ঢাকা, শুক্রবার ২৬, এপ্রিল ২০২৪ ৩:৪১:৪৭ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
যুদ্ধ কোনো সমাধান দিতে পারে না, এটা বন্ধ হওয়া উচিত: প্রধানমন্ত্রী ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন মা আরও ৩ দিন হিট অ্যালার্ট জারি যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ করার বিল সিনেটে পাস

একজন সাকিলা জেসমিনের সাংবাদিক হয়ে ওঠার গল্প

সাকিলা জেসমিন | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৪:০০ পিএম, ১৩ আগস্ট ২০২১ শুক্রবার

সাকিলা জেসমিন

সাকিলা জেসমিন

আম্মাকে হারিয়েছি সেই শৈশবে, আর কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় আব্বা মারা যান। ছয়ভাই-বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট হলেও এইচএসসি পাশের পর ভাইবোনেরা আমার চাওয়া বা ইচ্ছা নিয়ে কেউ বেশি একটা মাথা ঘামাতে চাইলো না। কিশোরগঞ্জে স্থানীয় কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হতে বললো আমাকে। কিন্তু আমি মানতে পারি না, সারাদিন মন খারাপ করে থাকি, আর ভাবি কি করা যায়। তখন তো আর অনলাইনে ভর্তি ফরম পাওয়া যেতো না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিনে আনতে হতো। 
একদিন জানতে পারলাম আমার প্রতিবেশি প্লাস বান্ধবীর মামা ঢাকায় যাচ্ছেন তার জন্য ফরম কিনে আনতে। ক্লাস ফাইভ ও এইটে পাওয়া বৃত্তির কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিলাম। সেখান থেকে টাকা নিয়ে দৌড়ে গেলাম বান্ধবীর মামার কাছে, আমার জন্যও ফরম কিনে আনতে বললাম। তিনি আমার জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ফরম কিনে আনলেন। পরীক্ষা দিলাম আর বাসার সবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজের বৃত্তির টাকার ওপর ভরসা করে ভর্তি হয়ে গেলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাসায়ন বিভাগে।
তারপর হলে ওঠা, বিভাগে ক্লাশ- শুরু এভাবেই চলছিলো। হয়তো অনেকেই জীবনে অনেক বড় বড় চ্যালেঞ্জ নেয়। কিন্তু আমার মতো ঝুঁকিপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হাসিমুখে কতজন নিতে পারে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হতে পারে বটে। এবার বলছি রসায়নে পড়ে আমার সাংবাদিকতা পেশায় আসার কথা। ওহ্, কেউ কেউ বলবে এ আবার এমন কি? তবে বাস্তবতা হলো, এই পেশায় আসার সিদ্ধান্তটি বা পুরো এই পথটি আমার জন্য মোটেও সহজ ছিলো না।
ছোটবেলা থেকেই ডায়রি লেখাকে আমি খুব জরুরী একটি কাজ মনে করতাম। সেখানে যেমন স্থান পেতো কোন বিষয়ে আমার মতামত আবার পরিবার পরিজন বন্ধু-বান্ধব অথবা নতুন পরিচিত কারও বিষয়ে অনুভুতিগুলোও লিখে রাখতাম আমি। ডায়েরির আমিটা যা বলতে পারে বাস্তবের আমিটা কিন্তু সব সময় তা পারে না। এই যে সত্যিকারের আমিটাকে মেলে ধরার প্রয়াশ এটাই আমাকে ডায়েরি লিখতে উৎসাহিত করতো। 
সময়টা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের শেষ দিকে। আমার একটি পুরোনো ডায়রি ভুল করেই চলে যায় এক সাংবাদিক আত্মীয়-বন্ধুর হাতে। আর সেই থেকে সর্বনাশের শুরু! তার ধারনা হয় আমাকে দিয়ে সবচেয়ে ভালো কাজটিই হচ্ছে না। পড়াশোনা তো পড়াশোনা, কিন্তু এর ফাঁকে আমি যেন লেখালেখিটাও করি। 
সারাদিন ক্লাস, ল্যাবওয়ার্কের পর হলে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা নেমে যেতো। আর পরীক্ষা তো লেগেই থাকতো। রাতে পড়াশোনার ফাঁকে লেখার আলাদা করে সময় খুব একটা হয়ে ওঠতো না। একে তো মেইন বিষয় রসায়ন তার ওপর সাবসিডিয়ারি যদি পদার্থবিদ্যা আর গণিত হয় তাহলে কি অবস্থা হয়, যার হয় সে বোঝে হাড়ে হাড়ে।
এরই মধ্যে জীবনের আরেকটি বড় সিদ্ধান্ত, প্রেম আর বিয়ের সরল সমীকরণে জড়িয়ে ফেললাম নিজেকে। আমার প্রতি ওই সাংবাদিক বন্ধুর একনিষ্ঠ মনোযোগ বন্ধুত্ব থেকে প্রেম, আর প্রেম থেকে বিয়ের পথে নিয়ে গেলো আমাকে। মা-বাবা ও ভাইবোনের স্নেহবঞ্চিত আমি শক্ত করে ধরলাম তার ভালোবাসার হাত! তার হাত ধরে ভালোবাসাময় এক জীবন পার করে দেয়ার ব্রত নিয়েছিলাম সেদিন। নিজের মাঝে আবিস্কার করি ভালোবাসার কি এক অপার ক্ষমতা! 
হলেই থাকছিলাম আমি। মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতাম। মাস্টার্সের পরপর দেখা মিললো কিছুটা অবসরের। হল তখনও ছাড়া হয়নি। এরই মধ্যে আমি একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার জন্য লেখার অফার পেলাম। আমার মনে আছে বিষয়টা ছিলো সরকারের সহশ্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষমাত্রা নিয়ে। লেখা দিলাম। প্রতি সপ্তাহে ছাপা হতে লাগলো। এভাবেই একে একে বিভিন্ন সাপ্তাহিক আর মাসিক পত্রিকার জন্য বিভিন্ন ইস্যুতে লেখার কাজ পাচ্ছিলাম। আমিও সময় পেয়ে লিখতে লাগলাম। আর ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যালস্ কোম্পানিতে দিতে লাগলাম চাকরির ইন্টারভিউ। এরই মধ্যে ব্যর্থতা যেমন আসছিলো, একদিন এলো সফলতাও। 
চাকরি হয়ে গেলো দেশের স্বনামখ্যাত একটি ফার্মাসিউটিক্যালস-এ। কিন্তু পোস্টিং হলো পাবনায়। সেসময় যমুনা সেতু, অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু সেতু তো ছিলো না। আরিচা দিয়ে ফেরিতে নদী পার হতে হতো। অনেক সময় ফেরিতেই কুয়াশার কারণে ফেরি বন্ধ থাকলে পথেই আটকে থাকা। সেইসঙ্গে পারিবারিকভাবে চরম নিরুৎসাহিত করাতো ছিলোই। এসব নানাবিধ অযুহাতে চাকরিটা আর করতে পারলাম না। আর আমার মনের জোর তখন এতটা ছিলো না যে এসব বাধা পেরিয়ে সঙ্গীর অমতে চাকরি করতে পারবো। ঢাকায় আরো দু’য়েকটা চাকরি করলাম। কিন্তু মনের সঙ্গে মিলেছিলো না যেন কোনটাই।
২০০০ সালে আমি কন্যা সন্তানের মা হলাম। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। তাকে ঘিরে আমার নতুন এক জগত। ছোট্ট দীপ্তি আমাকে অন্য এক আলোয় আলোকিত করলো। তখন কিংশুক সমবায় সমিতি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজ হাতে নিলো। এর তখনকার কর্ণধার সাব্বির মাহমুদী আমাকে এই কাজে প্রথম দিন থেকেই নিলেন। আমার বাসায় বসেই লিফেলেট লেখা হলো। নেয়া হলো স্কুল নির্মাণের ভবিষ্যত পরিকল্পনা।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম দিলাম কিংশুক পার্টিসিপেটরি স্কুল। আমি হলাম এর ফাউন্ডার ভাইস প্রিন্সিপাল। সাত-আট জন শিক্ষক শিক্ষিকার অপূর্ব এক যোগসূত্রে বিদ্যালয়টি আমরা আমাদের মেধা ও শ্রম দিয়ে এগিয়ে নিলাম অনেকটা। প্রতিষ্ঠানটি যখন ভালোভাবে দাঁড়িয়ে গেছে সেসময় হঠাৎ করেই নিলাম সাংবাদিকতায় আসার সিদ্ধান্ত।
দৈনিক অর্থনীতি ছিলো তুখোর একটা পত্রিকা। গোলাপী রং-এর নিউজপ্রিন্ট কাগজে ছাপা হয়, অর্থনীতি বিষয়ে বাংলায় তখন মনে হয় এটি একমাত্র দৈনিক। সম্পাদক জাহিদুজ্জামান ফারুক ভাইয়ের সাথে সরাসরি গিয়ে দেখা করে আমার সিভি দিলাম। আমি ভেবেছিলাম সিভি দেখে তিনি নিরুৎসাহিত করবেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটলো উল্টো, তিনি খুবই উৎসাহ দিয়ে বললেন সাইন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের হ্ওয়ায় আমি এখানে ভালা করবো বলেই তার বিশ্বাস। সামনেই বাজেট, আামকে বাজেট টিমে নেওয়া হলো। এরপর থেকে কত অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করেছি কত রিপোর্ট করতে হয়েছে। অনেক বাইলাইন ছাপা হয়েছে। সাংবাদিকতার মাঠে বিচারণের প্রথম ভিত্তিটাই তৈরি হয়েছিলো দৈনিক অর্থনীতিতে।  
বছর খানেক পর এসিআই গ্রুপের ইংরেজি পত্রিকা দি বাংলাদেশ ট্যুডে-তে ইকোনমিক রিপোর্টার হিসেবে যোগ দিলাম আমি। শুরু হলো বাংলা থেকে ইংলিশে যাওয়ার নতুন জার্নি।
২০০৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে টিভি রিপোর্টিং করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে যুক্ত হলাম চ্যানেল আই সংবাদে। দেশপ্রেমের মুলমন্ত্র হৃদয়ে বাংলাদেশ স্লোগানের এই টেলিভিশনের তখন একান্ত এক ভক্ত আমি। নতুন এক প্ল্যাটফরমে নতুন ভাবে কাজ শুরু করলাম। চ্যানেল আই কেবল একটি টেলিভিশন নয় একটি পরিবার। ছোট্ট ওই পরিবারটি এখন অনেক বড় হয়েছে। নতুন সেই পরিবারে এক এক করে ১৮ টি বছর পার হয়ে গেলো। 
এখানে প্রথমে আমি অর্থনীতি বিটে কাজ করেছি বেশি। কাভার করেছি অনেক বাজেট অধিবেশন। শাহ্ এ এম এস কিবরিয়া, এম সাইফুর রহমান, আবুল মাল আব্দুল মুহিত ও আহম মোস্তফা কামাল রাজনৈতিক সরকারের এই স্বনামধন্য মন্ত্রীদের কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে মূল চালিকাশক্তির যে দিকগুলো আছে সেগুলোকে নিয়ে রিপোর্ট করার সুযোগ হয়েছে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে এক বিটে কেবল কাজ করলেই হয় না। যখন যেখানে প্রয়োজন সেই সংবাদ কাভার করতে ছুটে যেতে হয় ঘটনাস্থলে। এসময়কালে কত রিপোর্ট করেছি কত প্রোগ্রামে কাজ করেছি গুণতে পারবো না।
সাংবাদিকতা জীবনের দুই দশকে স্টাফ রিপোর্টার, সিনিয়র রিপোর্টার, এসিসটেন্ট অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর, প্ল্যানিং এডিটর হয়ে বর্তমানে নিউজ এডিটর পদে কাজ করছি। অভিজ্ঞতার কোন শেষ নেই, শেখারও শেষ নেই। নিজেকে এগিয়ে নিতে প্রতিদিন শিখতে হয়, এর কোন ব্যত্যয় নেই।
২০২০-২১ এ করোনামহামারীর এ সময়কালে আমি সুযোগ পেলাম নিজের ফেলে আসা সময়ের দিকে একটু ফিরে তাকাতে। তাই এই লেখা। এখানে জানিয়ে রাখি ২০১১ সালে আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি’র জন্য ভর্তি হয়ে গেলাম। কেননা নিজের পেশাগত কাজের মধ্যে এক সময় মনে হলো নিজের জানার ভিত্তি ও আগ্রহ নিরাপদ খাদ্য নিয়ে। তাই এ বিষয়ে মানুষের উপকারে আসে এমন একটা কাজে আমার অবদান থাকা দরকার।
বাংলাদেশ আনবিক শক্তি কমিশনের সঙ্গে যৌথভাবে তাদের গবেষণাগারে ড. মোবারক আহমেদ খানের সুপারভাইজিং-এ পার্ট টাইমে গবেষণা কজে পিএইচডি’র কাজ এগুতে লাগলো। প্রধান সুপারভাইজার ড. শরীফ এনামূল কবীরের উৎসাহ আর মোবারক স্যারের সহযোগিতা ছাড়া এই কাজ অসম্ভব ছিলো। চিংড়ির খোসা থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে খাদ্য সংরক্ষণের এই কাজটি নিয়ে আমার আন্তর্জাতিক জার্নালে কয়েকটি লেখাও ছাপা হয়েছে। অনেক পরিশ্রমের ফসল এলো ২০১৬ সালের আগস্টে, আমি পিএইচডি ডিগ্রি পেলাম। আমার কর্মজীবনে এই ডিগ্রি কাজে লাগলো কি না এটা নিয়ে কোন মাথাব্যাথা নেই আমার। কোন প্রাপ্তিই ফেলে দেয়ার নয়, অনেক কষ্টের বিনিময়ে এই ডিগ্রি অর্জন করায় যেনো একটা নতুন পালক যুক্ত হলো জীবনে।
সাংবাদিকতা আমার রক্তের নেশা যাকে ছেড়ে যেতে পারিনি, পারবোও না। হয়তো কখনও প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় নাও থাকতে পারে, কিন্তু সংবাদের জন্য উৎসুক মন আর জানার তেষ্টা তা কখনও ফুরিয়ে যাবার নয়।
একজন নারী হিসেবে এদেশের স্বনামধম্য একটি টেলিভিশন চ্যানেলে নিউজ এডিটর পদে উত্তরণের সংগ্রাম এবং এই কাজে লেগে থাকার প্রতিনিয়ত যুদ্ধ আর একটি জীবনের গল্প। মেয়েরা একেক জন শক্তির আঁধার। বিধাতা তাদের এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন নিজের সৃষ্টিকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ধরে রাখতে। তাইতো সৃষ্টিশীলতার প্রতীক নারী। 
আমি মনে করি একজন নারী পারে না এমন কোন কাজ নেই। যতই বাধা আসুক তা অতিক্রমের শক্তি তার ভেতরেই আছে। নারীর বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে এমন সব সামাজিক আচার ও অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। নারী পুরুষ একে অন্যের হাত ধরে যেদিন সমান পথে হাঁটতে পারবে সেই দিনটি হয়তো আমি দেখে যেতে পারবো না। কিন্তু সেই দিন যে আসবে তা আমি গভীর ভাবে বিশ্বাস করি।
এদেশে যেই নারীরা পাইওনিয়ার হয়ে শৃঙ্খল ভেঙ্গেছেন এখনও ভাঙছেন তাদের সালাম। কাজের স্বীকৃতি পেতে নারীকে লড়াই করতে হয় ঘরে বাইরে সবখানে। হয়তো এই লড়াই আজীবনের। 
 

লেখক: সাকিলা জেসমিন, বার্তা সম্পাদক-চ্যানেল আই