ঢাকা, শনিবার ২০, এপ্রিল ২০২৪ ২০:৪১:১৯ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
চট্টগ্রামে আজ শুরু উইম্যান এসএমই এক্সপো হাসপাতালের কার্ডিয়াক আইসিইউ পুড়ে ছাই, রক্ষা পেল ৭ শিশু সবজির বাজার চড়া, কমেনি মুরগির দাম সারা দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি, হিট এলার্ট জারি

কন্যাশিশু দিবস: চলছে কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যা

আইরীন নিয়াজী মান্না | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১২:৫০ এএম, ১২ অক্টোবর ২০১৯ শনিবার

অহরহ চলছে কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যা।

অহরহ চলছে কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যা।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে কন্যাসন্তান গর্ভে ধারণ করায় তসলিমা নামে (৩২) এক গৃহবধূকে হত্যা করা হয়েছে। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা তমলিমার আলট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে কন্যাসন্তান হওয়ার কথা জানতে পেরে পাষণ্ড স্বামী সোহেল ও তার পরিবারের সদস্যরা তসলিমাকে নির্যাতন করে হত্যা করে। সে বেশ কিছু দিন আগের কথা।

রাজধানীর একজন বিশিষ্ট শিল্পপতির পুত্রবধূ নাঈমার (ছদ্মনাম) শ্বশুরবাড়ির আদেশে বারবার নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে কন্যাসন্তানের ভ্রূণ। পুত্রসন্তান না হলে নাঈমার স্বামীকে কোনো সম্পত্তি দেওয়া হবে না সাফ জানিয়ে দিয়েছেন শ্বশুর। আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে কন্যাসন্তান জেনে পাঁচবার নষ্ট করা হয়েছে গর্ভের সন্তান।

কুমিল্লার দেবীদ্বারের চরবাখর গ্রামের গৃহবধূ সালমা (ছদ্মনাম) দুটি কন্যাসন্তানের মা। একটি পুত্রসন্তানের আশায় স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের চাপে তিনি দু-দুবার কন্যাসন্তানের ভ্রূণ নষ্ট করতে বাধ্য হয়েছেন।

শুধু তসলিমা, নাঈমা বা সালমাই নয়, এ ধরনের অমানবিক পরিস্থিতির শিকার দেশের শত শত মেয়ে। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের মুখ রক্ষা করতে গিয়ে তাদের সন্তান বিসর্জন দিতে হচ্ছে মুখ বুজে। সমাজের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং কিছু চিকিৎসকের অনৈতিক আচরণের কারণে দেশে অহরহ ঘটছে এমন পৈশাচিক ঘটনা। ধর্মীয় টানাপড়েন এবং লজ্জাবোধের কারণে অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত নারীরা এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারছেন না। অথচ যদি চিকিৎসকরা নৈতিকভাবে দৃঢ় থেকে বিষয়টি রোগীর অভিভাবকের কাছে প্রকাশ না করতেন তাহলে হাজার হাজার কন্যাশিশুর ভ্রূণ রক্ষা করা সম্ভব হতো।

সমাজে কন্যাশিশুর প্রতি চরম অবহেলা এবং সনোলজিস্ট চিকিৎসকদের নীতি-নিয়মহীন আলট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট দেশে গর্ভস্থ কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যার অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করছে।

চীন, জাপানসহ উন্নত বিশ্বের বেশকিছু দেশে জন্মের আগে গর্ভস্থ শিশুটি মেয়ে না ছেলে এ তথ্য প্রকাশে সনোলজিস্টদের প্রতি বিশেষ বিধিনিষেধ থাকলেও বাংলাদেশে সে ধরনের কোনো নিয়ম মানা হচ্ছে না। বরং কত কম সময়ের মধ্যে শিশুটির লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ করা যায়, এ নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছেন দেশের সনোলজিস্টরা।

সনোলজিস্টরা বলছেন, আলট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টের জন্য অন্তঃসত্ত্বা নারীরাই বেশি ভিড় করছেন। তাদের অনেকেরই উদ্দেশ্য, গর্ভস্থ শিশুটি মেয়ে না ছেলে তা জেনে নেওয়া।

তারা জানান, শতকরা ৯০ ভাগ কেসই এ ধরনের। এ অবস্থায় চিকিৎসকরা জন্মের অনেক আগেই শিশুর লিঙ্গ শনাক্ত ও প্রকাশ করাকেই নিজেদের পেশাগত সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করছেন। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা অনৈতিক এ কাজে সব ক্ষেত্রেই যে সফল হচ্ছেন, বিষয়টি তাও নয়।

শুধু কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যাই নয়, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার অভাবে বিভ্রান্তিকর রিপোর্ট দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

একজন দায়িত্বশীল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ভাষ্য, যাদের একাধিক মেয়েসন্তান রয়েছে এবং আর কোনো মেয়েসন্তান চাচ্ছেন না, তারা তাদের গর্ভস্থ শিশুটিকে মেয়ে হিসেবে জেনে যাওয়ার পর গর্ভপাত ঘটাচ্ছেন। মিটফোর্ড ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে নিয়মিত অবস্থানকারী বিভিন্ন মেটারনিটি ক্লিনিকের কয়েকজন দালালের কাছ থেকেও একই তথ্য পাওয়া গেছে।

দালালরা জানান, এমআরের সময় পেরিয়ে গেছে, হাসপাতালে ব্যবস্থা মিলছে না-এমন গর্ভপাতে আগ্রহী নারীদের জন্যই তারা অপেক্ষায় থাকে। নিরুপায় হয়ে তাদের শরণাপন্ন হওয়া নারীর মধ্যে বেশ কয়েকজন স্বীকার করেন, আলট্রাসনোর মাধ্যমেই তারা মেয়েসন্তান ধারণ করেছেন বলে জেনেছেন। কিন্তু তাদের স্বামীরা চাচ্ছেন না সংসারে আর কোনো মেয়েসন্তান আসুক।

একাধিক চিকিৎসক জানান, যাদের একাধিক মেয়েসন্তান রয়েছে তাদের ক্ষেত্রেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।

লালবাগ এলাকার ইস্টার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সনোলজিস্ট ও মেডিসিন চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, ‘দক্ষ একজন সনোলজিস্ট প্রেগন্যান্সির সাড়ে ৪ মাস থেকে ৫ মাসের মধ্যেই বলে দিতে পারেন, শিশুটি মেয়ে না ছেলে। আমাদের কাছে বেশিরভাগ কেসই আসছে এটা জানার জন্য এবং তা জানাতেও চিকিৎসকরা দ্বিধা করছেন না। তবে যাদের একাধিক মেয়ে রয়েছে এবং গর্ভস্থ শিশুটিও মেয়ে সে ক্ষেত্রে আমি তাদের শিশুর লিঙ্গ পরিচয় জানাই না।’

জন্মের আগে আলট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে লিঙ্গ পরিচয় জেনে মেয়ে শিশুর ক্ষেত্রে গর্ভপাতের ঘটনা ঘটছে। এ তথ্য স্বীকার করে তিনি জানান, অহরহ এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত পর্যন্ত সবাই পুত্রশিশুর আশায় কন্যাশিশুর ভ্রূণ নষ্ট করে ফেলছে। বাংলাদেশে এ বিষয়ে কোনো আইন নেই। এমনকি কে কোথায় কীভাবে এসব কাজ করছে সে ব্যাপারেও কোনো মনিটরিং ও সার্ভে নেই।

তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমাদের দেশে গর্ভপাত ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ, সেহেতু এখানে বিষয়টি সেভাবে প্রকাশিত হচ্ছে না। কিন্তু মেটারনিটি ক্লিনিকগুলোয় হরহামেশাই গর্ভপাতের ঘটনা ঘটছে এবং গর্ভপাতের ফলে অনেক মায়েরও মৃত্যু হচ্ছে। বিষয়টি চরম অমানবিক।’

বিশ্বজুড়েই বাড়ছে গর্ভপাত। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও কানাডাসহ এশিয়াতেও আশঙ্খাজনকভাবে গর্ভপাতের হার ক্রমাগত বাড়ছে। আলট্রাসনোগ্রাফির অপব্যবহারের মাধ্যমে শিশুর লিঙ্গ চিহ্নিত করে গর্ভপাত ঘটানোর হার ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে এশিয়ায়। বিশেষত ভারতে মেয়েশিশু গর্ভপাতের হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।

জাতিসংঘের ২০১১ এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এশিয়ার ১০ কোটি ১৭ লাখ কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যার বড় অংশটিই হচ্ছে ভারতে। ফলে দেশটিতে দিন দিন কমে যাচ্ছে কন্যাসন্তানের সংখ্যা।