ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১৮, এপ্রিল ২০২৪ ২১:৩০:০২ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
জাতির পিতা বেঁচে থাকলে বহু আগেই দেশ আরও উন্নত হতো টাইমের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় বাংলাদেশের মেরিনা নান্দাইলে নারী শ্রমিককে কুপিয়ে হত্যা তীব্র গরমে জনজীবনে দুর্ভোগ, বাড়ছে জ্বর-ডায়রিয়া কারাগার থেকে সরিয়ে গৃহবন্দী অবস্থায় সুচি কৃষকরাই অর্থনীতির মূল শক্তি: স্পিকার মধ্যপ্রাচ্যের দিকে নজর রাখার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

আলবেনিয়া: ইউরোপের দরিদ্রতম দেশ

অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৪:১৫ এএম, ৫ জুন ২০১৯ বুধবার

আলবেনিয়ার জাতীয় পতাকা

আলবেনিয়ার জাতীয় পতাকা

আলবেনিয়া (আলবেনীয় ভাষায় Shqipëri শ্চিপারি) দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের একটি রাষ্ট্র। এটি বলকান উপদ্বীপের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। এ দেশটি পশ্চিম দিক থেকে আর্দ্রিয়াটিক এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে আইওনিয়ান সাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত। ২৮ হাজার ৭৪৮ বর্গকিলোমিটারের (১১,১০০ বর্গ মাইল) আলবেনিয়াতে উপকূল রয়েছে ৩৬২ কিলোমিটারের। দুই সাগরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এই দেশটির ৭০ শতাংশ ভূমিই খুব বন্ধুর। দেশটির সর্বোচ্চ স্থান দিবারের কোরাব সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২,৭৫৩ মিটার ওপরে অবস্থিত। আলবেনিয় জাতির পিতা ইস্কান্দর বে।

আলবেনিয়া ইতিহাসে বহুবার পূর্বের ইতালীয় শক্তি ও পশ্চিমের বলকান শক্তির কাছে নত হয়েছে। ১৫শ শতকে আলবেনিয়া গ্রীস অধীনে আসে এবং ১৯১২ সালের আগ পর্যন্ত স্বাধীনতা লাভ করতে পারেনি। ১৯৪৪ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এটি একটি সাম্যবাদী রাষ্ট্র ছিল। ১৯৯১ সালে দেশটি গণতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতি ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে রূপান্তর শুরু করে।

তারানা আলবেনিয়ার বৃহত্তম শহর ও রাজধানী। রাষ্ট্রপতি    বুজার নিশানী, প্রধানমন্ত্রী সালি বেরিশা, সংসদের স্পিকার    জোযেফিনা তোপাল্লি।

প্রাচীন ইতিহাস
বর্তমান আলবেনীয়রা সম্ভবত ইলিরীয় জাতির লোকদের বংশধর। দক্ষিণ বলকান অঞ্চলে গ্রিক, রোমান ও স্লাভ জাতির লোকেরা অভিবাসন করার অনেক আগে থেকেই ইলিরীয় জাতির লোকেরা বাস করত। খ্রিস্টপূর্ব ৭ম ও ৬ষ্ঠ শতকে গ্রিকেরা আলবেনিয়ার উপকূলে অনেকগুলি বসতি স্থাপন করে; এগুলির মধ্যে ছিল এপিদামনুস (বর্তমান দুররেস) এবং আপোল্লোনিয়া (বর্তমান ভ্‌লোরে)। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতক নাগাদ এই বসতিগুলির পতন হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত এগুলি বিলীন হয়ে যায়। গ্রিকেরা চলে যাবার পর এই এলাকায় আদিকাল থেকে বসবাসকারী ইলিরীয় সমাজের বিবর্তন ঘটে। এতে জটিল রাজনৈতিক সংগঠন যেমন ফেডারেশন, রাজ্য, ইত্যাদির আবির্ভাব ঘটে। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইলিরীয় রাজ্যটি খ্রিস্টপূর্ব ৫ম ও ২য় শতকের মধ্যবর্তী সময়ে টিকে ছিল।

একই সময়ে আড্রিয়াটিক সাগরের অপর তীরে ইতালীয় উপদ্বীপে রোমের বিস্তার ঘটছিল। রোমানরা ইলিরিয়াকে পূর্ব দিকের দেশগুলি বিজয়ের একটি আরম্ভকেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করত। ২২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দেই রোমানরা আড্রিয়াটিক সাগর পাড়ি দিয়ে ইলিরিয়া আক্রমণ করে। ১৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ ইলিরিয়াতে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। তারা এটিকে রোম সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত করে এবং নাম দেয় ইলিরিকুম। রোমানরা এর পর প্রায় ৬ শতাব্দী ধরে এলাকাটি শাসন করে। কিন্তু ইলিরীয়রা রোমান সংস্কৃতির সাথে মিশে না গিয়ে নিজেদের স্বকীয় সংস্কৃতি ও ভাষা ধরে রাখে। তা সত্ত্বেও অনেক ইলিরীয় রোমান সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জনে সক্ষম হন। অনেক ইলিরীয় বংশোদ্ভূত পরবর্তীকালে রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাটও হন। এদের মধ্যে আছেন আউরেলিয়ান (২৭০-২৭৫ খ্রিস্টাব্দ), দিওক্লেতিয়ান (২৮৪-৩০৫ খ্রিস্টাব্দ), এবং মহান কন্সতান্তিন (৩০৬-৩৩৭ খ্রিস্টাব্দ)। ১ম শতকের মাঝামাঝি নাগাদ ইলিরিকুমে খ্রিস্টধর্ম প্রভাব ফেলতে থাকে এবং ৫৮ খ্রিস্টাব্দে সাধু পল এপিদামনুস নগরের জন্য একজন যাজক নিয়োগ করেন। পরবর্তীতে আপোল্লোনিয়া এবং স্কোদ্রা (বর্তমান শ্‌কোদার) শহরে বিশপদের কর্মস্থল নির্মাণ করা হয়।

বাইজেন্টীয় শাসন
৩৯৫ সালে রোমান সাম্রাজ্য পূর্ব ও পশ্চিমে দুইটি সাম্রাজ্যে ভাগ হয়ে যায়। আধুনিক আলবেনিয়া এলাকাটি পূর্ব অংশে তথা বাইজেন্টীয় সাম্রাজ্যে পড়ে। অনেক ইলিরীয় পরবর্তীতে বাইজেন্টীয় সম্রাট হন। এদের মধ্যে ১ম জুস্তিনিয়ান (৫২৭-৫৬৫) অন্যতম। ৫ম শতক নাগাদ এখানে খ্রিস্টধর্ম একটি প্রতিষ্ঠিত ধর্মে পরিণত হয়। আলেবেনিয়ার খ্রিস্টানেরা বাইজেন্টীয় সাম্রাজ্যের প্রজা হয়েও রোমান পোপের অধীনে ছিলেন। ৫ম শতকে ভিজিগথ, হুন এবং অস্ট্রোগথেরা অঞ্চলটি আক্রমণ করে এর অশেষ ক্ষতিসাধন করে। ৬ষ্ঠ ও ৮ম শতকের মধ্যবর্তী সময়ে ইলিরিয়া অঞ্চলটিতে স্লাভ জাতির লোকেরা বসতি স্থাপন করে। বহু ইলিরীয় স্লাভদের সাথে মিশে যায় এবং বর্তমান স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, সার্বিয়া এলাকাগুলির মানুষদের পূর্বপুরুষ গঠন করে। কিন্তু দক্ষিণ ইলিরীয় অঞ্চলের লোকেরা, যার মধ্যে আধুনিক আলবেনিয়াও পড়েছে, স্লাভদের সাথে মিশ্রণ রোধ করে। ৭৩২ খ্রিস্টাব্দে বাইজেন্টীয় সম্রাট ৩য় লিও আলবেনীয় গির্জার সাথে রোমের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দেন এবং একে কন্সতান্তিনোপলের (বর্তমান ইস্তানবুল) ধর্মগুরুর অধীনে আনেন।

৮ম থেকে ১১শ শতকের মধ্যে ইলিরিয়া ধীরে ধীরে আলবেনিয়া নামে পরিচিত হতে শুরু করে। নামটি এসেছে মধ্য আলবেনিয়াতে বসবাসকারী আলবানোস জাতির লোকদের নাম থেকে। বর্তমান আলবেনীয়রা নিজেদের দেশকে শকিপারিয়া (ঈগলের দেশ) নামে ডাকে, কিন্তু এই নামটির উৎস নির্ধারণ করা যায়নি। তবে পণ্ডিতেরা একমত যে শকিপারিয়া নামটি ১৬শ শতকে আলবেনিয়া নামটিকে প্রতিস্থাপন করে। ৯ম শতকে বাইজেন্টীয় সম্রাটের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হতে শুরু করে। ফলে প্রথমে বুলগেরীয় স্লাভ, নর্মান ক্রুসেডার, ইতালীয় আঙ্গেভিন, সার্ব এবং ভেনিসীয় জাতির লোকেরা পর্যায়ক্রমে অঞ্চলটি আক্রমণ করে। ১০ম শতকের পরে এখানে একটি জমিদারী প্রথা গড়ে ওঠে। কৃষক সৈন্যরা যারা আগে সামরিক নেতাদের অধীনে যুদ্ধ করেছিল, তারা জমিদারদের খামারে কাজ করা শুরু করে। এসময় অঞ্চলটির কিছু প্রদেশ কন্সতানিনোপল থেকে প্রায় সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে চলতে থাকে।

১০৫৪ সালে যখন খ্রিস্টান গির্জা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পূর্ব ও পশ্চিম গির্জায় ভাগ হয়ে যায়, তখন দক্ষিণ আলবেনিয়া পূর্ব বা অর্থডক্স গির্জার সাথে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখে। অন্যদিকে উত্তর আলবেনিয়া রোমের রোমান ক্যাথলিক গির্জার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। মধ্যযুগে (৫ম থেকে ১৫শ শতক) আলবেনিয়ার শহরগুলির প্রসার ঘটে এবং বাণিজ্যেরও উন্নতি হয়, বিশেষ করে আড্রিয়াটিক অঞ্চলে। শহরের উন্নতির সাথে সাথে শিল্পকলা, সংস্কৃতি, এবং শিক্ষারও উন্নতি ঘটে। আলবেনীয় ভাষা বেঁচে থাকলেও গির্জা, সরকার ও শিক্ষাব্যবস্থায় এটির ব্যবহার ছিল না। বরং গ্রিক ও লাতিন ভাষাই সাহিত্য ও সংস্কৃতির সরকারি ভাষা হিসেবে থেকে যায়।

উসমানীয়দের বিজয়
১৩৪৭ সালে স্তেফান দুসানের অধীনে সার্বীয়রা আলবেনিয়া দখল করলে আলবেনীয়রা গণহারে গ্রিসে পালিয়ে যায়। ১৪শ শতকের মাঝামাঝি সময়েই বাইজেন্টীয় শাসনের পতন ঘটে এবং বর্তমান তুরস্ক-অঞ্চলভিত্তিক উসমানীয়রা ১৩৮৮ সালে আলবেনিয়া আক্রমণ করে। ১৪৩০ সালের মধ্যেই উসমানীয়রা আলবেনিয়া বিজয়ে সক্ষম হয়। কিন্তু ১৪৪০-এর দশকে গিয়ের্গি কাস্ত্রিওতি দেশটির জমিদারদের একত্রিত ও সংগঠিত করে উসমানীয়দের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। রোম, নাপোলি, এবং ভেনিসের সামরিক সাহায্য নিয়ে কাস্ত্রিওতি প্রায় ২৫ বছর সফলভাবে উসমানীয়দের ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর আলেবেনিয়ার প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে এবং ১৫০৬ সালে উসমানীয়রা পুনরায় আলবেনিয়া দখলে সক্ষম হয়। দেশটির জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ লোক ইতালি, সিসিলি, এবং আড্রিয়াটিক সাগরের ডালমেশীয় উপকূলে পালিয়ে যায়। কাস্ত্রিওতি তথা স্কেন্দারবেগকে আজও আলবেনীয়রা তাদের জাতীয় ঐক্য ও স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে পরম শ্রদ্ধা করে।

উসমানীয়রা চার শতাব্দী ধরে শাসন করলেও সম্পূর্ণ আলবেনিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে কখনোই সক্ষম হয়নি। উচ্চভূমি অঞ্চলে উসমানীয়দের নিয়ন্ত্রণ ছিল দুর্বল; সেখানকার আলবেনীয়রা কর প্রদানে এবং সামরিক সেবায় অংশ নিতে অসম্মতি প্রকাশ করত। আলবেনীয়রা অনেকগুলি বিদ্রোহে অংশ নেয়; খ্রিস্টধর্মের উপর বিশ্বাস রক্ষা করা এগুলির পেছনে আংশিক কারণ হিসেবে কাজ করেছিল। ১৬শ শতকের শেষে উসমানীয়রা ভবিষ্যৎ বিদ্রোহ প্রতিরোধের লক্ষ্যে আলবেনীয়দের ইসলামীকরণের নীতি গ্রহণ করে। ১৭শ শতকের মাঝামাঝি আলবেনীয় জনগণের দুই-তৃতীয়াংশ ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়। অনেকেই খ্রিস্টানদের উপর ধার্য অতিরিক্ত করের বোঝা এড়াতেই এমনটি করে। উসমানীয়রা একটি সামন্ত-সামরিক মিশ্র ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণ সম্প্রসারিত করে; এই ব্যবস্থায় যেসব সামরিক নেতারা সাম্রাজ্যের অণুগত ছিলেন, তারা জমিদারি লাভ করতেন।

১৮শ শতকে উসমানীয় ক্ষমতার ক্ষয় ঘটতে শুরু করে এবং ফলে আলবেনিয়ার কিছু সামরিক নেতার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৭৫০ থেকে ১৮৩১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে উত্তর আলবেনিয়ার অধিকাংশ এলাকা ছিল বুশাতি পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। অন্যদিকে আলি পাশা তেপেলিন ১৭৮৮ থেকে ১৮২২ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আলবেনিয়া ও উত্তর গ্রিস নিয়ন্ত্রণ করেন। এই স্থানীয় শাসকেরা নিজেদের আলাদা রাজ্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু উসমানীয় সুলতান ২য় মাহমুদ তাদেরকে পরাজিত করেন। ১৮শ ও ১৯শ শতকে অনেক আলবেনীয় উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রশাসনে উচ্চপর্যায়ে অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়। দুই ডজনেরও বেশি আলবেনীয় বংশোদ্ভূত লোক উসমানীয় সুলতানের প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন।

আলবেনিয়ার স্বাধীনতা
১৯শ শতকে বলকান অঞ্চলের অনেক পরাধীন মানুষ নিজেদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। ১৮৭৮ সালে আলবেনীয় নেতারা কসভোর প্রিজরেন শহরে মিলিত হন এবং প্রিজরেনের লিগ তথা আলবেনীয় লিগ গঠন করেন। লিগের উদ্দেশ্য ছিল সমস্ত আলবেনীয় অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে একটি একত্রিত আলবেনিয়া গঠন। লিগ আলবেনীয় ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নেরও লক্ষ্য হাতে নেয়। ১৯০৮ সালে আলবেনীয় নেতারা লাতিন লিপির উপর ভিত্তি করে একটি জাতীয় বর্ণমালা প্রবর্তন করেন। ১৯১০ থেকে ১৯১২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে আলবেনীয় জাতীয়তাবাদীরা উসমানীয়দের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। প্রথম বলকান যুদ্ধ নামে পরিচিত এই যুদ্ধে সার্ব, গ্রিক ও বুলগেরীয় সেনারাও যোগ দেয় এবং উসমানীয়রা এতে পরাজয় বরণ করে। যুদ্ধ শেষ হবার পর পরই আলবেনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। যুদ্ধের পর যুক্তরাজ্য, জার্মানি, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স ও ইতালি (মহাশক্তিসমূহ) একটি সম্মেলনে আলবেনিয়ার স্বাধীনতা মেনে নেয়, কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলির প্রবল চাপের মুখে তারা আলবেনীয় অধ্যুষিত কসোভো অঞ্চলটি সার্বিয়াকে এবং কামেরিয়া অঞ্চলটির অধিকাংশ গ্রিসকে দিয়ে দেয়। এর ফলে আলবেনীয় জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই সদ্যপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের সীমানার বাইরে পড়ে যায়। মহাশক্তি রাষ্ট্রগুলি একজন জার্মান রাজপুত্র ভিলহেল্ম ৎসু ভিডকে আলবেনিয়ার শাসক নিয়োগ করে, কিন্তু তিনি মাত্র ছয় মাস ক্ষমতায় ছিলেন। এর পরই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এসময় অস্ট্রীয়, ফরাসি, ইতালীয়, গ্রিক, মন্টেনেগ্রীয় এবং সার্বীয় সেনারা আলবেনিয়া দখল করে। দেশটিতে রাজনৈতিক নেতৃত্বহীনতা দেখা দেয়। বিশ্বযুদ্ধের পরে প্যারিস শান্তি সম্মেলনে মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন আলবেনিয়াকে ভাগ করে তার প্রতিবেশিদের দিয়ে দিয়ে দেবার ব্রিটিশ-ফরাসি-ইতালীয় পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ভেটো দেন। ১৯২০ সালে আলবেনিয়াকে সদ্য সংগঠিত লিগ অফ নেশন্‌স-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়, ফলে দেশটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে।

১৯২০-এর দশকে আলবেনিয়ার জনগণ দুইটি বিরুদ্ধ রাজনৈতিক শক্তির অধীনে গভীরভাবে দ্বিধাভক্ত ছিল। আহমেদ বেই জোগুর নেতৃত্বে জমিদার ও গোত্রপ্রধানদের একটি রক্ষণশীল শ্রেণী অতীতের সমাজকাঠামো ধরে রাখতে চাচ্ছিল। অন্যদিকে উদারপন্থী বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, ও ব্যবসায়ীরা আলবেনিয়ার আধুনিকীকরণ চেয়েছিলেন। উদারপন্থীদের নেতৃত্বে ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাপ্রাপ্ত অর্থডক্স গির্জার বিশপ ফান নোলি। ১৯২৪ সালে রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে এক গণবিপ্লবের ফলে জোগু ইউগোস্লাভিয়াতে পালিয়ে যান। নোলি নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন এবং পশ্চিমা ধাঁচের একটি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মন দেন। কিন্তু মাত্র ছয় মাসের মাথায়, আন্তর্জাতিক সমর্থনের অভাবে ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার হয়ে নোলি ক্ষমতাচ্যুত হন ও জোগু ইউগোস্লাভিয়ার সহায়তায় আবার ক্ষমতায় আসেন। জোগু এরপর ১৪ বছর শাসন করেন। প্রথমে রাষ্ট্রপতি হিসেবে (১৯২৫-১৯২৮) এবং তারপর রাজা প্রথম জোগ হিসেবে (১৯২৮-১৯৩৯)। জোগের স্বৈরশাসনে আলবেনিয়ার অর্থনীতি ছিল স্থবির, তবে তিনি আলবেনিয়াতে একটি আধুনিক স্কুল ব্যবস্থা দিয়ে যান এবং দেশটিতে স্থিতিশীলতা আনেন। কিন্তু ভূমি সংস্কারের সমস্যা সমাধানে তিনি ব্যর্থ হন এবং কৃষকেরা দরিদ্র থেকে যায়।

জোগের শাসনের সময় আলবেনিয়ার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ইতালির এতটাই প্রভাব ছিল যে এ সময় আলবেনিয়া দৃশ্যত ইতালির একটি প্রদেশে পরিণত হয়। ১৯৩৯ সালের এপ্রিলে ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার সামান্য আগে ইতালি আলবেনিয়া আক্রমণ ও দখল করে। জোগ পালিয়ে গ্রিসে চলে যান। ১৯৪১ সালে নাৎসি জার্মানি ইউগোস্লাভিয়া ও গ্রিসকে পরাজিত করলে কসোভো ও কামেরিয়াকে ঐ দেশগুলি থেকে নিয়ে আলবেনিয়ার সাথে যুক্ত করা হয়। এই যুদ্ধকালীন আলবেনিয়া ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত ইতালির অধীনে ছিল। এরপর জার্মান সেনারা এর নিয়ন্ত্রণ নেয়। ১৯৪৪ সালের নভেম্বরে জার্মানরা পিছু হটে গেলে এই যুদ্ধকালীন রাষ্ট্রের পতন ঘটে। কসোভোকে সার্বিয়ার কাছে এবং কামেরিয়াকে গ্রিসের কাছে ফেরত দিয়ে দেয়া হয়।

সাম্যবাদী শাসন
যুদ্ধের সময় জাতীয়তাবাদী, রাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদীরা আলবেনিয়াতে সক্রিয়ভাবে ইতালীয়, জার্মান, ও আলেবেনীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়েছিল। সাম্যবাদীরা শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়, এবং ১৯৪৪ সালের নভেম্বর মাসে তারা আলবেনিয়ার ক্ষমতা দখল করে। এ ব্যাপারে তারা ইউগোস্লাভিয়ার সাম্যবাদীদের সাহায্য নেয়। সাম্যবাদী দলের মহাসচিব এনভার হোক্সহা দেশের নতুন নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। দরিদ্র কৃষক এবং কিছু বুদ্ধিজীবীর সাহায্য নিয়ে সাম্যবাদী দল একটি আমূল সংস্কার প্রকল্প হাতে নেয় যা জমিদারদের ক্ষমতা নষ্ট করে দেয় এবং শিল্প, ব্যাংক, এবং বাণিজ্যিক সম্পত্তি জাতীয়তাকরণ করা হয়। এভাবে সাম্যবাদীরা তাদের শাসন শক্ত করে এবং রাষ্ট্রশাসিত একটি সমাজবাদী সমাজ গঠন করে। সোভিয়েত রাশিয়াতে স্তালিনের শুরু করা মডেল অণুসরণে কৃষির সমবায়ীকরণ করা হয়, এবং ১৯৬৭ সাল নাগাদ প্রায় সব কৃষক এই প্রকল্পের আওতায় আসে। হোক্সহার সরকার উত্তরের উচ্চভূমিতে শক্ত নিয়ন্ত্রণ স্থাপনে সক্ষম হয় এবং ঐতিহ্যবাহী পিতৃতান্ত্রিক বংশ ও গোত্রের প্রধানদের ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। নতুন শাসনব্যবস্থায় আইনের চোখে নারীরা পুরুষদের সমমর্যাদা লাভ করে।

শুরুর দিকে আলবেনিয়া আর্থিক ও সামরিক সাহায্যের জন্য ইউগোস্লাভিয়ার উপর নির্ভর করত। কিন্তু দেশটি ইউগোস্লাভিয়ার রাজনৈতিক আগ্রাসনের ব্যাপারে ভীত ছিল। ১৯৪৮ সালে যখন স্তালিন ইউগোস্লাভিয়াকে সাম্যবাদী ব্লক থেকে আদর্শগত কারণে বহিস্কার করেন, আলবেনিয়া স্তালিনকে সমর্থন দেয়। হোক্সহা আলবেনিয়ার ইউগোস্লাভ-সমর্থক দলগুলিকে নিষিদ্ধ করেন। এই দলগুলির নেতৃত্বে ছিল কোসি খোখে, হোক্সহার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। তবে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন ১৯৬০-এর দশকের শুরুর দিকে বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে প্রতিদ্বন্দ্বীর ভূমিকায় লিপ্ত হয়। আলবেনিয়া চীনকে সমর্থন দেয়, কেননা হোহক্সা চীনের আদর্শকে বেশি খাঁটি বলে মনে করতেন। হোহক্সা অন্যান্য সাম্যবাদী বন্ধু দেশের প্রতিও আস্থা হারিয়ে ফেলেন। তিনি তাদের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ত্যাগ করার পুঁজিবাদী পশ্চিমের সাথে হাত মেলানোর অভিযোগ করেন। ১৯৬১ সালে আলবেনিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। যে সোভিয়েত সাহায্য ও কারগরি সহায়তা নিয়ে আলবেনিয়াতে আধুনিক শিল্প ও কৃষির ভিত্তি গড়ে উঠেছিল এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান বেড়ে গিয়েছিল, সেগুলি বন্ধ হয়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের জায়গায় চীন আলবেনিয়ার প্রধান বাণিজ্য অংশীদার ও অর্থনৈতিক সাহায্যদাতায় পরিণত হয়।

১৯৬০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত আলবেনিয়া বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ১৯৬৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন চেকোস্লোভাকিয়া দখল করলে আলবেনিয়া নিজেকে রক্ষার জন্য পার্শ্ববর্তী ইউরোপীয় দেশগুলির সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করে এবং সোভিয়েত-নেতৃত্বাধীন ওয়ারশ চুক্তি থেকে সরে আসে। ১৯৭০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের আঁতাতের প্রেক্ষিতে চীনের সাথে আলবেনিয়ার সম্পর্ক খারাপের দিকে মোড় নেয়। ১৯৭৮ সালে চীন আলবেনিয়ার সাথে বাণিজ্য চুক্তি ও সাহায্য রদ করে দেয়। আলবেনিয়া এরপর ইউরোপের সাথে ঘনিষ্ঠতর অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চালায়। কিন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে ১৯৯০-এর দশকের শুরু পর্যন্তও আলবেনিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন একটি রাষ্ট্র ছিল।

হোক্সহার অধীনে রাজনৈতিক নিপীড়নের পরিমাণ ছিল ভয়াবহ। বিরুদ্ধ মত দূর করার জন্য সাম্যবাদী দল বাদে বাকী সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সাম্যবাদী দলের অভ্যন্তরীণ বিরুদ্ধবাদীদেরও পর্যায়ক্রমিকভাবে নিষ্ক্রিয় করা হয়। হাজার হাজার লোককে চাকুরিচ্যুত করা হয়, শ্রম ক্যাম্পে অন্তরীণ করা হয়, কিংবা মেরে ফেলা হয়। সমস্ত সরকারি সংস্থার উপর সেন্সরশিপ জারি করা হয়। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক সিগুরিমি সব লোকের উপর নজরদারি করত এবং যেকোন ধরনের বিদ্রোহ দেখলেই তা দমন করত। ১৯৬৭ সালে সমস্ত ধর্মীয় সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয়, খ্রিস্টান ও মুসলিম ধর্মালয়গুলির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং দেশটিকে বিশ্বের প্রথম নাস্তিক রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়।

শাসক দলের মধ্যেই বিরোধিতার আভাস দেখা দেয়। ১৯৮১ সালে প্রধানমন্ত্রী মেহমেট শেহু অজানা রহস্যময় কারণে মারা যান। ধারণা করা হয় তিনি হোক্সহাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পাঁয়তারা করছিলেন। ১৯৮৩ সালে সিগুরিমি বেশ কয়েকজন দলীয় কর্মকর্তাকে ফাঁসি দেন। ১৯৮৫ সালের এপ্রিলে হোক্সহা মারা গেলে দলের প্রথম সচিব রামিজ আলিয়া তার পদে আসেন। আলিয়া সাম্যবাদী ব্যবস্থা বজায় রেখে অবনতিশীল অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য সংস্কারকাজ উপস্থাপন করেন।

গণতন্ত্রের শুরু
১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপে যখন সাম্যবাদী শাসনের অবসান ঘটে, তখন কিছু কিছু আলবেনীয় আরও সুদূরপ্রসারী সংস্কারের দাবী তোলেন। এদের মধ্যে ছিলেন বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক শ্রেণীর সদস্য, এবং অসন্তুষ্ট তরুণেরা। বর্ধমান অশান্তি ও গণবিক্ষোভের মুখে আলিয়া ধর্মীয় স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনেন, সিগুরিমির ক্ষমতা খর্ব করেন এবং কিছু বাজার সংস্কার ও অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ হাতে নেন। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে সরকার স্বাধীন রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি বৈধ ঘোষণা করে, ফলে রাজনীতিতে সাম্যবাদী দলের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ শেষ হয়। বিচার ব্যবস্থা সংস্কার করে আইন মন্ত্রণালয় তৈরি করা হয় এবং মৃত্যুদণ্ডের পরিমাণ হ্রাস করা হয়। আলবেনীয়দের বিদেশ গমনের অণুমতি দেয়া হয়। ১৯৯০ সালে হাজার হাজার আলবেনীয় পশ্চিমা দেশগুলির দূতাবাসের মাধ্যমে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ৫০০০ আলবেনীয়কে নিরাপদে সরিয়ে নিতে বহুদেশীয় ত্রাণ অপারেশন হাতে নেওয়া হয়। আরও ২০ হাজার আলবেনীয় নৌকায় করে অবৈধভাবে ইতালিতে পাড়ি জমায়।

একই সময়ে আলবেনিয়াতে গণপ্রতিবাদ চলতে থাকে। ফলে সরকার ও সাম্যবাদী দল থেকে অনেক চরম সাম্যবাদী নেতাকে বহিস্কার করা হয়। ১৯৯১ সালের এক মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে অনেকে নিহত হয়। মার্চে সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। একই মাসে আইনসভার জন্য বহুদলীয় নির্বাচন অণুষ্ঠিত হয়। সাম্যবাদী দল ও তাদের মিত্ররা ২৫০টি আসনের মধ্যে ১৬৯টি আসন জেতে। অন্যদিকে নবগঠিত ডেমোক্র‌্যাট দল ৭৫টি আসন জেতে। সাম্যবাদীদের বিজয়ের পর আরেক দফা বিক্ষোভ শুরু হয়। এবার শকোডার শহরে পুলিশের গুলিতে চার জন মারা যায়।

১৯৯১ সালের এপ্রিলে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান পাস করা হয় এবং দেশের নাম গণপ্রজাতন্ত্রী আলবেনিয়ার পরিবর্তে আলবেনিয়া প্রজাতন্ত্র রাখা হয়। আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্যবাদীরা আলিয়াকে নব্যসৃষ্ট রাষ্ট্রপতি পদে বসায় এবং অর্থনীতিবিদ ফাতোস নানো প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু হাজার হাজার শ্রমিকের সাধারণ ধর্মঘটের মুখে এই সরকার পদত্যাগ করেন এবং জুনে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করা হয়। এতে সাম্যবাদী, গণতন্ত্রী, প্রজাতন্ত্রী এবং সামাজিক গণতন্ত্রীরা অন্তর্ভুক্ত হন। কিন্তু রাস্তায় মিছিল চলতে থাকে এবং প্রতিবাদকারীরা প্রাক্তন সাম্যবাদী নেতাদের গ্রেপ্তার ও গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবী করতে থাকে। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে কোয়ালিশন সরকারের পতন ঘটে এবং একটী অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৯২ সালের মার্চে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে গণতন্ত্রীরা আইনসভার ১৪০টি আসনের মধ্যে ৯২টিতে বিজয়ী হয়। সমাজবাদীরা ৩৮টি, সমাজবাদী গণতন্ত্রীরা ৭টি এবং গ্রিক সংখ্যালঘু একতা দল ২টি আসন জেতে। আইনসভা গণতন্ত্রী দলের নেতা সালি বেরিশাকে রাষ্ট্রপতি বানায় এবং বেরিশা আলেক্সান্দর মেক্‌সিকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন। বেরিশার অধীনে বেশ কিছু প্রাক্তন সাম্যবাদী কর্মকর্তাকে, যাদের মধ্যে আলিয়া ও নানো-ও ছিলেন, গ্রেপ্তার করা হয়। তাদেরকে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির দায়ে বিচার করা হয় এবং দীর্ঘমেয়াদের শাস্তি দেয়া হয়। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন এই বিচারগুলি ন্যায়বিচার ছিল না, বরং বেরিশা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্ব্বীদের সরিয়ে ফেলতে এগুলি ব্যবহার করেন। আলিয়া ও নানো উভয়েই কয়েক বছরের মধ্যেই ছাড়া পান। ১৯৯৪ সালের নভেম্বরে গণতন্ত্রীরা একটি নতুন সংবিধান প্রস্তাব করে কিন্তু জনগণ একটি গণভোটে তা প্রত্যাখ্যান করেন। বিরোধীরা বলে যে এই প্রস্তাবটিতে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপতির হাতে আরও ক্ষমতা কুক্ষিগত করত। রাষ্ট্রপতিকে স্বৈরাচারী আখ্যা দেয়া হয় এই বলে যে তিনি প্রেসের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, প্রাক্তন সাম্যবাদী নেতাদের জুলুম এবং আদালতসমূহ নিয়ন্ত্রণ করেছেন। সরকারের সমর্থকেরা পাল্টা দাবি করে যে সমাজবাদীরা দেশের নতুন গণতন্ত্র বানচাল করে দিতে চাচ্ছে।

প্রাক্তন ইউগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রগুলির সাথে সম্পর্কও খারাপের দিকে মোড় নেয়, বিশেষ করে সার্বীয় প্রদেশ কসোভোর সংখাগরিষ্ঠ আলবেনীয় জনগণের উপর নিপীড়ন প্রসঙ্গে। ১৯৮৯ সালে সার্বিয়া কসভোর স্বায়ত্বশাসন রদ করে এবং ১৯৯১ সালে কসভোর আলবেনীয় নেতারা প্রদেশটির স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে কসোভো স্বীকৃতি পায়নি, আলবেনিয়া কসোভোকে সমর্থন দেয় এবং জাতিসংঘকে প্রদেশটিতে পর্যবেক্ষক পাঠাতে অণুরোধ জানায়। কিন্তু জাতিসংঘ এই অনুরোধে সাড়া দেয়নি। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি আলবেনিয়া ভয় করতে শুরু করে যে অশান্ত কসোভোতে সামরিক ধরপাকড় শুরু হবে এবং বহু লোক উদ্বাস্তু হয়ে গোটা বলকান অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলবে। এছাড়া ম্যাসিডোনিয়াতে আলবেনীয় সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারেও আলবেনিয়া উদ্বেগ প্রকাশ করে।

১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি আলবেনিয়াতে সাধারণ নির্বাচন অণুষ্ঠিত হয়, কিন্তু রাষ্ট্রপতি সালি বেরিশার গণতন্ত্রী দল বিজয় লাভ করলেও তাদের বিরুদ্ধে কারচুপির অভিযোগ আনা হয়। বিরোধী দলগুলি সংসদ বর্জন করে। ১৯৯৭ সালে এই সংসদ বেরিশাকে আরও ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত করে। ১৯৯৭ সালের শুরুতে অনেকগুলি জাল বিনিয়োগ স্কিম ধরা পড়ে, যাতে হাজার হাজার আলবেনীয় তাদের সঞ্চয় হারান। সরকার বহু বিনিয়গকারীকে আংশিক ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিলেও অর্থনীতিতে বিপর্যয় ও রাজনৈতিক স্ক্যান্ডালের প্রেক্ষিতে আলবেনীয়রা প্রথমে বিভিন্ন শহরে প্রতিবাদ শুরু করে ও পরে সেগুলি রায়টে রূপ নেয়। ১৯৯৭ সালের মার্চের মধ্যে দেহসব্যাপী বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশের অনেক অংশে প্রশাসন বিকল হয়ে যায়। দেশের দক্ষিণাংশ, বিশেষ করে ভলোরে এবং সারান্দে শহর, স্থানীয় মিলিশিয়া বাহিনী ও সশস্ত্র নাগরিকেরা লুটেরাদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা নিজেদের হাতে তুলে নেন।

দেশব্যাপী গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দেয় এবং রাষ্ট্রপতি বেরিশা একটি অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠন করেন, যার প্রধান ছিলেন সমাজবাদী বাশকিম ফানো। বেরিশা জুনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেন এবং তার দল হেরে গেলে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগের প্রতিশ্রুতি দেন। নতুন সরকার দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য কামনা করে। তবে ইতালীয় কমান্ডারের অধীনে আগত বহুজাতিক বাহিনীটিকে কেবল আলবেনিয়ার দুর্গম এলাকাগুলিতে ত্রাণ সরবরাহেই কাজে লাগানো হয়।

১৯৯৭ সালের জুনের নির্বাচনে সমাজবাদীরা ৬৫% ভোট পেয়ে ক্ষমতায় আসে। বেরিশা জুলাইয়ে পদত্যাগ করেন। কারাগার থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত নেতা ফাতোস নানো প্রধানমন্ত্রী হন। রেক্সহেপ মেজদানী নামের আরেকজন সমাজবাদী নেতাকে রাষ্ট্রপতি পদ দেওয়া হয়। গণতন্ত্রীরা ১৯৯৮ সালের মার্চ পর্যন্ত সংসদ বয়কট করেন। ১৯৯৭ সালের আগস্টে সরকার ঘোষণা দেন যে ভলোরে শহরে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সেই মাসেই বহুজাতিক বাহিনী আলবেনিয়া ত্যাগ করে। ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী নানো কোয়ালিশন সরকারের সাথে মন্ত্রীসভায় পরিবর্তনের ব্যাপারে মতভেদের কারণে পদত্যাগ করেন। পান্ডেলি মাজকো নামের একজন সমাজবাদী নেতাকে প্রধানমন্ত্রী বানানো হয়। কসোভোতে জাতিগত আলবেনীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বহু সার্বীয় পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করলে এর জের ধরে ১৯৯৮ সালের শুরুতে তৎকালীন ইউগোস্লাভিয়ার (বর্তমান সার্বিয়া ও মন্টেনিগ্রো) সাথে আলবেনিয়ার সম্পর্ক খারাপের দিকে মোড় নেয়। সার্বীয় পুলিশ ও ইউগোস্লাভ সেনাবাহিনীর দল কসোভোর সাধারণ জনগণের উপর হামলা করে এবং ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালের শুরুর অধিকাংশ সময় জুড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী কসভো মুক্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে। ইউগোস্লাভিয়া কসোভোর ব্যাপারে শান্তিচুক্তিতে আসতে অসম্মতি জানালে ১৯৯৯ সালের মার্চে ন্যাটো ইউগোস্লাভ সামরিক স্থাপনাগুলিতে বিমান হামলা চালানো শুরু করে। এর জবাবে সার্বীয় সেনারা কসোভোর গ্রামগুলিতে আরও বেশি আক্রমণ শুরু করে, ফলে লাখ লাখ লোক নিজেদের বাসস্থান ছেড়ে চলে যায়। ১৯৯৮ সাল থেকেই আলবেনিয়া কসোভো-আগত উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিয়ে আসছিল, কিন্তু ১৯৯৯- এর বিমান হামলার ফলে উদ্বাস্তুর ঢেউ সামলাতে আলবেনিয়া হিমশিম খেয়ে যায়। দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতিতে চাপের সৃষ্টি হয়। জুন মাসের মধ্যেই প্রায় সাড়ে চার লাখ কসোভোবাসী আলবেনিয়াতে আশ্রয় নেয়। ঐ মাসেই ইউগোস্লাভ সরকার একটি আন্তর্জাতিক শান্তি চুক্তিতে সম্মত হয়। চুক্তির শর্ত অনুসারে কসোভোতে একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনী স্থাপন করা হয় যাতে উদ্বাস্তুরা নিরাপদে দেশে ফিরে আসতে পারে।

সাম্প্রতিক ঘটনাবলি
১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসে মাজকো সাম্যবাদী দলের অভ্যন্তরীণ আস্থা হারিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অবসর নেন। তার স্থানে আসেন ইলির মেতা, একজন তরুণ ও সংস্কারপন্থী নেতা। মেতা মাজকো সরকারের নীতি ধরে রাখার ব্যাপারে শপথ করেন; এই নীতিগুলির মধ্যে ছিল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও নেটোতে আলবেনিয়ার সদস্যপদ প্রাপ্তির ব্যাপারে কাজ করা। ২০০১ সালের জুন মাসে অণুষ্ঠিত সংসদীয় নির্বাচনে সমাজতান্ত্রিক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখে।

কিন্তু ২০০২ সালের জানুয়ারি মাসে ফাতোস নানোর সাথে তিক্ত বিবাদের জের ধরে মেতা হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে অবসর নেন। সমাজতান্ত্রিক দলও এতে দুই ভাগ হয়ে যায়। নানো মেতার সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনেন এবং মন্ত্রীসভাতে আমূল পরিবর্তন আনতে বলেন। মেতার পদত্যাগের পর পরই গণতন্ত্রী দলের সদস্যরা সাত মাসের বয়কট শেষ করে সংসদে ফেরত আসেন।

২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সমাজতান্ত্রিক দলের নেতারা মাজকোকে মেতার উত্তরসূরী হিসেবে নির্বাচিত করেন এবং জুন মাসে সংসদ বিদায়ী রেক্সহেপ মেজদানির স্থলে আলফ্রেড মোইসিউ-কে রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ দেয়। মোইসিউ একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল এবং প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। তিনি জুলাই মাসে পদ গ্রহণ করেন। একই মাসে মাজকোকে সরিয়ে নানো প্রধানমন্ত্রী হন। নতুন মন্ত্রীসভা গঠন করা হয় এবং আশা করা হয় সেটি সমাজতান্ত্রিক দলের অন্তর্কোন্দল বন্ধ করবে।

রাজনীতি
আলবেনিয়ার রাজনীতি সংসদীয় প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের কাঠামোয় পরিচালিত হয়। প্রধানমন্ত্রী সরকার ও একটি বহু-দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রধান। নির্বাহী ক্ষমতা সরকারের হাতে এবং আইন প্রণয়ন ক্ষমতা সরকার ও আইনসভা উভয়ের হাতে ন্যস্ত। আলবেনিয়ার আইনসভার নাম Kuvendi i Republikës së Shqipërisë। ১৯৯১ সাল থেকে দেশটিতে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রচলিত। তবে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ আলবেনিয়া এবং সোশালিস্ট পার্টি অফ আলবেনিয়া নামের দুইটি দল আলবেনিয়ার রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে।

প্রশাসনিক অঞ্চলসমূহ (প্রতিরক্ষা বাহিনী)
দেশটি ১৯৮৮ সালের ৬৫ হাজার সেনাসদস্য থেকে ২০০৯ সালে এ সংখ্যা নামিয়ে নিয়ে আসে ১৪ হাজার ৫০০-তে। ১৯৯০ সালে পুরনো বেশ কিছু অস্ত্র তারা ধ্বংস করে। ২০০৮ সালে দেশটি তার জিডিপি’র ২.৭ শতাংশ এ খাতে খরচ করেছিল। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে দেশটি ন্যাটোর সাথে কাজ করতে শুরু করে।

ভূগোল
আলবেনিয়ার এক-তৃতীয়াংশের বেশি অংশজুড়ে আছে বনাঞ্চল। আর এর আয়তন হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার।[৭] এই পুরো অংশটিই বেশ ঘন বনে আচ্ছাদিত। আলবেনিয়ায় তিন হাজারের অধিক প্রজাতির গাছ পাওয়া গেছে। এগুলোর অনেকগুলোই ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। মধ্যসাগরীয় শান্ত জলবায়ুই এখানে বিরাজ করে থাকে। আলবেনিয়ার শীতকালটি তুলনামূলক উষ্ণ এবং রৌদ্রময়। আর গ্রীষ্মকাল সাধারণত অধিকতর শুষ্ক থাকে। যদিও অন্যান্য অংশের আবহাওয়া ঋতুর ওপর নির্ভর করে কিন্তু দেশটির এক হাজার ৫০০ মিটার ওপরের এলাকাগুলোতে শীতকালসহ বেশির ভাগ সময়েই তীব্র শীত অণুভূত হয়, অবিরাম তুষারপাতও দেখা যায় সেখানে। দেশের নিম্নাঞ্চল ও নদী তীরবর্র্তী এলাকাগুলোতে দুপুরে তাপমাত্রা অনেক বেড়ে গেলেও রাতে সবসময়ই শীতল থাকে।

অর্থনীতি
আলবেনিয়া একটি দরিদ্র দেশ। বর্তমানে মুক্তবাজার অর্থনীতির সুবাদে দেশটি নতুন নতুন ব্যবসা খুলে নিজের অর্থনীতি চাঙ্গা করার দিকে এগোচ্ছে। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের হিসাব অণুযায়ী ২০১০ সালে এর প্রবৃদ্ধি হবে ২.৬ শতাংশ, যা ২০১১ সালে গিয়ে দাঁড়াবে ৩.২ শতাংশে। আলবেনিয়াতে এখন বিনিয়োগ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। আলবেনিয়া ও ক্রোশিয়া মিলিতভাবে মন্টেনেগ্রোর সীমান্তে একটি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি ইতালীয় কোম্পানি আলবেনিয়াতে ৮০০ মেগাওয়াট শক্তিসম্পন্ন কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা দেয়। আর এগুলোর সাহায্যে আলবেনিয়া তার রফতানি খাতে বিদ্যুৎকে যুক্ত করতে চাইছে। দেশটিতে পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাসের খনি রয়েছে। তবে এখানে দৈনিক তেল উৎপাদনের হারটি বেশ কম। মাত্র ছয় হাজার ৪২৫ ব্যারেল। তবে প্রাকৃতিক গ্যাসের যে মজুদের খবর পাওয়া গেছে তাতে দেশের জনগণের চাহিদা আপাতত মিটে যাওয়ার কথা। এর বাইরে দেশটিতে কয়লা, বক্সাইট, কপার এবং লোহার খনি রয়েছে। আলবেনিয়ার অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে কৃষিরও। এ খাতে দেশটির ৫৮ শতাংশ লোক নিয়োজিত আর তা জিডিপিতে অবদান রাখছে ২১ শতাংশ । আলবেনিয়ার গম, ভুট্টা, তামাক, ডুমুর এবং জলপাইয়ের উৎপাদন মোটামুটি আলোচনায় আসার মতো।

যোগাযোগ ব্যবস্থা
দেশটির সার্বিক যোগাযোগব্যবস্থা খুব একটা ভালো নয়। সড়ক, রেল ও বিমান সব দিক দিয়েই যোগাযোগব্যবস্থায় ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে অনেকটাই পিছিয়ে আছে তারা। তবে সম্প্রতি দেশটির সরকার কসভো, মেসিডোনিয়া, বুলগেরিয়া, ক্রোশিয়া ও গ্রিসের সাথে সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে মনোযোগ দিয়েছে। এ প্রকল্পগুলো সম্পন্ন হলে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে আলবেনিয়ার ৭৫৯ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক তৈরি হবে। এরই পাশাপাশি দেশটির অভ্যন্তরীণ সড়ক উন্নয়নেরও ব্যবস্থা নিচ্ছে।

জনসংখ্যা
জানুয়ারী ২০১০-এর উপাত্ত অনুযায়ী আলবেনিয়ার জনসংখ্যা ৩১,৯৫,০০০। বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ০.৫৪৬%। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে জনবসতির ঘনত্ব ১১১ জন। মাত্র ৩৫ লাখ লোকের দেশ আলবেনিয়ায় শতকরা ৯৫% শতাংশ লোক আলবেনীয় ভাষার কোন উপভাষায় (তোস্ক বা ঘেগ) কথা বলে থাকে। আলবেনীয়ার বাকী জনগণ সবচেয়ে বেশি যে ভাষায় কথা বলে, তা হল গ্রিক। এছাড়া ম্যাসিডোনীয় ভাষা ও সার্বো-ক্রোটীয় ভাষাতেও স্বল্পসংখ্যক লোক কথা বলেন। যাদের মাতৃভাষা আলবেনীয়, তারা মূলত দুইটি উপভাষার একটিতে কথা বলেন। এগুলি হল উত্তরের ঘেগ আলবেনীয় এবং দক্ষিণের তোস্ক আলবেনীয়। তোস্ক আলবেনীয় উপভাষা উপর ভিত্তি করে আদর্শ আলবেনীয় ভাষা গঠিত হয়েছে। আলবেনিয়ার বাইরে ম্যাসিডোনিয়া ও কসোভোতেও আলবেনীয় ভাষার প্রচলন আছে। ১৯৯০-এর দশকে যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধের সময় প্রায় ৫ লক্ষ আলবেনীয়ভাষী কসোভোবাসী আলবেনিয়াতে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নেন। আলবেনিয়ার গণমাধ্যমের ভাষা আলবেনীয়। তবে রেডিও তারানা আটটি ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। এছাড়া অনেক আলবেনীয় স্যাটেলাইটের সাহায্যে ইতালীয় ও গ্রিক টিভির অনুষ্ঠান দেখে থাকেন।

ভাষা
আলবেনিয়ার সরকারি ভাষা আলবেনিয়ান। গেগ ও তোস্কের মিলিত রূপই হচ্ছে আলবেনিয়ান ভাষা। এখানে সংখ্যালঘু গ্রিকদের ভাষাও বেশ প্রচলিত। এর পাশাপাশি সার্বিয়ান, মেসিডোনিয়ান, রোমানি এবং অ্যারোমেনিয়ান ভাষা দেশটিতে চালু আছে।

ধর্ম
সরকারিভাবে আলবেনিয়ার জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুকের দেয়া তথ্য মতে, দেশটিতে ৭০ শতাংশ মুসলিম, ২০ শতাংশ অর্থোডক্স এবং ১০ শতাংশ রোমান ক্যাথলিক মানুষ রয়েছে। ১১ শতকের সময়ের প্রথম যে ইতিহাস পাওয়া যায় তখন এ আলবেনিয়া পুরোটাই খ্রিষ্টান অধ্যুষিত ছিল। কিন্তু পরে তুর্কি সাম্রাজ্যের অধীনে আসার পর দেশটিতে ধীরে ধীরে মুসলমানদের সংখ্যা খ্রিষ্টানদের ছাড়িয়ে যায়। ১৯১২ সালে তুর্কি সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় দেশটিতে বিভিন্ন মতাদর্শের শাসন বিশেষ করে কমিউনিস্ট শাসন চলায় দেশটিতে সেকুলার আদর্শ অনেকর মধ্যে প্রভাব ফেলে। ফলে মুসলিম বা খ্রিষ্টান থাকার পরও অনেকে কমিউনিস্ট আদর্শ লালন করেন। দেশটিতে সব ধর্ম পালনেরই সমান স্বাধীনতা রয়েছে। দেশটির পুরো অংশতেই মুসলমানদের ব্যাপক বিচরণ থাকলেও রোমান ক্যাথলিকরা তাদের জন্য দেশটির উত্তরাঞ্চল এবং অর্থোডক্স খ্রিষ্টানরা নিজেদের জন্য দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে বেছে নিয়েছে।

শিক্ষা
আলবেনিয়া তুর্কি সাম্রাজ্যের অধীনে থাকার সময় দেশটিতে শিক্ষার হার ছিল ৮৫ শতাংশ। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়টুকুতে দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এ দেশের শাসকরা আবার দেশটির শিক্ষার হার বাড়াতে ব্যাপকাকারে উদ্যোগ নেন। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ১২ থেকে ৪০ বয়সসীমার মধ্যে থাকা সবাইকেই শিক্ষিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এর ফলাফল হিসেবে দেশটিতে বর্তমান শিক্ষার হার ৯৮.৭ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষদের শিক্ষার হার ৯৯.২ শতাংশ এবং নারীদের শিক্ষার হার ৯৮.৩ শতাংশ। দেশটির প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে তিরানার ইউনিভার্সিটি অব আলবেনিয়া। ১৯৫৭ সালের অক্টোবরে এটি যাত্রা শুরু করে।

সংস্কৃতি
আলবেনিয়ার স্বকীয় সংস্কৃতি কালান্তরে গ্রিক, রোমান, বাইজেন্টীয়, তুর্কি, স্লাভীয় ও ইতালীয় সংস্কৃতি থেকে বহু উপাদান ধার করেছে। ঐসব দেশ ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে বলকান অঞ্চল শাসন করত। এসব ভিন্ন ভিন্ন বৈদেশিক প্রভাব সত্ত্বেও আলবেনীয় সংস্কৃতি বেশ সমসত্ত্ব। ঐতিহ্যবাহী পোশাকের মধ্যে আছে রঙিন, সূচির কারুকাজময় শার্ট ও মহিলাদের পোশাক। কোন কোন অঞ্চলে মহিলারা ঢিলেঢালা প্যান্ট পরেন। সাম্যবাদী শাসনের সময় এইসব ঐতিহ্যবাহী পোশাকের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় কারখানায় নির্মিত কমদামী, আধুনিক পোশাক পরাকে উৎসাহিত করা হয়। গণতন্ত্রের আগমনের পর থেকে লোকজন এসব ব্যাপারে আরও বেশি পছন্দ করার সুযোগ পেয়েছে। এখনও গ্রামাঞ্চলে ও উচ্চভূমি অঞ্চলে ঐতিহ্যবাহী পোশাকের চল দেখা যায়, বিশেষত নারীদের মধ্যে।

খেলাধুলা
সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবলের জন্য দেশটি ১৯৩০ সালে গঠন করেছে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন অব আলবেনিয়া। দেশটি ফিফার সদস্য এবং উয়েফার প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অন্যতম। দেশটিতে অন্যান্য খেলাধুলার মধ্যে বাস্কেটবল, ভলিবল, রাগবি এবং জিমন্যাস্টিক উল্লেখযোগ্য।

৥ উইকিপিডিয়া অবলম্বনে