ঢাকা, শনিবার ২০, এপ্রিল ২০২৪ ১৬:০৩:৫৮ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
হাসপাতালের কার্ডিয়াক আইসিইউ পুড়ে ছাই, রক্ষা পেল ৭ শিশু সবজির বাজার চড়া, কমেনি মুরগির দাম সারা দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি কৃষক লীগ নেতাদের গণভবনের শাক-সবজি উপহার দিলেন প্রধানমন্ত্রী চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি, হিট এলার্ট জারি শিশু হাসপাতালের আগুন সম্পূর্ণ নিভেছে

জয়ার ‘দেবী’ ও আজকের ‘মি টু’ আন্দোলন : মাহমুদা চৌধুরী

মাহমুদা চৌধুরী | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৪:০৬ পিএম, ৮ নভেম্বর ২০১৮ বৃহস্পতিবার

কোন শিশু শৈশবে যৌন নিপীড়ন কিংবা নির্যাতনের শিকার হলে, সেই ঘটনা সে কখনোই ভোলে না। সেই ঘটনা শিশুর মানসিক বিকাশের ধারাবাহিকতাকে বাঁধাগ্ৰস্থ করে। প্রচন্ড প্রভাব ফেলে চিন্তা-চেতনে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মতে, এই ধরনের ঘটনায় শিশুটি মনোবৈকল‍্য রোগে আক্রান্ত হতে পারে । 


অভিনেত্রী জয়া আহসান প্রযোজিত 'দেবী' ছবির গল্পের, পরাবাস্তব ঘটনার মধ্য দিয়ে মারাত্মক এই সামাজিক-মানবিক সমস্যাটি উঠে এসেছে।


গোটা বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও '#me too' আন্দোলনে মেয়েরা যখন মুখ খুলতে শুরু করেছে , সেই সময়ে জয়া আহসান প্রযোজিত ও অভিনীত 'দেবী ' ছবিটি মুক্তি - বাস্তবিক অর্থে সামাজিক সুরক্ষা ও রাষ্ট্রব‍্যবস্থার জন্য বয়ে আনলো নতুন দিকনির্দেশনা। এই চলচ্চিত্র প্রযোজনার মাধ্যমে অভিনেত্রী জয়া আহসান ব‍্যক্ত করলেন সমাজের প্রতি একজন শিল্পীর দায়বদ্ধতার অঙ্গীকার।


চলচ্চিত্র 'দেবী' নির্মিত হয়েছে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের পরাবাস্তবাদী বা ভৌতিক উপন্যাস দেবী অবলম্বনে। এই উপন্যাসের মধ্য দিয়েই তিনি নির্মাণ করেন জনপ্রিয় মিসির আলী চরিত্রটি। 


লেখক হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বিজ্ঞানের ছাত্র এবং শিক্ষক। সঙ্গত কারণেই আমরা ধরে নিতে পারি , দেবীর কাহিনী এবং চরিত্রের ভিত্তি নির্মাণের জন্য, তিনি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ খুঁজে, চরিত্র ও ঘটনগুলো র্যৌক্তিক করে সৃষ্টির চেষ্টা করছেন । ঢাকাই সিনেমার তথাকথিত কাহিনীকারদের মতো তিনি গাঁজায় দম দিয়ে উপন্যাস রচনা করেননি। 


দেবীর মতো ভৌতিক উপন্যাসকে চলচ্চিত্রের টাইম ফ্রেমে গাঁথতে গিয়ে পরিচালক অনম বিশ্বাস উপন‍্যাসর অনেক চরিত্র ও ঘটনা ছেঁটে ফেলেছেন । চলচ্চিত্র শিল্পের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সেটাই স্বাভাবিক । কারণ উপন্যাস ও চলচ্চিত্র - দুটি ভিন্ন শিল্প মাধ্যম।


এতে চলচ্চিত্র'দেবী'র রসাস্বাদনে কোন হেরফের ঘটেছে বলে আমার মনে হয় না।  বরং চরিত্র ও ঘটনাগুলোকে চলচ্চিত্রের ভাষায় রুপান্তরিত করতে গিয়ে পরিচালক ও চিত্রনাট্যকারকে আরো বেশি সময়োপযোগী় এবং বস্তুনিষ্ঠতার প্রতি মনোযোগী হতে হয়েছে। এই দিক থেকে বিবেচনা করলে, অবশ্যই তারা প্রশংসার দাবিদার।


দেবীর কাহিনী রং সারমর্ম এই রকম : অনাথ রানু, মধুপুরের এক গন্ডগ্ৰাম নিমসাসায় স্কুল শিক্ষক চাচার বাড়ীতে প্রতিপালিত হয়। ওই গ্রামে পরিত‍্যাক্ত একটা বিষ্ণু মন্দির ছিল । তাতে বিষ্ণুর কোন মুর্তি ছিল না । নির্বংশ হবে -- এই ভয়ে , পুজো দেয়া তো দূরের কথা, কেউ ওই মন্দির কেউ পা দিতো না।

 
অনাথ রানু শৈশব থেকেই খেলতে খেলতে শিশু সুলভ কৌতুহলে ওই মন্দিরে চলে যেত। রানু মন্দিরের ভেতরে শ্বেতপাথরের এক দেবী প্রতিমা দেখতে পেতো। যা অন্য কারো চোখে পড়তো না। একদিন সেই মন্দিরের ভেতরে জালালুদ্দিন নামে এক ব্যক্তি রানুকে ধরে ওর পায়জামা খুলতে চেষ্টা করে। ও ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে ফেলতে অর্ধ চেতন অবস্থায় ,দেখতে পায় - ওই পাথরের দেবীর মুর্তি মানুষের রূপ ধারণ করে আলোর রশ্মি ছড়িয়ে ওকে রক্ষা করে। সেই সাথে অনুভব করে, ওর শরীরের ভেতরে ঢুকে বা মিশে যায় দেবী প্রতিমা। 


কিছু দিন পর, চাচাতো বোন হনুফার বিয়ের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে কাদামাটি খেলে ,সবার সাথে রানুও নদীতে আয় গোসল করতে। হঠাৎ ওর পায়ের সাথে একটা মরা লাশ ঠেকে। ওর মনে হয়, পানির নিচে মৃত জালালুদ্দিনই যেন ওর পায়জামা ধরে টান দিচ্ছে । ভয়ে চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। জ্ঞানহীন অবস্থায় রানুকে হাসপাতালে নেয়া হয়। চিকিৎসার পর, কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসে।
এরপর থেকে রানু একা একা কথা বলতো। ওর মনে হতো, ও একা নয়। ওর সাথে আরো একজন আছে। ও স্বপ্নের ভেতর অনেক কিছু দেখতে পেতো, যা পরবর্তীতে বাস্তবে ঘটতো। জেগে জেগেও এই ধরনের ঘটনা স্বপ্নের ঘোরের মতো দেখতে পেতো। না দেখেও অনেক কিছু দেখতে এবং বলতে পারতো । মনোবিজ্ঞানের সূত্র মতে ,শৈশবে যৌন নিপীড়নের ভীতিকর স্মৃতি রানুর অচেতন মনের অতিন্দ্রীয় শক্তিকে সক্রিয় করে তোলে!


যাইহোক, বয়স বাড়ার সাথে সাথে রানু অসাধারণ সুন্দরী হয়ে ওঠে! বিয়ের পর স্বামীর সাথে বসবাসের জন্য চলে আসে ঢাকায় ভাড়া বাড়িতে। স্বামী আনিস অফিসে চলে গেলে রানু একা একা ঘরের ভেতরে সময় কাটায়। 


নিচতলায় বাড়ি ওয়ালা মাতৃহীন দুই মেয়েকে নিয়ে থাকেন। নিলু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী আর কনিষ্ঠ বিলু , কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ে । রানু বিলুর সমবয়সী।


নিলু কালো বলে নিজেকে অসুন্দরী ভাবে। এই দুর্বলতার কারণে তার কোন ছেলে বন্ধু হয়নি। তবে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয়ে হয় হাসান জাবেদ নামে অজ্ঞাত পরিচয় এক লোকের সাথে । ক্রমশ ওরা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।


এদিকে, রানু রাতে ঘুমাতে পারে না । নানা রকম শব্দ শুনতে পায়। ওর মনে হয়, ছাদের ওপর কে যেন হাঁটছে! জানালা খুলতে চেষ্টা করছে, ঘরে ঢোকার জন্য ! এছাড়া ফুলের তীব্র গন্ধ নাকে পায় সে।


ক্রমশ রানু অসুস্থ হয়ে পড়ে। দিশাহারা আনিস অফিসের এক সহকর্মীর জানায়। তারই পরামর্শে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের পার্ট টাইম অধ‍্যাপক মিশির আলীর কাছে , আনিস রানুকে নিয়ে যায়। 


মিসির আলি রানুর অতিন্দ্রীয় শক্তির উৎস ও কার্যকারণ খুঁজতে , মধুপুরের চাচার বাড়িতে চলে যান।


তথ‍্যানুসন্ধান করে বুঝতে পারেন , শৈশবে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার ফলে রানু মনোবৈকল‍্য আক্রান্ত হয়েছে।

 
বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ভিত্তিতে মিসির আলী রানুর অতিন্দ্রীয় শক্তির বিশ্লেষণ করেন। যা মনোবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন schizophrenia. শৈশবে যৌন নিপীড়নের ভীতিকর স্মৃতি বিজড়িত ঘটনার কারণে, রানু এখন schizophreniac patient . 


এদিকে, নিলু আর রানুর মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী নীলু ঘটনাচক্রে রানুর অতিন্দ্রীয় শক্তির পরিচয় পায়। একদিন হাসান জাবেদ ডেটিং করার নাম করে নিলুকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। ওর হাত পা বেঁধে একটু একটু করে নির্যাতন করে নীলুকে হত‍্যার মাধ্যমে সে একধরনের বিকৃত আনন্দ উপভোগ করতে চায়। মূলত , এটাও মানসিক ব‍্যাধি। এদের বলা হয় স‍্যাডিস্ট।


এই সময়ে রানু অসুস্থ হয়ে পড়ে। অর্ধ অচেতন অবস্থায় রানুর অনুভূতির এন্টেনায় ধরা পড়ে নীলুর জীবনের সংকটজনক পরিস্থিতির বিষয়টি। 


এই সময়ে রানুর অচেতন মনের অতিন্দ্রীয় শক্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে । আলোর দীপ্তি ছড়িয়ে রানুর মনে ঘরের অপর বাসিন্দা হাসান জাবেদকে হত‍্যা করে নীলুর জীবন রক্ষা করে । একই সঙ্গে শারীরিক মৃত্যু হয় রানুর। আর ওর আত্মিক দোসর দেবী আশ্রয় নেয় নীলুর শরীরে। মিসির আলির সাথে নীলুর দেখা হলে, বিস্মিত হন তিনি। এখন তার একটাই ভাবনা- নীলু কী করে রানুর মতো অবিকল দেখতে হলো!


মূল উপন‍্যাসে আরো অনেক চরিত্র ও ঘটনার জটিলতা আছে। কিন্তু চলচ্চিত্রকার সেসব জটিলতা পরিহার করে , বিজ্ঞান ও পরাবাস্তবাদের সংমিশ্রণে চরিত্র ও কাহিনীকে রহস্যময়তার আঙ্গিকে চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করেন। যা শেষ দৃশ্যটি পর্যন্ত টান টান করে ধরে রাখে দর্শকের কৌতুহল।


একটা কথা না বললেই নয়, উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রকে উপন্যাসের হুবহু মিল খুঁজতে যাওয়া বৃথা।

 
কারন উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হলেও ,চলচ্চিত্র শিল্পের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী , বিষয়টিকে সময় ও বাস্তবানুগত করার দিকে নির্মিতাকে মনোযোগ দিতে হয় । পরিচালক অনম বিশ্বাস এ ব্যাপারটাতে বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করে গেছেন। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, নবীন পরিচালক হিসেবে তিনি সর্বজন উপভোগ্য একটি ছবি উপহার দিতে সক্ষমতার স্বাক্ষর রেখেছেন। অধিকন্তূ, পরাবাস্তববাদী বিষয় নিয়ে নির্মিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র হিসেবে 'দেবী' ঢাকাই সিনেমার ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। 


ছবিতে টেকনিক্যাল কিছু ত্রুটি আছে। যেমন, উচ্চকিত শব্দ ব‍্যবহারের মাধ্যমে ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা। বিষয়টি বালখিল‍্যতার নামান্তর। এই ব‍্যাপারে পরিচালক উপন্যাসকে অনুসরণ করলে পারতেন । তাতে ভৌতিক পরিবেশ - অনেক বেশি বাস্তবানুগত বলে মনে হতো। 


বস্তুত, নৈঃশব্দ্য অনেক বেশি ভীতিকর । সেই ভীতি শব্দ দিয়ে তৈরি করা যায় না।


চলচ্চিত্রে ঘটনা ও কাহিনীর পরিবেশ সৃষ্টিতে শিল্প নির্দেশকের ভূমিকা পরিচালকের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। সেই বিষয়টির প্রতি শিল্পনির্দেশকের সুচিন্তিত ভাবনা খামতি ছিল বলে মনে হয়েছে। 


চিত্রনাট্যকার ও চিত্রগ্ৰাহক - স্ব স্ব কর্মে নিষ্ঠার নিদর্শন রেখেছেন। লো - কি এর ব‍্যবহারে আরও সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন ছিল। 
প্রধান অপ্রধান চরিত্র নির্বিশেষে সকলের অভিনয় ছিল চরিত্রানুগত এবং উপভোগ্য।


জয়া আহসান, চঞ্চল চৌধুরী ও শবনম ফারিয়া দর্শকের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। শক্তিশালী ও অভিনেতা ইরেশ যাকের চিত্রনাট্য অনুযায়ী স্রেফ চরিত্রের দাবি মিটিয়েছেন। এই জন্য দায়ী চরিত্র রচয়িতা।


বিগত কয়েক যুগ ধরে, ঢাকাই সিনেমার গৎবাঁধা যুগল প্রেম আর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ছবির দঙ্গলে ' দেবী'র আবির্ভাব - গ্ৰীষ্মের খড়তাপে বয়ে আনলো দক্ষিণা হাওয়ার শীতল পরশ।

 

৥ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক