ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৮, মার্চ ২০২৪ ১৬:৫০:০৫ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
বিশ্বে প্রতিদিন খাবার নষ্ট হয় ১০০ কোটি জনের বাসায় পর্যবেক্ষণে থাকবেন খালেদা জিয়া ট্রেনে ঈদযাত্রা: ৭ এপ্রিলের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু গাজায় নিহত বেড়ে ৩২ হাজার ৪৯০ অ্যানেস্থেসিয়ার ওষুধ বদলানোর নির্দেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঈদ কেনাকাটায় ক্রেতা বাড়ছে ব্র্যান্ড শপে বাঁচানো গেল না সোনিয়াকেও, শেষ হয়ে গেল পুরো পরিবার

জন্মদিনে স্মরণ : শিল্পী আসমা কিবরিয়া যাঁর ছবির প্রাণ প্রকৃতি

দিল মনোয়ারা মনু | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০১:২৯ পিএম, ১৬ জানুয়ারি ২০১৯ বুধবার

ছবি : সংগ্রহ করা

ছবি : সংগ্রহ করা

দেশের বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী আসমা কিবরিয়ার জন্মদিন আগামী ১৮ জানুয়ারি। প্রকৃতি প্রেমী এই শিল্পীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং অকৃত্রিম ভালোবাসা জানিয়ে গভীর শ্রদ্ধায় তাকে স্মরণ করছি। তিন দশকের বেশি সময় ধরে একজন শৌখিন শিল্পী হিসেবে তিনি নিরবে শিল্পচর্চা করে গেছেন। নিজগুণে নিজ দাবীতে উৎকৃষ্ট শিল্পী হয়েছিলেন নবীন বয়সেই। উদ্যম ছিল উদ্দীপনা ছিল, ছিল উদ্যোগী হয়ে ছবি আঁকা ও প্রদর্শনী করার নেশা।

যদিও তার শিল্পের বিষয় প্রকৃতি কিন্তু তিনি চিত্রকলার বিভিন্ন আঙ্গিক ও শৈলী নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে ভালবাসতেন। জীবনকে জেনেছেন জীবনকে ভালোবেসেছেন তার শিল্পচর্চার প্রতি সুগভীর মমত্ববোধ থেকেই। কুটনীতিক স্বামীর ছত্রছায়ায়, আগ্রহে তার সুযোগ হয়েছে বিভিন্ন দেশের নামী দামী সব শিল্পীর শিল্পের সাথে গভীরভাবে পরিচিত হওয়ার।

এই প্রয়াত শিল্পীর শিল্পকর্ম ও জীবনের নানা দিক নিয়ে জানার এক দূর্লভ সুযোগ হয়েছিলো আমার তার জাতীয় জাদুঘরে অনুষ্ঠিত একাদশ প্রদর্শনীর উদ্বোধনের সময়। সেদিনের দীর্ঘ আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে তিনি আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছেন আলোকিত করেছেন। তিনি বলেছিলেন, তার ছবিতে কিভাবে নন্দনতত্ত্ব ও টেকনোলজি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে সে কথা।

কথা প্রসঙ্গে তিনি আরো জানিয়েছিলেন, তাদের পরিবার ছিল সংস্কৃতিমনা। পড়াশোনার সাথে সাথে নাচ, গান, ছবি আঁকা, নাটক করার একটি ধারাবাহিক চর্চা সেখানে ছিল। একান্তে ছবি আঁকার বিষয়টি একদিন বাবার চোখে ধরা পড়ে। তাঁর ছবি আঁকার নিপুণতা বাবাকে মুগ্ধ করে। তিনি মেয়ের জন্য একজন দক্ষ আর্ট টিচার রেখে দেয়ার কথা চিন্তা করলেন। সেই থেকে তার ছবির সাথে নিরন্তর পথচলা। প্রতিনিয়ত চেষ্টা ছিল এই বিষয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করে তোলার। 

বিয়ের পর কিছুটা ছন্দপতন ঘটে। ছবি আঁকার চর্চায় কিছুটা ভাটা পড়ে। কিন্তু স্বামীর আগ্রহ ও চেষ্টায় তিনি আবার নতুন প্রাণ ফিরে পান, উজ্জীবিত হন। নিউইয়র্কে থাকার সময় তিনি সেখানকার আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। তিন বছরের একটি প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নিয়ে নতুন আঙ্গিক, নতুন ভাবনার আলোয় নিজের শিল্পচর্চাকে সমৃদ্ধ করেন।

নিউইয়র্কের এই স্কুলটি ছিল একজন ফরাসী আর্টিস্টের। শুরুতে এই স্কুলে তাদের গ্রেট মাস্টারদের ছবি কপি করা শেখানো হতো। সেই সময়ে তিনি যখন স্কেচ বাদ দিয়ে রংয়ের মাধ্যমে কাজ শুরু করলেন তখন তার শিক্ষক তা দেখে বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা কতগুলো ছবি তাকে কপি দেন। শিক্ষক বলেছিলেন, তুমি যদি এই ছবি যথাযথভাবে কপি করতে পারো তা হলেই প্রমাণিত হবে যে একদিন তুমি বড় আর্টিস্ট হতে পারবে। এদের ছবি থেকেই তাকে শেখানো হয়েছিল ড্রইং, রংয়ের ব্যবহার এবং বিভিন্ন রং মিশ্রনের মাধ্যমে রং তৈরি করার কৌশল। হাতেকলমে শিক্ষার পাশাপাশি তাদের বিভিন্ন মিউজিয়ামে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে ছবি নিয়ে আলোচনা, কৌশল, মনোভঙ্গী এবং বহুবিধ রংয়ের ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা দেয়া হতো। যা তাদের ভাবনার জগৎ এবং দৃষ্টিভঙ্গীকে প্রসারিত করেছে বলে তিনি মনে করতেন। এই প্রতিষ্ঠানে ছবি আঁকা শুধু নয় তাদের ছবি নিয়ে গ্রুপ এক্সজিবিশন করার চমৎকার ব্যবস্থাও ছিল। এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে কল্পনায় এসেছে নানা ভিন্নতা। তৈরি হয়েছে রসদ। পৌঁছে গেছেন বিশ্বাসের পটভূমিতে।

প্রথম দিকে ল্যান্ড স্কেপ, স্টিল লাইফ, পোট্রেট মূল ভাবনার বিষয় থাকলেও পরবর্তী সময়ে নিজস্ব একটা আঙ্গিক তৈরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। এ সময়ের ছবিতে রং ব্যবহারে ঔজ্জ্বলের প্রাধান্য থাকলেও বেশ কিছু ডার্ক কালারের ছবি এঁকেও তিনি প্রশংসিত হয়েছিলেন। তার ধারণা রংয়ের ব্যবহারটা অনেকটা মুডের ওপর নির্ভর করে।

প্রকৃতি তার ছবির মূল বিষয়। তার কারণ ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতি তাকে খুব টানতো। তার কারণ বিভিন্ন ঋতুতে প্রকৃতির রং বদলের খেলা তাকে মুগ্ধ করতো। ঋতু বৈচিত্রের সৌন্দর্য দেখার জন্য তিনি গ্রামের বাড়ি ছুটে যেতেন। ধানক্ষেত, আকাশ, শরতের মেঘ, কাশফুল তাকে মুগ্ধ করতো। আর তাই ঘুরে ফিরে এগুলোই তার ছবিতে এসেছে। পরে বিমূর্ত ধারার ছবিও এঁকেছেন তিনি। 

বিমূর্ত ছবি সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, এটি হলো কর্ম এবং কালারকে আমি কিভাবে ভেঙেচুরে আবার সঠিকভাবে সাজাই। এ ক্ষেত্রে দর্শকদের সব সময় ছবির মমার্থ বোঝানো সহজ নয়। নিজের ‘কুয়াশাচ্ছন্ন প্রভাত’ শিরোনামের শিল্পকর্মটি উদাহরণ হিসেবে টেনে তিনি বলেছিলেন, প্রদর্শনীতে এই ছবির বিষয় সম্পর্কে যখন একজন দর্শক জানতে চেয়েছিলেন তখন তিনি সেই দর্শক কি বুঝেছে, তা জানতে চেয়েছিলেন। দর্শক উত্তরে বলেছিলেন, ছবিতে তিনটি মেয়ে দেখে তার মনে হয়েছে তারা আমাদের জীবনের তিনটি পর্যায়, শেষ পর্যায়টি আলোর দিকে চলে যাচ্ছে। শিল্পী আসমা কিবরিয়ার ধারণা বিমূর্ত ছবি দেখে দর্শক নিজে যা অনুভব করে সেটাই ছবির অন্তরনিহিত সত্য।

শিল্পী জলরং, তেলরং, প্যাস্টেল, অ্যাক্রোলিকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছবি এঁকেছেন। তবে মাধ্যম হিসেবে ছবি অ্যাক্রোলিক তার বেশি পছন্দ ছিলো। জল রংয়ের ছবিও এঁকেছেন বেশ কিছু। অনেকেই যাকে এক কথায় অনন্য বলেছেন। 

আলোচনায় শিল্পাচার্যের কথা বলতে যেয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘রিজিওন্যাল কো-অপারেশন বিটুইন ইরান-তুর্কি অ্যান্ড পাকিস্তান’নামক একটি সংস্থা ইরানে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলো সেখানে শিল্পাচার্য এসেছিলেন। শিল্পচার্যকে সে সময় তিনি তার বাসায় নিমন্ত্রণ করেছিলেন। তিনি নিউইয়র্কের তার বাসায় তার আঁকা ছবি দেখে মন্তব্য করেছিলেন আপনার লাইনের মধ্যে আমি মুভমেন্ট দেখছি, গতি দেখছি যা সচরাচর দেখা যায় না। আপনি খুব ভালো আঁকবেন।

আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, তিনি নিউইয়র্কে যে শিক্ষকের কাছে ছবি আাঁকা শিখেছিলেন তিনি ছিলেন ইম্প্রেশনিস্ট গ্রুপের। তাই তার প্রথম দিকের ছবিতে এর প্রভাব রয়েছে। স্বামীর চাকুরির সুবাদে বিভিন্ন দেশে যাওয়ার সুযোগে তার শিল্পজগত অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে তা তিনি কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করেছিলেন। অনেক মিউজিয়াম ও গ্যালারি দেখার সুযোগ হয়েছে তার। ফ্রান্স ও পূর্তগাল শুধু নয়, জাপান, লেলিনগ্রাদের অনেক প্রাইভেট গ্যালারী দেখার মধ্য দিয়ে ইউরোপীয়ন গ্রেট মাস্টার বেসব্রান্ট, ভ্যানগগ, পিকাসোর আঁকা ছবি দেখার দূর্লভ সুযোগ হয়েছে, যা তার আধুনিক শিল্প ভাবনাকে উন্নত করেছে।

শুধু ছবি আঁকা নয় গানের প্রতিও তিনি অনুরক্ত ছিলেন। বাড়িতে সংগীতের পরিবেশ থাকায় তাদের উৎসাহ অনুপ্রেরণায় ক্লাসিক্যাল সংগীত তামিল নিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে নজরুল, অতুল প্রসাদ, দিজেন্দ্র ও রবীন্দ্র সংগীতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। প্রয়াত ছোট ভাইয়ের কথা স্মরণ করেলেন তিনি যে তার গানের সঙ্গে তবলা সংযত করেছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে।

এতকাজ এত ব্যবস্তার মধ্যেও তিনি ছিলেন সুগৃহিনী। শুধু গাছপালা আর ফুলেররাশির সঙ্গেই তার সখ্যতা নয়, নিজ হাতে রান্না করতেও তিনি পছন্দ করতেন। শিল্পী জীবনে এই সত্যটি প্রমাণ করে গেছেন, পেশা ও দায়িত্বের চাহিদা সবই আধুনিক মেয়েরা একসঙ্গে পূরণ করতে পারে। যদি তারা চেষ্টা করেন। 

এই মহানশিল্পী ১২০১৫ সালে ৯ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। আগামী ১৮ জানুয়ারী তাঁর জন্মদিন। জন্মদিনে তকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।

৥ দিল মনোয়ারা মনু, সিনিয়র সাংবাদিক, কলাম লেখক।