ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৫, এপ্রিল ২০২৪ ২২:৩১:৪৯ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
যুদ্ধ কোনো সমাধান দিতে পারে না, এটা বন্ধ হওয়া উচিত: প্রধানমন্ত্রী ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন মা আরও ৩ দিন হিট অ্যালার্ট জারি যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ করার বিল সিনেটে পাস

কর্মক্ষেত্রে আবেগ : আহমেদ মুশফিকা নাজনীন

আহমেদ মুশফিকা নাজনীন | উইমেননিউজ২৪.কম

আপডেট: ০৬:১৩ পিএম, ২৮ আগস্ট ২০১৮ মঙ্গলবার

আরে অনেক মেয়েরা তো অফিসে তেমন কোনো কাজ করে না। তারা কর্মক্ষেত্রে পাওয়ারফুল কোনো ব্যক্তিকে বড়ভাই, মামা-চাচা-বাবা বানায়। তারপর তার কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে চাকরি জীবন পার করে দেয়। সুন্দরী হলে তো কথাই নেই। হাসতে হাসতে এক আড্ডায় বলেন সাবেক এক সহকর্মী। আরেকজন সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন শুধু নারীরা নয় পুরুষরাও কর্মক্ষেত্রে কম যায় না। তারাও নানা আত্মীয়তার সর্ম্পক তৈরি করে অনেক সুবিধা নেয়। নাম হয় শুধু নারীদের। তিনি দুঃখ করে বলেন, এসব পরগাছা নারী পুরুষদের জন্য ভোগান্তিতে পড়তে হয় আমাদের। পরগাছারা নিজের পায়ে ভর না করে শুধু লতার মতো অন্যের ওপর নির্ভর করে। কর্মক্ষেত্র কি আত্মীয় বানানাের জায়গা? ভাবতে বসলাম তাদের কথা শুনে!

সেই প্রাচীনকাল থেকে নারীরা সমাজ সংসারে সংগ্রাম করে আসছে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের। পুরুষের চাইতে তাকেই বেশি লড়তে হয় কর্মক্ষেত্রে। সেখানে তার ভরসা নিজ মেধা, সততা আর পরিশ্রমের। সমস্ত প্রতিকূলতা আর পুরুষদৃষ্টি সহ্য করে নারীদের এগিয়ে যেতে হয়। তাকে মিশতে হয় নানা মানুষের সঙ্গে! এখানে একেক মানুষ অাবার একেক রকম, এর মাঝেই থাকে কিছু সুবিধাবাদী নারী-পুরুষ! তারা কর্মক্ষেত্রে নানা আত্মীয়তার সর্ম্পক তৈরি করে এগিয়ে যান। এধরনের সর্ম্পকগুলো কখনো হয় সরলতার, কখনো হয় স্বার্থের। তবে এসব সর্ম্পক তৈরির ক্ষেত্রে বদনাম বেশি হয় নারীদের। তাদের কথা ছড়ায় লােকের মুখে মুখে! অথচ পুরুষদের ক্ষেত্রে এসব সর্ম্পক তৈরি হলে তা দেখা হয় উদারতার সঙ্গে। হাসি মুখে বলা হয় মামা-ভাগ্নের সম্পর্ক! কর্মক্ষেত্রে এ ধরনের সম্পর্ক তৈরি করা আসলে কতটুকু সরল স্বাভাবিক? কেউ সমর্থন জানান, কেউবা বাঁকা ভাবে নেন!

কথা বললাম বেসরকারি সংস্থায় কাজ করা এক বন্ধুর সঙ্গে। তিনি জানান তার এক সহকর্মীর নাম তোড়া (ছদ্দনাম)। নতুন অফিসে জয়েন করেই সে ভাই বানিয়ে ফেলে এক সিনিয়রকে। যে সিনিয়রের ভালোই দাপট রয়েছে অফিসে। ব্যস তোড়া নিরাপদ। ভাইয়ের জন্য বাসা থেকে খাবার আনে। অফিসে একসাথে চা খায়। ভাইয়া ভাইয়া বলে অস্থির। বিষয়টি চোখে লাগে সবার। কেউ কেউ আড়ালে টিপনী কাটে, কেউ বিরক্ত হয়। আড়ালে আড়ালে চলে তীব্র সমালোচনা। অন্যেরা যদি অফিসে দেরি করে আসে তাদের কপালে জোটে ধমক। তোড়া দেরি করে এলে তাকে কিছু বলেন না ভাইয়া। বিষয়টি সবার চোখে লাগে। বেশ কিছুদিন পর বড় ভাই চলে যান অন্য অফিসে। তোড়ার আর মনে থাকে না তাকে। এরমধ্যে আরেকজনকে ভাই বানিয়ে ফেলে।

অন্যদিকে রাজু কাজ করেন এক বেসরকারি সংস্থায়। যত না কাজ করেন, তার চেয়ে বেশি রিলেশন তৈরি করেন সবার সাথে। একে মামা, তাকে চাচা, ওমুককে ছোটোবোন, তমুককে বড়বোন বানায়। এসব সম্পর্কের সূত্র ধরে ভালোই থাকে সে। যতটা পারে তার ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধাগুলো আদায় করে নেয় সে এসব সর্ম্পকের খাতিরে। কিন্তু যখনই তার স্বার্থে আঘাত লাগে তখনই সব সর্ম্পক ছিন্ন করে।

সুপ্রিয় পাঠক, তোড়া, রাজুর মত এরকম সুবিধাবাদী চরিত্র প্রায় সব কর্মক্ষেত্রেই দেখতে পাওয়া যায়। এ ধরনের মানুষগুলো নিজের যোগ্যতার উপর ভরসা না করে, আত্মীয়তা খোঁজে । নিজের দুর্বলতা ঢাকতে এরা আশ্রয় নেয় ক্ষমতাবানদের কাছে। নানাভাবে তাকে তুষ্ট করে চাকরি টিকিয়ে রাখে। এদের কারণে বিব্রত বা বিপদে পরেন অন্য দক্ষ সহকর্মীরা।

বেসরকারি সংস্থার এইচআরে কাজ করা তানভীর বলেন, নতুন এক ট্রেন্ড তৈরি হয়েছে অফিসে বাবা অথবা শ্বশুড় বানানো। তিনি জানান, তার এক সহকর্মী নিজের শ্বশুড়কে পছন্দ করেননা। তাদের সঙ্গে থাকেন বলে ভালোমতো কথাও বলে না ওনার সঙ্গে। অথচ সেই সহকর্মী অফিসের এক বসকে শ্বশুড় বানিয়ে তার সঙ্গে আদিখ্যেতা দেখায়। বসের জন্য বাসা থেকে খাবার বানিয়ে আনে। গিফট দেয়!

তানভীর হাসতে হাসতে বলে, জানেন এ নকল ছেলের বউ আসলে চাকরি চায় বসের কাছে। কারণ বসের কানেকশন খুব ভালো। সে চায়, বস তাকে অন্য অফিসে প্রোমোট করুক। তিনি হেসে বলেন এভাবে সম্পর্ক না গড়ে তিনি যদি নিজের মেধাকে কাজে লাগাতেন তাহলে কেউ কথা বলার সুযােগ পেত না! আসলে আমরাই আমাদের আচরণ দিয়ে কথা বলার সুযােগ করে দিচ্ছি! এ ধরনের সম্পর্ক অনেক সময় পরিবারেও নানা সমস্যা তৈরি করে! তিনি বলেন অনেক অফিসে কেউ কেউ আবার কোনো সহকর্মীকে মেয়ে বানায়। কেউ বা আবার বানান ছেলে। এক অফিসের গল্প জানি, বসকে বাবা বলে বলে এক সহকর্মী অস্থির। কিছূদিন পর সেই ছেলে স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বাবাকে পদ থেকে সরিয়ে দিতে একটুও দ্বিধা করেনা। বাবা ছেলে বলে যে সম্পর্ক তৈরি হয় তাতে কি এধরনের আচরণ মানায়? প্রশ্ন তার!

এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক আফসানা নীলা বলেন, ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক মানুষে মানুষে থাকতেই পারে, তবে যখন তা স্বার্থকেন্দ্রীক হয়ে যায় তখনই তা বিপদজনক হয় আশপাশের পাশের মানুষের জন্যে। সমস্যা সম্পর্কে না, সমস্যা স্বার্থে আর স্বার্থ উদ্ধারের পন্থায়। হয়তো কারো স্বভাবে আছে সহজে কাউকে মামা- চাচা-বাবা, ভাই-বোন-মা ডেকে ফেলা। তার কর্মদক্ষতা আর মেধা কম থাকলেও চাটুকারিতা আর সম্পর্ক মেন্টেইন করে সে মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা নিচ্ছে। আবার কেউ হয়তো ওসব এসব মেকি সম্পর্ক তৈরিতে অভ্যস্ত না। তখন ওসব সুবিধাভোগীদের জন্যে সমস্যায় পড়তে পারে। যারা আসলেই সম্পর্কের মানে বোঝেন তারা হয়তো জানেন বোঝেন- সেই মামা ডাক, মা কিম্বা বাবা ডাক-সম্পর্ক কতটুকু গভীর, সততার। এখন অনেকেই বলে গিভ এন্ড টেক সবকিছুতে। তাই বলে এই সম্পর্কও যদি গিভ এন টেক পর্যায়ে চলে যায়, তখন ব্যক্তিগত সম্পর্ক, আত্মার আত্মীয়, কিম্বা এসব ডাকের যে গভীরতা তার কিছুই থাকে না। আমরা আমাদের স্বার্থের জন্যে সম্পর্ক কেনো হালকা করছি ? নিজের মেধা-যোগ্যতার শক্তি দিয়ে যদি একজন মানুষ নিজের পরিচয় বানাতে পারে তখন আর কথিত ভাই-মামা-চাচা, খালু বানানোর প্রয়োজন পরে না। তখন সম্পর্কও সুস্থ-স্বাভাবিক আর গ্রহণযোগ্য থাকতে পারে সবার কাছে।

মনোবিজ্ঞানী ইশরাত জাহান বলেন, কর্মক্ষেত্র এ ধরনের আচরণ না করাই ভালো। এটা কোনো প্রফেশনাল আচরণ না। অফিসে সবচেয়ে ভালো হয় নাম ধরে ডাকা যেমন শীলা আপনি বা রাজিব আপনি। বড়জোর ভাই বলা যেতে পারে। অন্য কিছু না। আসলে আমাদের দেশের মানুষ খুব আবেগপ্রবণ। সব কিছু তারা আবেগে নেয়। বয়স কম হলে বলে, আপনি আমাকে তুমি করে বলেন। কিছুদিন পর যখন তুমি বা তুই বা মামা-খালা বলে তখন মনের অজান্তে ওই সর্ম্পক তারা বয়ে বেড়ায়। মামা বললে ভাগনার মতো ব্যবহার করে। তুই বা তুমি বললে বন্ধুর মতো আচরণ করতে যেয়ে অনাকাংখিত ব্যবহার করে। কেউ যদি তার বন্ধুকে অর্ডার করে কথা বলে সে ব্যবহার যদি কলিগের সাথে করতে যায় তখন অনেক সময় সে মাইন্ড করে। এভাবে ভুল বোঝাবুঝি বাড়ে। কারণ তারা তো আসলে বন্ধু না, সহকর্মী। তাই এ ধরনের সম্পর্ক না করাই ভালো। আমরা আসলে মুখে প্রফেশনালিজমের কথা বলি । বাস্তবে আসলে তা বুঝি না। সহকর্মীকে সহকর্মীর মতই ভাবা দরকার। তাহলে অনেক সমস্যা কমে যাবে।
গবেষক রতন চৌধুরীর মতে এটাকে অনেকটা শেয়ারিং মানসিকতা বলা যেতে পারে। সখ্যতা গড়ে কাজ শেয়ারিং করা। এতে করে দুজনের মধ্যে একটা সর্ম্পক তৈরি হয় এবং এতে অনেকসময় কাজের গতি বাড়ে। তবে এধরনের সর্ম্পক যেহেতু শুধু দুজনের মধ্যে তাই অফিসে ছোট ছোট দল, উপদল তৈরি হয়। যা অফিসের কাজের পরিবেশ নষ্ট করে। অফিস কাজের জায়গা! নিজের মেধা, সৃজনশীলতা দেখানাের জায়গা! মামা-চাচা-বাবা বানিয়ে তা দিয়ে দেখানাে যায়না! তার জন্য পরিবারই আছে। কর্মক্ষেত্রে নিজ যোগ্যতা দিয়ে, মেধা কর্মক্ষেত্রে নিজ যোগ্যতা দিয়ে, মেধা দিয়ে সবার কাজ করা উচিত। পরগাছা হিসেবে টিকে থাকা কখনই সম্মানের নয়। বরং লজ্জার। যে সম্পর্কগুলো মধুর পবিত্র। সেগুলো সে জায়গায় থাকা ভালো। কর্মক্ষেত্রে আনা ঠিক নয়। তবে অফিসে তৈরি করা এসব সর্ম্পক সব যে স্বার্থের তা নয়। অনেক নারী পুরুষ আছেন যারা যে সম্পর্ক গড়ছেন তা মেনে চলেন! সম্মানও করেন। তবে কােনাে মেকি সম্পর্কই সাধারণ দৃষ্টিতে অফিসে ভালোভাবে দেখা হয় না। তাকে নেতিবাচকভাবেই উপস্থাপন করা হয়। তাই দাঁড়ান নিজের পায়ে। অফিসে নিজ ব্যক্তিত্ব বজায় রাখুন, লতা পাতার সম্পর্ক দূরে সরিয়ে ভরসা রাখুন নিজের উপর! একজন সাহসী নারীর সামনে এগিয়ে যাওয়া মানে আরও হাজার নারীর সামনের পথ খুলে যাওয়া! মেকি সম্পর্ক দূরে সরিয়ে যোগ্য করে তুলুন নিজেকে! আত্নবিশ্বাস বাড়ান, দক্ষতা বাড়ান, আপনার কর্ম আর মেধাই আপনাকে একদিন নিয়ে যাবে বহুদূর!

লেখক : সিনিয়র নিউজ রুম এডিটর, একুশে টেলিভিশন