ঢাকা, শুক্রবার ১৯, এপ্রিল ২০২৪ ২৩:০৪:২৭ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
হাসপাতালের কার্ডিয়াক আইসিইউ পুড়ে ছাই, রক্ষা পেল ৭ শিশু সবজির বাজার চড়া, কমেনি মুরগির দাম সারা দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি কৃষক লীগ নেতাদের গণভবনের শাক-সবজি উপহার দিলেন প্রধানমন্ত্রী চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি, হিট এলার্ট জারি শিশু হাসপাতালের আগুন সম্পূর্ণ নিভেছে

গানের পাখি কোকিল

আইরীন নিয়াজী মান্না | উইমেননিউজ২৪.কম

আপডেট: ০৭:৩৮ পিএম, ৩ জুলাই ২০১৮ মঙ্গলবার

ছবি : সোমা দেব

ছবি : সোমা দেব

চাকরিসূত্রে চীন দেশে এসেছি মেলা দিন হলো। স্বাভাবিকভাবেই দেশকে খুব মিস করি সারাক্ষণ। মিস করি কাছের মানুষদের। মিস করি আমার দেশের প্রকৃতি, ফুল, গাছ আর আমাদের পাখিদের।

 

বাংলাদেশ বার্ড ওয়াচার সোসাইটির আমি আহবায়ক। দেশে থাকতে সাপ্তাহিক ছুটির দিন আমরা চলে যেতাম পাখি পর্যবেক্ষণ করতে। ঢাকা শহর ছাড়িয়ে কখনো কখনো চলে যেতাম দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। শুধু নতুন নতুন পাখি অনুসন্ধানে চলতো বিরামহীন পথচলা। গত বিশ বছরে গত যে পাখি দেখেছি তা আজ হিসেব করা বড়ই কঠিন!


ঠিক এ সময়টায় কোকিলের কুহুতান মনকে বড় কাঁদায়। বেশ অনেকবার খুব কাছে থেকে কোকিল দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এখন যখন দেশে কথা বলি তখন ফোনে অপর প্রান্ত থেকে প্রিয়জনদের কথার ফাঁকে ফাঁকে কোকিলের ডাক কানে ভেসে আসে। বিচলিত হয়ে উঠি। ও প্রান্তের মানুষের সাথে কথার খেই হারিয়ে যায়। এই কষ্ট থেকে যখন ভাবছি কোকিল পর্যবেক্ষেণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখবো। ঠিক তখনই ছোট বোন সোমা দেব জানালো সে খুব কাছে থেকে কিছু কোকিলের ছবি তুলেছে। আমাকে পাঠানো ছবিগুলো দেখে আমি তো হতবাক।

 


সোমা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক। ক্যাম্পাসেই তার বসবাস। পাখি, ফুল, প্রকৃতির ছবি তোলা তার সখগুলোর অন্যতম। সে একাধারে একজন কলামিস্ট, লেখক এবং ছড়াকার। তার তোলা কোকিলের ছবি দেখেই আমি ঠিক করলাম এবার কোকিল নিয়ে লেখাটা শেষ করতেই হবে।

 


খুব ছোটবেলায় কোকিলের কুহু কুহু ডাক শুনে পাখিটা কোথায় তা খুঁজে বের করতে চাইতাম। কিন্তু খুঁজে পেতাম না। সে যেন এক অজানা রহস্য। ডাক শোনা যাবে, কিন্তু তাকে দেখা যাবে না! অনেক পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনষ্টিটিউটে প্রথমবার আমি কোকিলের দেখা পাই। সে এক চমত্কার অভিজ্ঞতা। এরপর অনেকবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কোকিলের দেখা পেয়েছি। বেশ কয়েক বছর আগে এক ঝিমধরা দুপুরে রাজধানীর ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক সঙ্গে প্রায় ২০টির বেশি কোকিলকে বসে থাকতে দেখি। ক্যান্টিনের পাশের সবচেয়ে বড় কড়ুই গাছটিতে দুপুরে বসে বসে তারা যেন বিশ্রাম নিচ্ছিল।

 


এত যে কোকিল দেখা! সে তো শুধু পুরুষ কোকিল! মেয়ে কোকিল আমি দেখেছি অনেক পরে। তাও অনেক দিন আগের কথা। রমনা পার্কের ভেতর দিয়ে শিশু পার্কের দিক থেকে বেইলি রোড মন্ত্রী পাড়ার দিকে যাচ্ছি। হঠাত মনে হলো মাথার সামান্য ওপরে গাছের ডালে কি যেন নড়ছে। অবাক ব্যাপার! তাকিয়ে দেখি একজোড়া কোকিল পরস্পরের কাঁধে মুখ লুকিয়ে বসে আছে। একটি কালো রঙের পুরুষ কোকিল এবং একটি বাদামী রংয়ের মেয়ে কোকিল। বিস্ময়ে আমি হতবাক। এই প্রথম আমি মেয়ে কোকিল দেখলাম, তাও আবার এত কাছে থেকে।

 


কোকিলের গান শোনেনি কিংবা গান শুনে পুলকিত হয়নি এমন মানুষ বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া কঠিন। মজার ব্যাপার হলো, পুরুষ কোকিলই কেবল গান গাইতে পারে। মেয়ে কোকিল গান গাইতে পারে না।কোকিল বাংলাদেশের একটি সুপরিচিত পাখি। এদের চমৎকার গান বসন্তকালকে মুখরিত করে রাখে।

 


কোকিল কুকুলিডি (Cuculidae) গোত্রের পাখি। পৃথিবীব্যাপী কোকিলের প্রায় ২৬টি প্রজাতির খোঁজ পাওয়া গেছে। এদের রঙ কালো। মেয়ে কোকিলের রঙ একেবারেই ভিন্ন, বাদামী।

 


বাংলাদেশে কুকুলিডি গোত্রের অধীনে ১৮ প্রজাতির কোকিল রয়েছে। আমাদের দেশে সচরাচর যে কোকিল দেখা যায় তার নাম কালা কোকিল। কাছ থেকে পুরুষ কোকিলের শরীর উজ্জ্বল কালোর উপর নীলাভ-সবুজের প্রলেপ মনে হয়। চোখ লাল টকটকে। ঠোঁট হালকা হলুদ এবং সামান্য বাঁকানো। মেয়ে কোকিল পুরুষ কোকিলের থেকে একেবারেই আলাদা। মেয়ে কোকিল বাদামী রংয়ের এবং তার উপর সাদা ফোঁটা ও দাগ রয়েছে। লেজের দিকে ডোরাকাটা।

 


কোকিল লম্বা ও সরু গঠনবিশিষ্ট পাখি। লম্বা লেজ এবং দীর্ঘ চোখা ডানা রয়েছে। উভয় পায়েই সামনে ও পেছনের দিকে দুটি করে আঙুল আছে। লেজের শেষ ভাগ গোলাকৃতি।

 


অধিকাংশ কোকিল বৃক্ষচর। তবে বেশ কয়েক প্রজাতির ভূচর কোকিলের খোঁজ পাওয়া গেছে। এরা মরু ও মেরু অঞ্চল ছাড়া প্রায় সারা পৃথিবীজুড়ে বিস্তৃত। বিষুবীয় অঞ্চলে এদের উপস্থিতি বেশি। বেশ কিছু প্রজাতি আবার পরিযায়ী।

 


কোকিলের খাদ্য তালিকায় রয়েছে পোকামাকড়, শুককীট প্রভৃতি। এছাড়া ওরা ফলমূলও খায়। পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকতেই পছন্দ করে বেশি।

 


কোকিল কখনও বাসা বাঁধে না। এরা পরজীবী, অর্থাত্ পরের বাসায় ডিম পাড়ে। পাতিকাক, বুলবুলি, বাঘাটিকি, বনছাতারে এমনকি বসন্তবৌরির বাসায়ও ডিম পাড়ে কোকিল।

 


সাধারণত গরমকাল কোকিলের প্রজনন ঋতু। তাই শীতের শেষে কোকিল বাসা বাঁধতে জানে না। কাক, শালিক, ছাতারে, দোয়েল, কসাইসহ অন্যান্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ে এবং বাচ্চা ফোটায়। কালা কোকিল সবচেয়ে বেশি ডিম পাড়ে কাকের বাসায়।

 


কোকিল ও কাকের ডিম পাড়ার সময় এপ্রিল থেকে আগষ্ট মাসে। কাকের বাসায় পিম পাড়ার একটি অদ্ভূত কৌশল আছে কোকিলের। কাকের বাসার চারদিকে পুরুষ কোকিলটি ঘুরঘুর করে কাককে রাগিয়ে তোলে। কাক কোকিলকে তাড়া করে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। আর এ সুযোগে মেয়ে কোকিলটি কাকের বাসায় ডিম পেড়ে আসে। কাক যেন বুঝতে না পারে সে জন্য তার কয়েকটি ডিম ফেলে দেয় মেয়ে কোকিলটি। কখনো দেখা যায় কাক সামান্য সময়ের জন্য বাসা ছেড়ে গেলে কোকিল সেই ফাঁকে ডিম পেড়ে চলে যায়। কাক নিজের ডিমের সঙ্গে কোকিলের ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। বাংলাদেশে ১৬ জাতের কোকিল অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ে। বাকি দুইটি প্রজাতি নিজেরাই বাসা বানায়। এরা হচ্ছে সবুজ ঠোঁট মালকোয়া ও মেটে মালকোয়া।

 


বাংলা ভাষায় কোকিল নিয়ে কত যে গান, কবিতা, ছড়া লেখা হয়েছে তার শেষ নেই। আমাদের সাহিত্যে এ পাখিটি অত্যন্ত কার্যকর অনুষঙ্গ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন `দক্ষিণ হাওয়া হেঁকে বেড়ায় জাগো জাগো, দোয়েল কোয়েল গানের বিরাম জানে না গো।` অবনিন্দ্রনাথ লিখেছেন, `কালোর গানে পুলক আনে, অসার বনে বয় দক্ষিণা।` নজরুল লিখেছেন, `কুহুকুহু কুহুকুহু কোয়েলিয়া কুহরিল মহুয়া বনে।`

 


কোকিল আমাদের জীবনের একটি প্রধান অনুষঙ্গ। আমাদের দেশে, আমাদের সমাজে তারা ভালো থাকুক, নিরাপদে থাকুক এই প্রত্যাশা।

 

(লেখাটি ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে লেখা)