ঢাকা, শুক্রবার ২৯, মার্চ ২০২৪ ১৩:১৩:৪০ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
টাঙ্গাইলে শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তাঁতীরা রমজানের অর্ধেকেও কমেনি মাছ ও মাংসের দাম সেতু থেকে খাদে পড়ে বাসে আগুন, নিহত ৪৫ রমজানের অর্ধেকেও কমেনি মাছ ও মাংসের দাম ঈদযাত্রা: ৮ এপ্রিলের ট্রেনের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে আজ বিশ্বে প্রতিদিন খাবার নষ্ট হয় ১০০ কোটি জনের বাসায় পর্যবেক্ষণে থাকবেন খালেদা জিয়া

বহুরূপী মন, স্মৃতি-বিস্মৃতি ও ফেলে আসা দিন

সোমা দেব | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৫:২৭ পিএম, ১৪ জুন ২০২১ সোমবার

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ছবিটি তুলেছেন লেখক

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ছবিটি তুলেছেন লেখক

বড় রাস্তা থেকে গলি পেরিয়ে আমাদের বাড়িতে ঢুকলেই প্রথমেই চোখে পড়ত একটা বিশাল জবা ফুলের গাছ। ঠাকুরঘর লাগোয়া জবা ফুলের গাছটি ছাতার মত উঠোনের অনেক খানিই জুড়ে থাকত। থোকা থোকা রক্তজবা ফুলে লাল হয়ে থাকত গাছটা। ঠাকুমা লম্বা কোটা দিয়ে ফুল পেড়ে পুজো করতেন। 
মাঝে মাঝে বাবু  লাল লাল লিচু এনে সেই গাছে ঝুলিয়ে বলতেন, ' মনা, দেখ, জবা গাছে লিচু ধরেছে।' আমি বুঝেও না বোঝার ভান করে মজা করতাম আর কোটা দিয়ে জবা ফুল গাছ থেকে লিচু পেড়ে খেতাম। জ্যাঠা ঠিক চৈত্র মাসে তরমুজ এনে বড়মার হাতে দিতেন। আমি চাইলে দুষ্টুমি করে বলতেন, 'এটা তো তরমুজ না,  চালকুমড়া।' আমি কান্না শুরু করলে বলতেন, 'শুধু মনার জন্য একটা পিস তরমুজ হয়ে গিয়েছে, বাকি টা চালকুমড়া' বলে দোকান থেকে চারকোণা করে কেটে আনা তরমুজের পিস হাতে তুলে দিতেন।  
এই চৈত্র মাসেই যখন বাসন্তী পূজা হতো, সেই পূজার অষ্টমীর দিন আমাদের শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ব্রহ্মপুত্র নদীতে পূণ্যস্নান হতো। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসতো স্নান করতে। আমাদের বাড়ি অতিথিতে ভরপুর হয়ে থাকত। শুধু তো আমাদের বাড়ি নয়, পাড়ার যে কয়টা বাড়ি মিলে আমরা একটি পরিবার হয়ে থাকতাম সব বাড়িতেই আসতো অতিথি। সেই সময়টা খুব আনন্দের। পিসতুতো, কাকাতো, মামাতো, মাসতুতো ভাই-বোনে ভরে থাকতো ঘরবাড়ি, কত খেলার সাথি!
এই অষ্টমীতে সবার বাড়ি ঘুরে ঘুরে অভিনয়, নাচ দেখাতো বহুরূপী। খুব সম্ভবত সরিষাবাড়ি অথবা ইসলামপুর থেকে আসতেন একজন বহুরূপী। আমার জন্মের বহু আগে তিনজন বহুরূপী আসতেন, এমনটা শুনেছি। একজন গুরু, বাকি দু'জন শিষ্য। উনারা পরে বিক্ষিপ্ত হয়ে উপার্জন শুরু করেন। আমি একজনকেই দেখেছি। ভীষণ লম্বা, ঘাড় পর্যন্ত চুলের একজন পুরুষ শাড়ি পরে, কপালে-সিঁথিতে লাল টকটকে সিঁদুর দিয়ে নানা রকম নাচ দেখাতেন। কখনো ঝাড়ুদার সেজে বাড়ি ঝাড় দেওয়া শুরু করতেন, কখনো পুতুল দিয়ে বাচ্চা কোলে নিয়ে ঢুকতেন, কখনো বাবুর্চি সেজে আসতেন। অনর্গল হিন্দিতে কথা বলে যেতেন অবাঙালীদের মতো। আমাদের বাড়ির টকটকে লাল জবা গাছের তলায় টকটকে সিঁদুর পরা বহুরূপীর নাচ দেখতে সব বাড়ির মা-পিসি-দীদা-কাকী-জ্যাঠিমা আর আমরা ছোটরা গোল হয়ে ঘিরে থাকতাম। তারপর অষ্টমী উপলক্ষে তৈরি নাড়ু, মুড়কি, তক্তি খেয়ে, টাকা নিয়ে পাশের বাড়িতে যেতেন।  সাথে আমরাও দৌড়াতাম।  
সেই অষ্টমীকে ঘিরে আমাদের শহরে মেলা বসতো। অষ্টমী-নবমী-দশমী তিন দিনই মেলা চলতো। এমন কোন জিনিস নেই যা সেই মেলায় পাওয়া যেত না। সবাই বলতো অষ্টমীর মেলা। এই উৎসব-পরবে মেলায় গিয়ে খেলনা কেনার জন্য আমাদের দেওয়া হতো 'পরবী'। আমরা ছোটরা পুতুল খেলা, রান্নাবাটি খেলার নানা সরঞ্জাম কিনে রাখতাম এই মেলা থেকেই। বড়রাও সারা বছরের সিঁদুর, শাঁখাপলা, কাঁসা-পিতলের বাসন, দা-বটি, পূজার সরঞ্জাম সব কেনার জন্য অপেক্ষা করে থাকতেন অষ্টমীর মেলার জন্য। আর মুড়ি, মুড়কি, মুরালী, পাঁপড়, চিনির সাজ তো আছেই। অনেকটা গ্রামের মেলার মতো। 
একটা ঘটনা বলি। প্রায় দশ বছর আগে আমার এক সাবেক কলিগ গল্প করছিলেন, "সোমা জানো, আমার বাসায় কাজের জন্য এক মেয়ে নিয়ে আসছি গ্রাম থেকে। মেয়েটা খুব 'সাজুনি'। যদি জিজ্ঞেস করি, এই মালা, কানের দুল কোত্থেকে কিনছো? বলে, আড়ং থেকে কিনছি। যেটাই জিজ্ঞেস করি, বলে আড়ং থেকে কিনছি। এই মেয়ে কি আড়ং চিনে? তুমি জানো, আড়ং মানে কী?"  আমি হেসে বললাম " হ্যাঁ। জানি। বিপনী, বড় বাজার, দোকান। আবার গ্রামের মেলাকেও আড়ং বলে।" উনি বললেন, "আমি অনেক পরে জেনেছি।" দুজনেই হাসলাম। 
আবার সেই বহুরূপীর কথা বলি। অনেক দিন পর,  তখন চৈত্র মাস নয়, অষ্টমী নয়, মেলাও নয়। ঘোর বর্ষাকাল। খুব মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। হঠাৎ একটা ময়লা পাঞ্জাবি আর ছেঁড়া লুঙ্গি পরে গলি দিয়ে আমাদের বাড়িতে ঢুকলেন সেই বহুরূপী । সেদিন আর বহুরূপীর পোশাক নেই পরনে। খুব কাঁদছিলেন আর মুখ থেকে লালা ঝরছিল অনবরত। হয়ত কোন কঠিন অসুখ হয়েছিল। বড়মা তাড়াতাড়ি ভাত দিলেন খেতে। উনি খেতে পারছিলেন না। ভাত হাতে নিয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন, তেমন কোন কথা বলতে পারছিলেন না। এই দৃশ্যটা মনে গেঁথে গিয়েছে চিরদিনের জন্য। পরের অষ্টমীতে আর উনি আসেননি জবা গাছের নিচে নেচে গেয়ে সবাইকে আনন্দ দিতে। আমরা পরে জানতে পেরেছি, এখান থেকে যাওয়ার কয়েকদিন পরই মারা গিয়েছেন উনি।