ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৫, এপ্রিল ২০২৪ ১৪:৩৫:৩৯ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
যুদ্ধ কোনো সমাধান দিতে পারে না, এটা বন্ধ হওয়া উচিত: প্রধানমন্ত্রী ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন মা আরও ৩ দিন হিট অ্যালার্ট জারি যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ করার বিল সিনেটে পাস

একটি কর্মশালা এবং আমাদের বীরাঙ্গনারা

দিল মনোয়ারা মনু | উইমেননিউজ২৪.কম

আপডেট: ১২:৪৪ এএম, ২৩ মে ২০১৮ বুধবার

বেশ কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত একটি কর্মশালা। যার প্রাসঙ্গিকতা বার বার আলোচনায় উঠে আসা উচিত। কারণ এই প্রাসঙ্গিকতার উপস্থিতি মানুষের মনোজগতে এখনও প্রবল।

 

কর্মশালাটি ছিল ‘দি স্পেক্ট্রাল উন্ড: সেক্সচ্যুয়াল ভায়োলেন্স পাবলিক মেমোরিজ এন্ড বাংলাদেশ ওয়ার অব লিবারেশ‘ বইটির ওপর। বইটির লেখক ডারহাম ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. নয়নিকা মুর্খাজি। মোড়ক উন্মোচনের পর সারাদিন এই বইটি নিয়ে আইনবিদ, রাজনীতিবিদ, নারী সংগঠক, উন্নয়নকর্মী এবং সাংবাদিকসহ এ বিষয়ে সচেতন ব্যক্তিদের সাথে আলোচনা ও বিচার বিশ্লেষণ করা হয়। এসব আলোচনা থেকে উঠে আসা তথ্য ও দিক নির্দেশনা নিয়ে বইটিকে পূর্ণাঙ্গ করার জন্যই এই ফলোআপ কর্মশালার আয়োজন। এ কর্মশালার আয়োজন করেছিল গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা রিইব (জওই)।

 

বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে লক্ষাধিক ধর্ষিত নারীকে বীরাঙ্গনা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া, যুদ্ধকালীন ধর্ষণের সঙ্গে সম্পর্কিত নীরবতার ব্যাপারে জবাবদিহিতার উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত যৌন সহিংসতার জনস্মৃতিসমূহকে সুত্রবদ্ধ করা এবং ৪৫ বছরের প্রণীত সাহিত্য ও ভিজ্যুয়াল আর্কাইভে ১৯৯০ অবধি তুলে ধরা দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বীরাঙ্গনাদের অধিকার ভিত্তিক সাক্ষ্য এ বইয়ে তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৯৭-৯৮ এবং পরবর্তীসময়ে ২০১১-১৩ তে এক বছরব্যাপী মাঠ পর্যায় থেকে উঠে আসা তথ্যসহ বিভিন্ন শ্রেণীর ব্যক্তিদের বক্তব্যগুলো বিচার বিশ্লেষণের পর এই লিখিত ভাষ্য প্রণীত হয়েছে। এর ফলে যুদ্ধকালীন ধর্ষণের সাথে জড়িত স্টিগমা, নীরবতার সম্মান লজ্জা ও ক্ষতিপূরণে প্রভাবশালী বোধকে স্পষ্ট করে যুদ্ধে যৌনতার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং নৈতিক অনুসন্ধানের সম্ভবনা উন্মুক্ত করা হয়েছে।

 

প্রচুর নারী নিগৃহীত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। দেশের সর্বত্র তাদের শরীরের ওপর চাপিয়ে দেয়া অন্যায় কলংক যে যুদ্ধের কারণে সেটা বুঝতে দীর্ঘ সময় লেগেছে অনেকের। শুধু তাই নয় বুঝতে সময় লেগেছে আমাদের রাষ্ট্র সমাজ ও রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত যারা তাদেরও। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৭১ এর নারীর প্রতি সহিংসতাকে মুক্তিযুদ্ধে যোদ্ধার মতই নারী নিজেকে যে উৎসর্গ করেছে সেই সত্য ক্রমান্বয়ে সামনে এসেছে। বীরত্বের মহিমা দেয়ার জন্য তাই রাষ্ট্র তাদের বীরাঙ্গনা আখ্যা দিয়েছে। তবে দু:খজনক সত্য হল আমার দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই এখনও এদের সঠিক সংখ্য নিরূপন হয়নি। এদের অনেকেই বীরাঙ্গনা উপাধির মহত্ব তাদের জীবন সর্বোপরি তাদের মনে ধারন করতে পারেননি।

 

মূলধারায় না আনার কারণ, সমাজের নিন্মবিত্ত ও তৃণমূলের নারীরা উভয় ধরনের মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতার তিনদশক পরে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। ভাষা ব্যবহারে পুরুষের আধিপত্য দীর্ঘদিন নারীকে বন্দী করে রেখেছিলো। সেখান থেকে এখনও তাদের মুক্তি ঘটেনি। ধর্ষণের ব্যাখায় এখনও আমাদের যে অপর্যাপ্ততা রয়েছে তা খতিয়ে দেখার সময় হয়েছে। যেহেতু ধরা হয়, পুরুষ নারীর অভিভাবক, তাই ধর্ষণ করা মানে পুরুষের অভিভাবকত্বকে চ্যালেঞ্জ করা। আবার জেনেভা কনভেনশনে বলা হয়েছিল, একে নারীর সম্মান বোধের ওপর হামলা বলা চলে। কিন্তু এর সঠিক সমাধান স্পষ্ট হয়নি।

 


এ দেশের নারী আন্দোলন ও মানবাধিকার সংগঠনের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ষণকে পৃথকভবে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গন্য করার দাবী ওঠে। যার ফলে ১৯৯৫ সালে বেইজিং ঘোষণায় ধর্ষণকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এর আগে ১৯৪৯ সালে জেনেভো কনভেনশনে ধর্ষণকে মূলত: মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিলো। এ অপরাধের সাজা ছিল তুলনামূলকভাবে কম এবং অনেকটা নমনীয়। কাজেই ধর্ষণকে পৃথকভাবে গন্য করার দাবী সঠিক ছিল, যার বাস্তবায়ন ঘটে বেইজিং সম্মেলনে। এর পেছনে দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করেছে রুয়ান্ডা ও বসনিয়ার নারীদের ওপর চালানো অমানুষিক নির্যাতন। এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কোরিয়ান ও ফিলিপিনো কমফোর্ট নারীদের জাপানের কাছ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা এবং ক্ষতিপূরনের দাবী।

 


আমাদের দেশের নারী আন্দোলন মনে করে মুক্তিযোদ্ধাদের মতই নারী উৎসর্গ করেছে নিজেকে, দেশের জন্য, এসত্য বুঝতে হবে। তারা মনে করেন ধর্ষণ হচ্ছে চরম সহিংসতা যা আঘাত হানে তার দেহে, সততায়, স্বাতন্ত্র, নিরাপত্তা, আত্মপরিচয় এবং সর্বোপরি তার মর্যাদাবোধে।

 


হাইতি, বসনিয়া, রুয়ান্ডার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই তাদের জীবনের তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘকালীন প্রতিক্রিয়াগুলো স্পষ্টভাবে তাদের লিখিত পর্যালোচানয় ওঠে এসেছে। তারা দেখিয়েছেন এই প্রতিক্রিয়া দৈহিক, মানসিক এবং সামাজিক। বড় সত্য হলো মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ওঠা এই নারীরা মৃত্যুমুখী হয়েই বেঁচে থাকবে চিরকাল। শুধু তাই নয় যুদ্ধাহত এই নারী যোদ্ধারা আত্মসম্মান, যৌনবোধ এবং সংসার করার স্পৃহা হারিয়ে নিজগৃহে গৃহহীন হয়ে আছেন বলে অনেকে মনে করেন।

 


নারী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার পরও সেই সময়ে সংকটের কারণে যুদ্ধে অংশ গ্রহণের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সঙ্গত ছিল না বলে অনেকে মনে করে থাকেন। তবে আশার কথা দীর্ঘ বিস্মৃতি ও অবহেলার পর ইতিহাসে প্রত্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাদের অবদান ক্রমান্বয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর আদান প্রদান, অস্ত্র লুকিয়ে রাখা এবং গোপনে তা পৌছে দেয়া, খাবার ও ঔষধ সরবরাহ, জীবনের ঝুকি নিয়ে বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা, গোপনে রান্না করে খাওয়ানো, পুরুষদের যুদ্ধে পাঠিয়ে ঘর সংসার সন্তান সন্ততির দায়িত্ব নিয়ে সাহসের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা এসব ক্ষেত্রেই তাদের সেই সাহস ও উদ্যম যথাযথ মর্যাদায় অাজও লিপিবদ্ধ করা হয়নি। যা করা জরুরি।

 

মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল বহুমাত্রিক। কেবল বাঙালী নয় প্রবলভাবে অংশগ্রহণ করেছে আদিবাসী নারীরাও। শরনার্থী শিবির এর জন্য মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট, প্রচার ও প্রশাসনের কাজ, ট্রেনিং, গান-কবিতার মধ্য দিয়ে মনোবল ঠিক রাখা, চাঁদা তোলা, ঔষধ সংগ্রহ, চিকিৎসা ও সেবাদান কি না করেছে তারা। তাদের মহিমা ও বীরত্ব মিডিয়ায় গুরুত্বপূর্ণভাবে আসা দরকার। তবে সেই ক্ষেত্রে ভাষা ও শব্দ ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে যাতে পুুরুষের আধিপত্য নারীকে বন্দী করে না রাখে।

 

মুক্তিযোদ্ধাদের পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রের বৈষম্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মোট ৬৭৬ জনের মধ্যে মাত্র ২ জন নারী বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন।

 


পৃথিবীর যে কোন দেশে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারীরাই বেশি। তাদের প্রতি সহিংসতা ধর্ষণ ও যৌন অপরাধ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি যুদ্ধ কৌশল। এই চরম সত্য মাথায় রেখে সামগ্রিকভাবে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখা উচিত। সঠিক পরিসংখ্যান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে সরকার কর্তৃক তাদের ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রদানের সঠিক ব্যবস্থা করা দরকার।

 


নারী নির্যাতনের চিত্র নারীদের চোখ দিয়েই দেখতে হবে। নীরবতা এখনও আছে, সেই নীরবতা ভাঙতে হবে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। বিশিষ্ট কথা শিল্পী সেলিনা হোসেন তার একটি লেখায় বলেছেন, ‘এসো এই নারীর বীরত্ব গাঁথার জন্য তাকে সম্বর্ধনা দেই’। পরবর্তী প্রজন্মকে বলি এদের দেখো, এদের মূল্য তোমরা শোধ করতে পারবে না। তাই মুক্তিযুদ্ধে নারীর ইতিহাস নারী অধ্যয়নে প্রতিফলিত হতে হবে।

 

৥ দিল মনোয়ারা মনু : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও নারী অধিকার কর্মী