ঢাকা, বুধবার ২৪, এপ্রিল ২০২৪ ১১:৪৫:৫৭ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
‘পদ্মশ্রী’ গ্রহণ করলেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা কাতার-বাংলাদেশ ১০ চুক্তি-সমঝোতা সই কয়েক ঘণ্টায় ৮০ বারেরও বেশি কেঁপে উঠল তাইওয়ান ঢাকা থেকে প্রধান ১৫টি রুটে ট্রেনের ভাড়া যত বাড়ল মাকে অভিভাবকের স্বীকৃতি দিয়ে নীতিমালা করতে হাইকোর্টের রুল আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করেছি : শেখ হাসিনা নতুন করে ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি

নিপীড়ক হওয়ার মধ্যে ‘পৌরুষ’ নেই, গৌরব নেই

সজীব সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৮:২৩ পিএম, ১৬ এপ্রিল ২০১৯ মঙ্গলবার

ভারতীয় উপমহাদেশের বিগত কয়েক হাজার বছরের সংস্কৃতিতে আমরা দেখি, নারীকে এখানে ‘দেবি’ জ্ঞানে উপাসনা করা হয়ে আসছে। প্রাচীন শাস্ত্রের গাথা আর ধ্রুপদী সাহিত্যে আমরা এর অজস্র প্রমাণ পাই। পৃথিবীর আর কোনো অঞ্চলে এমন নজির নেই। আমাদের ধর্মগুলো অবশ্যই যথেষ্ট নারীবান্ধব নয়; তবুও এ উপমহাদেশের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে আমরা নারীকে পরম পূজনীয় ও আরাধ্য বিষয় হিসেবেই মেনে এসেছি জীবনের গভীরতর উপলব্ধি থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা থেকে। কিন্তু সে সংস্কৃতির উত্তরাধিকার এখন বিলুপ্তির পথে; পরম পূজনীয়া মা, আদরের বোন, স্নেহের কন্যা কিংবা প্রিয়তমা প্রেয়সী- কারও প্রতিই এখন আর আমাদের শ্রদ্ধা বা অকৃত্রিম ভালোবাসার বোধ জাগ্রত হয় না; যদি হতো, তাহলে ঘর থেকে বেরিয়ে পথ চলতে সামনে পড়া মেয়েটিকে কেউ উত্ত্যক্ত করতো না। স্বামী-সন্তান-পরিবার-পরিজনের সামনে একজন নারীকে ধর্ষণ করতো না। যৌন হয়রানির শিকার মেয়েটি অভিযোগ করলে তাকে আগুনে পুড়িয়ে মারতো না।
আশঙ্কার কথা হচ্ছে, নারীর প্রতি সহিংসতার উদাহরণ টানতে ঘরের বাইরে বেরোতে হয় না; বাবা-ভাই-স্বামী-মামা-চাচা-শ্বশুর-ছেলেবন্ধু- কারও কাছে নারী নিরাপদ নয়; দুই মাসের শিশু থেকে অশীতিপর- কেউই পুরুষের সহিংসতার ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয় - এমনকি মায়ের গর্ভেও কন্যাশিশুর জীবনের নিরাপত্তা নেই!
নারী আর পুরুষ দুটো ভিন্ন ব্যক্তি কেবল; কিন্তু এই দুয়ে মিলে এক সত্তায় রূপান্তরিত হলে যে অপার্থিব সৌন্দর্য তৈরি হয়, এ দুয়ের অন্তরাত্মার সম্মিলনে যে দ্যোতনা সৃষ্টি হয়, সেই অনুভূতি আস্বাদনের মতো বোধ আজ পুরুষের লোপ পেয়েছে; পুরুষ এই সমাজকে কেবল তার নিজের জন্যে তৈরি করেছে- এখানে নারীর স্থান প্রান্তিক; নারীর কাজ এখানে কেবল পুরুষের দাসত্ব করা, তার যাবতীয় চাহিদা মেটানো - এমনকি তা বিকৃত হলেও। নারীর শরীরের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেয়ে তার মনের ওপর অধিকার অর্জন করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানের বিষয়, পুরুষকে সেটি বুঝতে হবে।
পুরুষ আজ এমন এক সমাজ সৃষ্টি করেছে, যেখানে নারী মোটেও নিরাপদ নয়; নারী এখানে পুরুষের দ্বারা বৈষম্যের শিকার, পুরুষের বিদ্বেষের শিকার। মনোজগতের গহীনে তীব্র ঘৃণা আর বিদ্বেষ না থাকলে কোনো পুরুষ নারীর প্রতি এতো সহিংস হতে পারে না; ধর্ষণ, ধর্ষণের সময় বা পরে নারীর স্তনে কিংবা যোনিতে নিদারুণ আঘাতের মাধ্যমে ক্ষত ও বিকৃতি ঘটানো, আগুন দিয়ে পোড়ানো... যে যোনির কারণে পুরুষের জন্ম আর যে স্তন থেকে দুধ পান করে তার বেঁচে থাকা- নিতান্ত বিদ্বেষ ছাড়া সেইসব অংশে কেউ এমন বিকৃত নিপীড়ন চালাতে পারে না।
কিন্তু একজন নারীর গর্ভে জন্মে কেন সেই নারীর প্রতিই পুরুষের এমন ক্ষোভ, বিদ্বেষ, বিকৃতি? কারণ অনুসন্ধান করা দরকার। মনোবিজ্ঞানী, সমাজতাত্ত্বিক, নৃতত্ত্ববিদ, ধর্মীয় নেতা বা দার্শনিক- নানাজন নানাভাবে দেখেন নারী-পুরুষের মধ্যকার সম্পর্ককে। তাদের নানাবিধ মতের সারমর্ম হলো, বিবর্তনের ধারায় পুরুষ একসময় নারীর ওপর কর্তৃত্ব করার সুযোগ পেয়ে গেছে। যারা ধর্মে বিশ্বাসী, তাদের মতে স্রষ্টা নিজেই পুরুষকে নারীর ওপর কর্তৃত্ব করার এই ‘অধিকার’ দিয়েছে কেননা নারীর চেয়ে পুরুষ ‘শ্রেষ্ঠতর’। (অত্যাচার, নিপীড়ন, ধর্ষণ এই ‘শ্রেষ্ঠত্বের’ কারণ না ফল- ঠিক বুঝতে পারি না!)
আসলে, ঐতিহাসিকভাবে নারীর ওপর কর্তৃত্ব ফলানোর সুযোগ পাওয়ার পর থেকে পুরুষ ‘প্রভুত্বের’ স্বাদ পেয়ে গেছে; এই স্বাদ এক নেশার মতো। নারীকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া থেকে শুরু করে বৈধ-অবৈধ-নিরীহ-নৃশংস সব উপায়ে নারীকে ‘ভোগ’ করার ও নিপীড়ন করার নেশা কাটিয়ে উঠতে পারে না তারা। নারী এই সমাজের অর্ধেক অংশ এবং তারও অধিকার পুরুষের ঠিক সমান- এই সত্যটুকু মানতে পারে না পুরুষেরা; এই সত্যটি মেনে নিলে সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি-অর্থনীতি থেকে শুরু করে ব্যক্তিজীবনে নারীর ওপর কর্তৃত্বের যে ‘সুফল’ পুরুষ একচ্ছত্রভাবে ভোগ করে আসছে বহু-সহস্র বছর ধরে, সেখানে তাদের অনেককিছুতেই কাটছাঁট করতে হবে। মাতালের হাত থেকে মদের বোতল কেড়ে নিলে সে যেমন উন্মাদের মতো আচরণ করে, একই অবস্থা এই সমাজের পুরুষদের; নারীর ক্ষমতায়নকে এরা মৃত্যুর চেয়েও বেশি ভয় করে। সেই ভয় থেকে পুরুষের মনে নারীর প্রতি তীব্র বিদ্বেষ কাজ করে; আর এই বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ হলো নারীর ওপর নানা ধরনের সহিংসতা।
নারীর ক্ষমতায়নকে পুরুষ তার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারলে তাকে সমর্থন করে। আর যদি দেখে, এতে তার কোনো স্বার্থ হাসিল হচ্ছে না, তখন সে ‘ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স’ বা হীনম্মন্যতায় ভোগে; তখন সে নারীর ক্ষমতাকে ঘৃণা করে। এই ঘৃণা ভয়সঞ্জাত; ফলে সেটি ক্রমেই বিদ্বেষের মতো বিকৃতির রূপ নেয়। সেই ‘আদিম সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা’র পর পুরুষ নারীকে তার পরিপূরক হিসেবে ভাবতে ভুলে গেছে; নারীকে এখনো পুরুষ তার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে।
নারীর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব নয়, বরং নারীর প্রতি পুরুষের রয়েছে সীমাহীন ঋণ; একজন নারীই নিজের শরীরে পুরুষকে ধারণ করে এই পৃথিবীতে তার আগমন নিশ্চিত করে, তাকে বাঁচিয়ে রাখে, পরম যত্নে তাকে বড় করে তোলে; আর এজন্যে নারী নিজের সব ধরনের আনন্দ-আয়োজনকে বিসর্জন দেয়। ফলে নারীর ওপর পুরুষের ‘শ্রেষ্ঠত্বের’ মতো পাগলামোর কোনো সুযোগ বা বৈধতাই নেই, বরং পুরুষ সবসময়ই একজন নারীর কাছে ঋণপাশে আবদ্ধ!
এই সত্যটুকু পুরুষের অনুধাবন করা জরুরি। না হলে, বিদ্বেষ বা আরও অনেক কারণে নারীর ওপর পুরুষ যে নিপীড়ন চালাচ্ছে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে কেবল নারীই এই সহিংসতার শিকার হচ্ছে, কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে পুরুষও যে কি নিদারুণ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে প্রকৃতির বিচারে, পুরুষ তা এখনও জানে না। এটি জানা খুব দরকার। তাহলে নারীর চেয়ে বেশি পুরুষেরই মঙ্গল হবে।
এজন্যে পুরুষকে আগে নারী-পুরুষের মধ্যকার সম্পর্কের ব্যাপারে সৎ হতে হবে, শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। নারী যে পুরুষের চেয়ে মোটেই ক্ষুদ্রতর সত্তা নয় এবং নানা কারণে বরং পুরুষের চেয়ে বৃহত্তর, তা স্বীকার করে নেয়ার মতো মানসিকতা তৈরি করতে হবে। নারী অনেক কারণেই পুরুষের চেয়ে মহত্তর এবং পুরুষের জন্যে অগুণতি কারণেই অপরিহার্য- পুরুষকে তা বুঝতে হবে। পুরুষের নিজের মঙ্গলের জন্যেই নারীকে শ্রদ্ধা করা দরকার। নারী তার প্রতিদ্ব›দ্বী নয় বরং সহযোগী ও পরিপূরক, পুরুষের তা বোঝা দরকার। হাজারো বছর ধরে নারীর প্রতি চলমান বৈষম্য ও সহিংস আচরণের জন্যে পুরুষকে লজ্জায় নারীর পদতলে আত্মসমর্পণ করতে হবে; ‘পুংদণ্ডের’ যথেচ্ছ ব্যবহারের মধ্যে কোনো বীরত্ব নেই, পৌরুষ নেই; নিপীড়ক হওয়ার মধ্যে কোনো গৌরব নেই; সমানুভূতি ও শ্রদ্ধাবোধ না থাকলে কেবল ‘পুরুষ’ হওয়া যেতে পারে, ‘মানুষ’ হওয়া যায় না।
পুরুষ যেদিন নারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধায় আনত হবে, সেদিনই বন্ধ হবে নারীর প্রতি সহিংসতা; এর আগে নয়। আইন করে নয়, সেমিনার করে নয়।

লেখক : সজীব সরকার, সহকারী অধ্যাপক; জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ; স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। লেখক ও গবেষক।
ই-মেইল : [email protected]