ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৮, মার্চ ২০২৪ ১৮:২৮:০৮ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
বিশ্বে প্রতিদিন খাবার নষ্ট হয় ১০০ কোটি জনের বাসায় পর্যবেক্ষণে থাকবেন খালেদা জিয়া ট্রেনে ঈদযাত্রা: ৭ এপ্রিলের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু গাজায় নিহত বেড়ে ৩২ হাজার ৪৯০ অ্যানেস্থেসিয়ার ওষুধ বদলানোর নির্দেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঈদ কেনাকাটায় ক্রেতা বাড়ছে ব্র্যান্ড শপে বাঁচানো গেল না সোনিয়াকেও, শেষ হয়ে গেল পুরো পরিবার

মঞ্চ মাতানো কাঙালিনী সুফিয়ার দিন কাটে হাসপাতালের শয্যায়

সাদেকুর রহমান | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০১:১৭ এএম, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮ বুধবার

“যখন রাজধানীর শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ভর্তি করানো হয় তখন তিনি কথা বলতে পারতেন না। টানা সাতদিনের নিবিড় পরিচর্যায় এখন কথা বলতে পারেন, কিছু খাওয়া-দাওয়াও করছেন। আগের চেয়ে মায়ের অবস্থা ভালো।”- মেয়ে পুষ্প তার মা সম্পর্কে এভাবেই সর্বশেষ তথ্য জানাচ্ছিলেন।

এই ‘মা’ হলেন কাঙালিনী সুফিয়া। কিংবদন্তীর লোকসঙ্গীত শিল্পী কাঙালিনী সুফিয়া। তাঁর বেশ কিছু দাঁত না থাকলেও তেজস্বীতার কাছে হার মানে সবাই। ভাঙ্গা চোয়ালেই তিনি জয় করেছেন বাংলাদেশের সব শ্রেণির সঙ্গীতপ্রেমীর হৃদয়, মাত করেছেন বিশ্ব। একতারা আর প্রেমজুড়ি হাতে সেই বাংলা লোকসঙ্গীত সম্রাজ্ঞী আবারও মঞ্চ মাতাবেন, সেই প্রত্যাশা সকলের। তিনি গাইবেন, শ্রোতা-দর্শনার্থীদের গাওয়াবেন। বাংলা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে দুরন্ত কিশোরী বালিকার মতো তাঁর সরব হয়ে উঠার প্রতীক্ষায় ভক্তরা। 

গণমাধ্যমে খবর বেরোয়, কাঙালিনী সুফিয়া হাসপাতালে, একই সাথে অর্থাভাবে তাঁর চিকিৎসা বন্ধের উপক্রম। যা দেখে কেবল কাঙালিনীভক্তরাই নন, লোকসঙ্গীতপ্রেমী মাত্রই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। বিষয়টি নজরে আসে সরকারেরও। 
গত ১১ ডিসেম্বর সকালে কয়েকজন লোক অ্যাম্বেুলেন্স নিয়ে হাজির হন এনাম হাসপাতালে। শিল্পীর মেয়ে পুষ্পকে তারা বলেন, তারা প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে এসেছেন। কাঙালিনী সুফিয়ার উন্নততর চিকিৎসার জন্য বিএসএমএমইউতে নেওয়া হবে। এতে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো শিল্পীর পরিবার, কারণ তারা চিকিৎসার খরচ কীভাবে চলবে তা নিয়ে ভীষণ চিন্তার মধ্যে ছিলেন। সরকার চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ায় সে দুশ্চিন্তা কেটে গেছে এবং এখন  সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা পাবেন কাঙালিনী। বর্তমানে অধ্যাপক রফিকুল আলমের তত্ত্বাবধানে বিএসএমএমইউর কেবিন ব্লকের ২১৬ নম্বর শয্যায় তাঁর চিকিৎসা চলছে। 

কাঙালিনী সুফিয়া বাংলাদেশ ও লোকসঙ্গীত শিল্পের এক বিরল সম্পদ। তাঁর মৌলিক চাহিদা পূরণ, চিকিৎসার ব্যবস্থা ও যত্ন আত্তির দায়িত্ব অবশ্যই রাষ্ট্র, সরকারের উপরও বর্তায়। পরিবারের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, সরকারিভাবে ঘর-বাড়ি করে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়ে থাকে। শিল্পীর ওষুধপত্র কিনতেই এ টাকা চলে যায়। এখন চারটা ডাল-ভাত খেতে গিয়ে হয়ে পড়েছেন দেনাগ্রস্ত। 

প্রায় এক দশক ধরেই নানা অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত লোকগানের এই সাধক শিল্পী। বছর কয়েক আগে সড়ক দূর্ঘটনায় আহত হলে অর্থাভাবে তা পুরোপুরি সেরে উঠেনি। গত ৪ ডিসেম্বর সাভার পৌরসভার জামসিং এলাকার নিজের বাড়িতে হঠাৎ বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন ক্ষীনাঙ্গী এই শিল্পী। স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়ায় তিনি কাউকে চিনতে পারছিলেন না। রক্তচাপ বেশি থাকার কারণে বেশ কয়েকবার বমিও করেন। মাথা ও গলায় প্রচন্ড ব্যথা ছিল। ওইদিনই দ্রুত রাত আটটার দিকে তাঁকে স্থানীয় ব্যক্তিমালিকানাধীন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রথমে কেবিনে দেওয়া হলেও অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাঁকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (সিসিইউ) রাখা হয়। শিল্পীর শারীরিক অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হচ্ছিল না।

পুষ্প চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে জানান, তার মায়ের মস্তিষ্কের রক্ত চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। বর্তমানে শরীরে রক্তের পরিমাণ অনেকটা কম। কিডনিজনিত নানা জটিল রোগ তাঁকে আঁকড়ে ধরেছে। 

এছাড়া সম্প্রতি একটি পরীক্ষায় তাঁর হৃদযন্ত্রের কার্যক্রম কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। আর শিল্পীকে বিএসএমএমইউতে আনার পর নতুন সাতটি পরীক্ষা করানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে চারটি করানো সম্পন্ন হয়েছে বলে জানান পুষ্প।   

‘পরাণের বান্ধব রে বুড়ি হইলাম তোর কারণে’, ‘কোন বা পথে নিতাইগঞ্জে যাই’, ‘আমার ভাটি গাঙের নাইয়া’, ‘নারীর কাছে কেউ যায় না’, ‘লাউয়ের পিছে লাগছে বৈরাগী’সহ অনেক জনপ্রিয় গানের শিল্পী কাঙালিনী সুফিয়া। অভাব-অনটন আর রোগ-ব্যাধির মধ্যেও গানই সঙ্গী তাঁর। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বঞ্চিত এই শিল্পী মুখে মুখেই গানের পয়ার তৈরি করেন এবং নিজেই তাতে সুর ও কন্ঠ দেন। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে তাঁর বহু গান তুমুল জনপ্রিয়। তাঁর গান গেয়ে অন্যরাও হিট হয়েছেন এমন নজিরও আছে। মর্মভেদী সব গানের সুবাদে তিনি নির্বিশেষে শ্রোতাদের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে তাঁকে খুবই কম দেখা যেত অনুষ্ঠানে। হালকা-পাতলা গড়নের মানুষটির কন্ঠ যে কত তেজস্বী ছিল তা শ্রোতা মাত্রই জানা। কিন্তু এখন হাসপাতালের শয্যায় নির্লিপ্ত দিন কাটছে তাঁর।  

কাঙালিনী সুফিয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬১ সালে রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দির অর্ন্তগত রামদিয়া গ্রামে। এক হতদরিদ্র জেলে পরিবারে। বাবা খোকন হালদার এবং মায়ের নাম টুলু হালদার। তাঁর পুরো নাম ছিল অনিতা হালদার, আর ডাক নাম বুচি। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। মাত্র ১৪ বছর বয়সে গ্রাম্য একটি অনুষ্ঠানে গান গেয়ে শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

বাবা-মায়ের ইচ্ছায় মাত্র ৭/৮ বছর বয়সে ঝিনাইদহের হাটফাজিলপুর এলাকার সুধির হালদার নামক এক বাউলের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু সংসার করার স্বপ্ন কুঁড়িতেই শেষ হয়ে যায়। স্বামীর নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে একমাত্র মেয়ে পুষ্পকে আট মাসের পেটে নিয়ে ঘর ছাড়েন কাঙালিনী। প্রথমে ভেবেছিলেন বাবার বাড়িতে যাবেন। কিন্তু অভিমান করে সেখানেও যাননি। বেছে নেন ভবঘুরে জীবন। এ সময় পরিচয় হয় বেলগাছির লালন সাধক দেবেন ক্ষ্যাপার সঙ্গে। দেবেনের কাছেই গানের প্রথম তালিম নেন সুফিয়া। এটা ছিল অন্যরকম জীবনযুদ্ধ।

তারপরই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের রানাঘাটের লালঘোলা ক্যাম্পে আশ্রয় নেন সুফিয়া। যুদ্ধের সময় ট্রাকে ট্রাকে, ক্যাম্পে ক্যাম্পে গান গাইতেন কাঙালিনী। মুর্শিদাবাদ, বহরমপুর, লাল ঘোলা, ভবনখোলা ও রানাঘাট ক্যাম্পে গান গেয়ে প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের উজ্জীবিত করতেন। 

স্বাধীনতার পর ১৭৭৮ সালে টুনি হালদার ওস্তাদ হালিম বয়াতির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ফরিদপুর কোর্টে ‘অনিতা হালদার’ নাম পরিবর্তন করে ‘সুফিয়া খাতুন’ নাম ধারণ করেন। এরপর তিনি ফরিদপুর জেলার প্রখ্যাত বয়াতি এনায়েত আলী’র কাছেও গান চর্চা করেন। এরই মধ্যে জীবন-জীবিকার তাগিদে রাজধানী শহর ঢাকায় পাড়ি জমান কাঙালিনী। প্রথমে মহাখালী এলাকায় ১০০ টাকা মাসিক ভাড়ায় একটি বাসা নেন। মেয়ে পুষ্পকে নিয়ে থাকতে থাকেন। এরপর হাইকোর্ট মাযার আর মিরপুরের শাহ আলী (র.) এর মাযারই হয়ে উঠে কাঙালিনীর ঘরবাড়ি। এখানে-ওখানে গান গাওয়ার ডাক এলে ছুটে যেতেন।

ওই সময় একদিন শিল্পকলা একাডেমির একটি অনুষ্ঠানে গান গাইতে যান তিনি। এরশাদ সরকারের আমল। শিল্পকলার তৎকালীন মহাপরিচালক মুস্তাফা মনোয়ার অডিশনে তাঁর পারফর্মেন্স দেখে  প্রথম সরকারিভাবে বিদেশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। তখন মুস্তাফা মনোয়ারের কাছে প্রেসিডেন্ট এরশাদ তাঁর কথা জানতে চাইলেন, ‘সে কেমন বাউল? দেখতে কেমন?’ মুস্তাফা মনোয়ার বললেন, ‘স্যার, আমি যারে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি, তার গান শুইনাই নির্বাচন করছি। সে গরিব মানুষ, চির কাঙাল।’ তখন এরশাদ বললেন, ‘সে তো মহিলা মানুষ। তার নাম কাঙাল হয় ক্যামনে? আজ থাইকা তার নাম হইব কাঙালিনী সুফিয়া।’

সেই থেকেই সুফিয়া খাতুন ‘কাঙালিনী সুফিয়া’ নামেই পরিচিত হন। ঘুরে যায় শিল্পী জীবনের মোড়। একপর্যায়ে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। পরবর্তীতে লালন আখড়ায় পরিচয়-প্রেম সূত্রে দ্বিতীয় সংসার বাঁধেন বাউল ও দোতারা বাদক ‘সেকম’ এর সঙ্গে। সেকম কুষ্টিয়ায় থাকলেও অনেক দিন শিল্পীর খোঁজ-খবর তেমন নেন না। ওই সংসারে এক মেয়ে আছে। মেয়ে তার বাবার সঙ্গেই থাকে। সেকমের কথা ভেবেই কাঙালিনী বেঁধেছিলেন ‘পরাণের বান্ধব রে বুড়ি হইলাম তোর কারণে’ গানটি।

পাঁচ শতাধিক গানের স্রষ্টা কাঙ্গালিনী সুফিয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল- তিনি তাৎক্ষনিক গান রচনা করেন, সুর করেন এবং পরিবেশন করেন।। গান তৈরি ও পরিবেশনের জন্য তাঁর কোন প্রকার পূর্ব প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না। বলতে গেলে তাঁর গানের খাতাও নেই। অন্যের সহায়তায় কিছু গান লিপিবদ্ধ করলেও সেগুলোর অধিকাংশই হারিয়ে গেছে। অন্যান্য ফোক বা লোকসঙ্গীত শিল্পীদের থেকে এটি হচ্ছে তাঁর প্রধান ব্যতিক্রম।

কাঙালিনী সুফিয়া ইংল্যান্ড, দক্ষিন কোরিয়া, কাতার, ইতালি, হংকং, যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, চীন ও ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গান পরিবেশন করেছেন। সঙ্গীতে তিনি এযাবৎ প্রায় ৩০টি জাতীয় ও ১০টি আন্তর্জাতিক পুরষ্কার লাভ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করেছেন। তিনি ‘রাজ সিংহাসন’ চলচ্চিত্রে প্রথম কণ্ঠ দেন।

গানের পাশাপাশি তিনি ‘দেয়াল’, ‘নোনাজলের গল্প’ প্রভৃতি নাটকে অভিনয় করেন। ‘বুড়ি হইলাম তোর কারণে’ গানটি অবলম্বনে নোনাজলের গল্প নাটকটি নির্মিত হয়। এতে প্রধান চরিত্র একজন বাউলের ভূমিকায় তিনি অভিনয় করেন। এছাড়াও তিনি ১৯৯৭ সালে ছটকু আহমেদ পরিচালিত ‘বুকের ভিতরে আগুন’ নামে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। কাঙালিনীর গান দিয়েই এ ছবির শুরু। এরপর আরো পাঁচটি ছবিতে অভিনয় করে গান করেন তিনি।

বর্তমানে কাঙালিনী সুফিয়ার বয়স ৭৭ বছর। দাঁত পড়ে গিয়ে গানের ছন্দপতন ঘটালেও সাধনা বলে তিনি দর্শকদের মোহাবিষ্ট করে রাখতে পারেন। দৈহিক কাঠামো জীর্ণ-শীর্ণ হলেও ভালোবাসার টানে গানের অনুষ্ঠান করতে ছুটে চলেন এখানে-সেখানে, গ্রীষ্ম কিংবা শীতে। টানা পাঁচ দশকের সঙ্গীত জীবনে তিনি বাংলাদেশ ও বাংলা লোকগানকে যে ঐশ্বর্য দান করেছেন, তাতে নির্দ্বিধায় বলা যায় তাঁর আয়ূষ্কাল আরও দীর্ঘ হলে আমরা, বাংলাদেশ ও বাংলা লোকগান, বরং আরও লাভবান হবো। কাঙালিনী সুফিয়া দীর্ঘজীবী হোন।