবাদী
শাহীন সামাদ : হ্যা আমি অবশ্যই আশাবাদী। তবে সাধনা দরকার। এ নতুন প্রজন্মই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশকে আরও উচ্চাসনে নিয়ে যাবে, সেদিন আর দূরে নয় যেদিন এ দেশ হবে তেমার আর আমার সোনার বাংলাদেশ।

প্রশ্ন : স্বাধীনতার দিবসের প্রাক্কালে সময় দেওয়ার জন্য দেওয়ার আপনাকে ধন্যবাদ।
শাহীদ সামাদ : আপনাকে ও সকল পাঠকদের স্বাধীনতা দিবসের প্রাণঢাণা শুভেচ্ছা রইল।