ঢাকা, শনিবার ২০, এপ্রিল ২০২৪ ৪:২১:৩১ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
হাসপাতালের কার্ডিয়াক আইসিইউ পুড়ে ছাই, রক্ষা পেল ৭ শিশু সবজির বাজার চড়া, কমেনি মুরগির দাম সারা দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি কৃষক লীগ নেতাদের গণভবনের শাক-সবজি উপহার দিলেন প্রধানমন্ত্রী চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি, হিট এলার্ট জারি শিশু হাসপাতালের আগুন সম্পূর্ণ নিভেছে

নুহাশ পল্লীর নির্জনে : বিউটি হাসু

বিউটি হাসু | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৯:০২ পিএম, ১৩ নভেম্বর ২০১৯ বুধবার

নুহাশ পল্লী

নুহাশ পল্লী

‘চলো না যাই/বসি নিরিবিলি/দুটি কথা বলি নিচু গলায়।/আজ তোমাকে ভোলাবোই আমি/আমার মিষ্টি কথামালায়।’

হ্যাঁ, মিষ্টি কথার ফুলঝুরিতে কারও মন ভোলাতে না পারলেও ‘নুহাশ পল্লী’র শান্ত ও নীরব পরিবেশ হৃদয়ে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেবে। পাশে প্রিয়জন কেউ থাকুক আর না-ই থাকুক চারপাশের স্নিগ্ধ-শ্যামল রূপ এক নির্মল আনন্দে মনকে আবিষ্ট করে রাখবে সারাদিন। কী এক অদ্ভুত ভালো লাগা বুকের ভেতর দোল দিয়ে যাবে, লিখে বোঝানো সম্ভব নয়।

দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। সহকর্মী ফাল্গুনীকে নিয়ে রওনা হলাম ঢাকার যানজট ছাড়িয়ে কোলাহলমুক্ত নুহাশ পল্লীর একান্ত নিরিবিলি, নির্জন পরিবেশে। ফাল্গুনীর মা, খালাম্মাও আমাদের সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। গাজীপুর জেলার হোতাপাড়ায় পিরুঝালীর নিবিড় অরণ্যে নূহাশ পল্লী’ অবস্থিত। যেখানে কোনো গাড়ির শব্দ নেই, শুধু কান পেতে শোনা যায় সবুজ বৃক্ষরাজির মধ্যে লুকিয়ে থাকা পাখির কলকাকলি। বৃক্ষের শ্যামল ছায়ায়, বিশুদ্ধ বাতাসে শরীর শীতল হবে, স্নিগ্ধ-সতেজ আবেশে মন হবে মুগ্ধ; তেমনি সারি সারি গজারির সবুজ রূপ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।

ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহর ছেড়ে আমরা জয়দেবপুর পৌঁছলাম সকাল ৮টার দিকে। সেখান থেকে ২০ কিলোমিটারের মতো দূরে ‘নুহাশ পল্লী’। গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে হোতাপাড়া বাজার। সেখান থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে পিরুঝালী গ্রামে অবস্থিত ‘নুহাশ পল্লী’।

প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ তার মনের মাধুরী মিশিয়ে ‘নুহাশ পল্লী’র শৈল্পিক রূপ দিয়েছেন। একজন মানুষের স্বপ্ন কত তীব্র, কল্পনাশক্তি কত শক্তিশালী হলে এত সুন্দর বাসস্থান গড়া সম্ভব, নিজের চোখে না দেখলে তা বিশ্বাস করা যায় না! ১৯৯৭ সালে হুমায়ূন আহমেদ ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৪০ বিঘা জায়গা নিয়ে তৈরি করেন ‘নুহাশ পল্লী’।

‘নুহাশ পল্লী’র প্রধান ফটকের ডান পাশে মা-ছেলের সাদা ভাস্কর্য কিছুক্ষণের জন্য আপনার গতিরোধ করবে। আরেকটু সামনে এগুলেই সুইমিং পুল, পাশেই একটি বিশাল ড্রাগনের প্রতিমূর্তি। সেই সঙ্গে নানা রঙের ফুল ও গাছের ছায়ায় ঘেরা একটি দৃষ্টিনন্দন ভবন, যে ভবনটিতে কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ ঘুমাতেন। সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বাসভবনের জানালার পাশে হাতে ফলের ডালি নিয়ে দাঁড়ানো সুন্দরী রমণীর চিত্রমূর্তি (প্রতিচিত্র) নুহাশ পল্লীতে আগত উৎসুক, ভ্রমণপিপাসু দর্শনার্থীদের উদ্দেশে যেন বলছে-
‘ফুলের অঞ্জলি হাতে
ছুঁয়ে দিতে দাও
যেও না, যেও না;
একটু দাঁড়াও!
একটুখানি বসে যাও।’

পাশেই বসার টেবিল ও চেয়ার পাতা রয়েছে। ভবনের পাশেই রয়েছে ছোট্ট একটি পুকুর। পুকুরের পাশে দাঁড়ানো তাম্রবর্ণের মূর্তিটি যেন হাত উঁচিয়ে দুষ্টু ছেলের দলকে সাবধান করছে- খবরদার! পুকুরে ঢিল ছুড়বে না।’

সামনের দিকে যতই এগোচ্ছি, ততই অনুভব করছি শৈল্পিক হুমায়ূন আহমেদকে। সামনে সুপ্রসারিত মাঠ, যেন সবুজ কার্পেটে মোড়ানো। মাঠের একপাশে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন। সেই শোকে কাতর গাছের পাতাগুলো উদাস, ভাবলেশহীন। যেন অবনত মস্তকে প্রার্থণায় রত। নুহাশ পল্লীর পশ্চিম পাশের দেয়াল ঘেষে সমাধি। চারদিকে কাঁচের দেয়াল। ভেতরে অনেকটা জায়গা নিয়ে শ্বেত পাথরের সমাধি। মাথার পাশে কাঁচের উপর হুমায়ূন আহমেদের স্বাক্ষর করা ফলক। পুরো জায়গা জুড়ে সুনশান নিরবতা। এই চত্বরের প্রতিটি ধূলিকণা-বালুকনায়, সবুজ ঘাসে, জলে-স্থলে,পাখির কূজনে, বিশুদ্ধ বাতাসে যেন সবার প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ মিশে আছেন।

চোখ জুড়ানো সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো বিস্তৃত মাঠ। মাঠের মাঝখানে একটি গাছ, যে গাছটির ওপর দুটি ছোট ছোট কাঠের ঘর। কতটা রসিক মনের, ব্যতিক্রম চিন্তার অধিকারী হলে এমন মজার চিন্তা মাথায় আসে! যে গানের কথা দিয়ে লেখাটি শুরু করেছি, সেই গানটি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হুমায়ূন আহমেদের লেখা- ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ ছবির। এই গানটি ছবির নায়িকা গাছটির সঙ্গে লাগোয়া কাঠের সিঁড়িতে বসেই গান। আর নায়ক গাছের ছোট ঘরে বসে বই পড়তে থাকে।

আরও একটু সামনে এগুলে ডানে আরেকটি ভবন ‘বৃষ্টিবিলাস’, যেখানে শুটিং করতে গিয়ে ইউনিটের লোকজন থাকতেন। এখন ভবনটিতে কর্মচারিরা থাকেন। সামনে নানা প্রজাতির গাছ লাগানো রয়েছে।

মনোরম নির্জন প্রাকৃতিক পরিবেশে ৪০ বিঘার এ বাগান বাড়িতে ফল, কাঠ ও ভেষজ গুণাবলীর কয়েকশত প্রজাতির গাছ রয়েছে। এখানে ২৫০ প্রজাতির দূর্লভ ঔষধি, মসলা জাতীয়, ফলজ ও বনজ গাছ রয়েছে। প্রতিটি গাছের গায়ে নাম এবং বৈজ্ঞানিক নামও লেখা রয়েছে, সেটে দেয়া আছে পরিচিতি ফলক, যা দেখে গাছ চেনা যাবে সহজেই। শিক্ষার্থীদের অনেক কিছু শেখার রয়েছে। বিশেষ করে উদ্ভিদ বিজ্ঞানে যারা পড়াশোনা করে, তাদের জন্য বেশি জরুরি।

গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট পুকুর। যেদিকে তাকালে মৎস্যকন্যার কৃত্রিম রূপে চোখ আটকে যায়, কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে হয়। পাশেই রয়েছে ভয়ঙ্কর ড্রাগনের মূর্তি, যা বাচ্চাদের আনন্দ দেবে।

একটুখানি সামনে হাঁটলে জিরাফ, সজারুসহ বিভিন্ন প্রাণীর মূর্তি। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত লাগলে একটুখানি বসতে পারেন পাশেই সিমেন্টের তৈরি গোল চত্বরে, কিংবা আরও বেশি মজা পেতে হলে দোলনায় বসে হাওয়ায় দোল খেতে পারেন।

আরেকটু সামনে ‘লীলাবতী দীঘি’। ‘লীলাবতী দীঘি’র পাশে সিমেন্টে খোদাই করা লেখা রয়েছে-
‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে
রয়েছে নয়ন নয়নে।’

দীঘির ওপর রয়েছে একটি কাঠের সুন্দর ব্রিজ বা সেতু, রয়েছে সানবাধানো ঘাট, চারপাশে সারি সারি সবুজ গাছ।

এমন মনোহর দৃশ্য অবলোকনে কার মন না আকৃষ্ট হবে! দীঘির স্বচ্ছ জলে গাছের ছায়া পড়ে এক মায়াবী দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। দীঘির জলের সঙ্গে সবুজ গাছের যেন গভীর মিতালি হয়েছে-এ রূপ সত্যিই তুলনাহীন! দুর্নিবার ইচ্ছে ছিল ‘লীলাবতী’র টলমলে পানিতে একটু পা ভেজাতে, কিন্তু- পানি সিঁড়ির নিচে নেমে যাওয়ায় সম্ভব হলো না।

দীঘির পাড়ে পাশেই ‘ভূতবিলাস’ভবনটি আপনার দৃষ্টি কাড়বে। অন্যপাশে শুটিংয়ের জন্য একটি মাটির ঘরও রয়েছে।

নুহাশ পল্লী শুধু খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক, স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্নপুরী নয়, আমাদের সবার শান্তির পটভূমি। তাই ‘নুহাশ পল্লী’ রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং সম্মিলিতভাবে আমাদের সবার।

আর একুশে বইমেলায় তার বইয়ের জন্য ভক্ত পাঠকদের উপচে-পড়া ভিড় দেখা যাবে না, তার বইয়ের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানোর সুযোগ হবে না। আমরা তার মজার সাহিত্যকর্ম থেকে বঞ্চিত হব; কিন্তু তার সৃষ্টি ও কর্মের প্রতি যত্নবান হয়ে আমরা তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে পারি। তার সৃষ্টি ও স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার।

এইতো কয়েকটি ‘একুশে বইমেলা’ শেষ হলো। কিন্তু পাঠকরা তাদের প্রিয় লেখকের বহুকাঙ্খিত বই পড়ার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হলো। তাঁর হাতের লেখার যাদুস্পর্শে বাংলা সাহিত্যের ভূমি যেমন উর্বর হয়েছে, তেমনি তিনি যাই লিখছেন- তার লেখায় সোনা ফলেছে। তাঁর হাতের ছোঁয়ায় সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে জীবন্ত। সাধারণ মধ্যবিত্তের মানুষের মনের কথা কতো সহজে তিনি তুলে ধরেছেন,বাধাহীন-দ্বিধাহীনভাবে হাস্যরস মেখে অবলীলায় প্রকাশ করেছেন। তাইতো তিনি চির স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন, থাকবেন পাঠকের অন্তরে।

নুহাশ পল্লীর ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম বুলবুল জানান, কবর জিয়ারত করতে আসা লোকজনের জন্য আলাদাভাবে রাস্তা ও সীমানা নির্ধারণ করে বেড়া দেয়া হলেও দর্শনার্থীরা নুহাশ পল্লীতে জোর করে প্রবেশ করতে চায়।

তিনি আরও বলেন, দর্শনার্থীদের অনেকে বাইরে থেকে খাবার ও পানীয় সামগ্রী এনে ভেতরের পরিবেশ নোংরা করছেন। পয়োনিস্কাশনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় যত্রতত্র প্রস্রাব-পায়খানা করে পরিবেশ দূষিত করছেন। এর ফলে ভেষজ উদ্ভিদ বাগানের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। কেউ কেউ গাছের পাতা তুলে ফেলছে কিংবা গাছও উপড়ে দিচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

কিন্তু এ ধরনের অসৌজন্যমূলক আচরণ আমাদের কারও কাম্য নয়। নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে যারা শ্রদ্ধা করেন, তার লেখাকে যারা সত্যিকার অর্থে ভালোবাসেন তাদের পক্ষে এ রকম কাজ করা সম্ভব নয়। আমাদের সবার উচিত ‘নুহাশ পল্লী’র যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণে ও দেখভালের কাজে নিয়োজিত কর্মচারীদের সাহায্য করা। এটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

যেভাবে যাবেন :  গুলিস্তান থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত বাসে যেতে লাগবে ৭০-৯০ টাকা। এরপর টেম্পোতে ‘নুহাশ পল্লী’ পর্যন্ত যেতে লাগবে ৫০-৭০ টাকা। আসা-যাওয়ার জন্য ৪০০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকা। ১২ বছরের উপরে জনপ্রতি টিকেট লাগবে ২০০ টাকা। ৫০০-৬০০ টাকা পকেটে ভরে বেরিয়ে পড়তে পারেন ‘নূহাশ পল্লী’র শান্ত রূপ-মাধুর্যে চোখ জুড়াতে, মন ভরাতে। তাহলে আর দেরি কেন?

নুহাশ পল্লীর ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বুলবুল জানান, এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত নুহাশ পল্লী সকল দর্শনার্থীদের জন্য প্রতিদিন খোলা থাকে।  কিন্তু নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত মূলত পিকনিকের জন্য ভাড়া দেয়া হয়।

(লেখাটি শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষে প্রকাশিত)

বিউটি হাসু : লেখক ও সাংবাদিক