ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৮, মার্চ ২০২৪ ১৯:০৫:০৫ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

নারী দিবস : অতীত থেকে বর্তমান

শারমিন সুলতানা

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০১:১৭ এএম, ৮ মার্চ ২০১৯ শুক্রবার

এ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চীর কল্যাণকর/অর্ধক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। কবি কাজী নজুরুল ইসলাম নারীর অবদানের কথা এভাবেই বলেছেন। বিশ্ব সৃষ্টির আদি পর্ব থেকে নারী ঘরে-বাইরে সর্বত্র অবদান রেখে চলেছেন নিরলসভাবে। কিন্তু নারীর নেই কাজের স্বীকৃতি। আর তাইতো স্বীকৃতি আদায়ে নারীকে নামতে হলো রাজপথে।

যখন ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে শিল্প বিপ্লব ঘটে তখন নতুন নতুন আবিষ্কারে বিশ্বজুড়ে এক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ওই সময় চোখে পড়ে শিল্প-কারখানায় নারী ও পুরুষের মধ্যে মতভেদ। নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সামাজিক,পারিবারিক ও অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশেই পালন করা হয়। ৮ মার্চ নারীদের সফলতার স্বীকৃতি দেয়া হয়। কোন জাতিগত, ভাষাগত, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক গত দিক থেকে নয়। নারীদের নিজস্ব অর্জনের দিক বিবেচনা করে এই দিনের স্বীকৃতি দেয়া হয়। সর্বপ্রথম বিংশ শতাব্দীতে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে নারী শ্রমিকদের কার্যকলাপের ভিত্তিতে এই দিনের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উন্নত ও অনুন্নত দেশের নারীদের জন্য একটি নতুন বিশ্ব মাত্রা অধিকৃত করেছে। বিশ্বব্যাপী জাতিসংঘের নারী সম্মেলন দ্বারা, আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস (আদি নাম আন্তর্জাতিক কর্মজীবী নারী দিবস) প্রতি বছর ৮ মার্চ তারিখে পালিত হয়। সারা বিশ্বব্যাপী নারীরা একটি প্রধান উপলক্ষ্য হিসেবে এই দিবস উদযাপন করে থাকেন। বিশ্বের এক এক প্রান্তে নারীদিবস উদযাপনের প্রধান লক্ষ্য এক এক ধরনের। কোথাও নারীর প্রতি সাধারণ সম্মান ও শ্রদ্ধা উদযাপনের মুখ্য বিষয় হয়। আবার কোথাও নারীদের আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পায়।

ইতিহাস : এই দিবসটি উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেই মিছিলে চলে সরকার লেঠেল বাহিনীর দমন-পীড়ন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হলো। ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ; জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। এরপর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয়, ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। 

দিবসটি পালনে এগিয়েন আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। ১৯১৪ সাল থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালিত হতে লাগল। বাংলাদেশেও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতার লাভের পূর্ব থেকেই এই দিবসটি পালিত হতে শুরু করে। তারপর ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। এরপর থেকে সারা পৃথিবীজুড়েই পালিত হচ্ছে দিনটি নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার অঙ্গিকার নিয়ে।

নারী দিবসে বিভিন্ন দেশে সরকারি ছুটি : বিশ্বের অনেক দেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। এর মধ্যে আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বেলারুশ, বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, কিউবা, জর্জিয়া, গিনি-বিসাউ, ইরিত্রিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজিস্তান,  লাওস,মলদোভা, মঙ্গোলিয়া, মন্টেনিগ্রো, রাশিয়া, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উগান্ডা, ইউক্রেন, উজবেকিস্তান, ভিয়েতনাম এবং জাম্বিয়া।
এছাড়া, চীন, মেসিডোনিয়া, মাদাগাস্কার, নেপালে শুধুমাত্র নারীরাই সরকারী ছুটির দিনভোগ করেন।

নারী দিবসে জাতিসংঘের প্রতিপাদ্য : ১৯৯৬ অতীত উদযাপন এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা। ১৯৯৭ নারী এবং শান্তি।  ১৯৯৮ নারী এবং মানবাধিকার। ১৯৯৯ নারী প্রতি সহিংসতামুক্ত পৃথিবী। ২০০০ শান্তি স্থাপনে একতাবদ্ধ নারী। ২০০১ নারী ও শান্তি : সংঘাতের সময় নারীর অবস্থান। ২০০২ আফগানিস্তানের নারীদের বাস্তব অবস্থা ও ভবিষ্যত। ২০০৩ লিঙ্গ সমতা ও সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা। ২০০৪ নারী এবং এইচ আই ভি/এইডস। ২০০৫ লিঙ্গ সমতার মাধ্যমে নিরাপদ ভবিষ্যত। ২০০৬ সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী। ২০০৭ নারী ও নারী শিশুর ওপর সহিংসতার দায়মুক্তির সমাপ্তি। ২০০৮ নারী ও কিশোরীদের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ। ২০০৯ নারী ও কিশোরীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে নারী-পুরুষের একতা। ২০১০ সমান অধিকার, সমান সুযোগ- সকলের অগ্রগতি। ২০১১ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নারীর সমান অংশগ্রহণ। ২০১২ গ্রামীণ নারীদের ক্ষমতায়ন- ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সমাপ্তি। ২০১৩ নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়। ২০১৪ নারীর সমান অধিকার সকলের অগ্রগতির নিশ্চয়তা। ২০১৫ নারীর ক্ষমতায়ন ও মাবতার উন্নয়ন।

ইতিহাসের কালপঞ্জি : ১৯০৯ : প্রথম জাতীয় নারী দিবস ২৮ ফেব্রুয়ারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালন করা হয়। আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক দল পোশাক শ্রমিকদের ১৯০৮ সালের ধর্মঘটের সম্মানে এই দিনটি মনোনীত করেন।
১৯১০ : কোপেনহেগেন এ আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সভায় নারী দিবস প্রতিষ্ঠিত করা হয়। নারীদের সর্বজনীন ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে এবং নারী অধিকারের জন্য আন্দোলনের সম্মান করার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে একটি নারী দিবস পালন করার প্রস্তাব দেয়া হয়। ফিনিশ পার্লামেন্ট এ ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারীকে বাছাই করা হয় যেখান থেকে তিন জন নারী নির্বাচিত করা হয়। তবে নারী দিবস কোন দিন পালন করা হবে এই বিষয়ে সেদিন কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হইনি।
১৯১১ : কোপেনহেগেনের উদ্যোগের ফলে, আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের উদ্দেশ্যে আস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ড এ ১৯ মার্চ প্রায় এক লাখ নারী ও পুরুষ র্যা লি করেন। এই র্যািলিতে তারা নারীদের জন্য ভোটাধিকার ছাড়াও পাবলিক অফিসে চাকরীর সুযোগ, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং কাজের উপর নারীদের নিয়ে যে বৈষম্যতা রয়েছে তা দূর করতে বলা হয়েছে।
১৯১৩-১৪ : আন্তর্জাতিক নারী দিবস শান্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিবাদী একটি প্রক্রিয়া অংশ হিসেবে গড়ে ওঠে। রাশিয়ান নারীরা তাদের প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করেন ফেব্রুয়ারীর শেষ রবিবারে। পরের বছর থেকে ইউরোপের অন্যত্র দেশগুলোতে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। মহিলারা র্যা লি করেন নারী সমাবেশের যুদ্ধ প্রতিবাদ বা অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে।
১৯১৭ : যুদ্ধের প্রতিবাদে রাশিয়ান নারীগণ “ব্রেড ও শান্তি” নামে একটি ধর্মঘট শুরু করেন। তারা ফেব্রুয়ারীর শেষ রবিবারে ধর্মঘটটি পালন করেন। যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৮ই মার্চ হয়। ৪ দিন পর সেখানে নারীদের ভোট দেয়ার অধিকার নিশ্চিত করা হয়।
১৯৭৫ : আন্তর্জাতিক নারী বছর থেকেই জাতিসংঘ ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন করা শুরু করেন।
১৯৭৭ : নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে একটি সুনির্দিষ্ট দিন ঠিক করার প্রস্তাব জাতিসংঘে গৃহীত হয়। ঐতিহাসিক ও জাতীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী বছরের কোন একটি দিন পালন করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
১৯৯৫ : বেইজিং একটি ঘোষণা করেন, যেখানে ১৮৯ জন সরকার একটি ঐতিহাসিক রোডম্যাপ এ স্বাক্ষর করেন, ১২টি সমালোচনামুলক যায়গা নিয়ে। যেন সেই এলাকার মেয়েরা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন, পছন্দমত ব্যায়াম করতে পারেন, পড়াশুনা করতে পারেন, চাকরী করতে পারেন এবং সমাজে সহিংসতা ও বৈষম্য মুক্ত হতে পারেন।
২০১৪ : নারীদের অবস্থা নিয়ে কমিশনের ৫৮ তম অধিবেশনে লিঙ্গ সমতা সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। জাতিসংঘের সত্ত্বা ও সারা বিশ্ব থেকে স্বীকৃত এনজিও আট মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) অগ্রগতি স্টক এবং অবশিষ্ট চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। এমডিজি নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ সমতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

জাতিসংঘের এর সদস্যরা ১৯৪৫ সাল থেকে পুরুষ এবং নারীদের মাঝে সমতা করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বছরের পর বছর পালাক্রমে এর উন্নতি সাধিত হচ্ছে।