ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৮, মার্চ ২০২৪ ২২:০২:০৬ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
বিশ্বে প্রতিদিন খাবার নষ্ট হয় ১০০ কোটি জনের বাসায় পর্যবেক্ষণে থাকবেন খালেদা জিয়া ট্রেনে ঈদযাত্রা: ৭ এপ্রিলের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু গাজায় নিহত বেড়ে ৩২ হাজার ৪৯০ অ্যানেস্থেসিয়ার ওষুধ বদলানোর নির্দেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঈদ কেনাকাটায় ক্রেতা বাড়ছে ব্র্যান্ড শপে বাঁচানো গেল না সোনিয়াকেও, শেষ হয়ে গেল পুরো পরিবার

মা-ছেলের ক্রিকেট খেলা: মায়ের বোরকা নিয়ে বিতর্কের কারণ

বিবিসি বাংলা | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৬:১৮ পিএম, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ সোমবার

মা-ছেলের ক্রিকেট খেলা: মায়ের বোরকা নিয়ে বিতর্কের কারণ

মা-ছেলের ক্রিকেট খেলা: মায়ের বোরকা নিয়ে বিতর্কের কারণ

রাজধানীর পল্টন এলাকার একটি মাঠে ছেলের সাথে এক মায়ের ক্রিকেট খেলার একটা ছবি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। কিন্তু মা আর সন্তানের খেলার ওই মুহূর্তটিকে ছাপিয়ে আলোচনা শুরু হয় ওই নারীর পোশাক নিয়ে। ওই নারী বোরকা পরিহিত হওয়ার কারণে অনেকে তার সমালোচনা করেছেন এই বলে যে, তার মধ্যে তারা ‘বাংলাদেশি মা’কে- খুঁজে পাননি। অনেকে আবার বলেছেন, এটা পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তানের ছবি।

ছবিটি কিন্তু আসলেই তোলা হয়েছে রাজধানী ঢাকার পল্টন এলাকা থেকে। ছবিটি তুলেছেন ডেইলি স্টার পত্রিকার সংবাদকর্মী ফিরোজ আহমেদ। তার কাছ থেকে ছবিটি পেয়েছে বিবিসি বাংলা।

সামাজিক মাধ্যমে মেহরান সানজানা নামে একজন বলেছেন, ‘বাঙালি মা বলে অনেকেই বাহবা দিচ্ছেন। কিন্তু ওনাকে দেখে তো মোটেও আমার বাঙালি মনে হয়নি। মনে হয়েছে আফগানি মা। উনি যদি সমাজ পরিবর্তনের জন্য ছেলের সাথে মাঠে নামতেন তাহলে বোরখা পরে নামতেন না।’

অবশ্য এমন মতের বিরুদ্ধেও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। তারা ওই নারীকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। এমনি একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী ফারহানা সেলিম সিনথিয়া।

সিনথিয়া তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘ভদ্রমহিলা কি পোশাক পরেছেন সেইটা আমার কাছে বড় বিষয় না। এইটা যার যার নিজস্ব ভালো লাগা। উনার বোরকা নিয়ে সমালোচনা করার চেয়ে আমার ভালো লেগেছে ছেলেকে তার সাপোর্ট দেয়া দেখে, ভাল লেগেছে তার ব্যাটিং করার স্টাইল দেখে, মনে হচ্ছে প্রফেশনাল কেউ ব্যাট ধরেছে।’

পোশাক নিয়ে বিতর্ক কেন?
সমাজবিজ্ঞানী সামিনা লুৎফা বলেন, নারী কী পরে আছে অথবা পরে নাই সেটা সবসময়ই আলোচনার কেন্দ্রে।

তিনি বলেন, নারীর সমাজ নির্মিত একটি চেহারা আছে এবং সেই চেহারাটা হিন্দুদের জন্য এক রকম, সেক্যুলারদের জন্য একরকম, মুসলমান ভাবাপন্নদের জন্য একরকম। এই বিষয়গুলো নিয়ে সমাজের মধ্যে এক ধরণের বিভেদ তৈরি হয়েছে। এজন্যই তর্ক-বিকর্তটা হয়েছে।

একজন নারী বোরকা পরেই হোক আর যা পরেই হোক, তিনি তার সন্তানের সাথে খেলতেই পারে।

আরেকটি কারণ হচ্ছে, নারী যে অনেক রকম চেহারা নিয়ে হাজির হতে পারে সেই সহিষ্ণুতার জায়গাটা নাই। এছাড়া নারী কী পরবে সেটাও যে সে নিজে ঠিক করবে-সেই বোধের জায়গাটাও সমাজে তৈরি হয়নি বলে মনে করেন তিনি।

‘আমি যেভাবে নারীকে দেখতে চাই সেভাবেই নারীকে নির্মাণের চেষ্টা চলে। যেমন বাঙালি নারী, মুসলমান নারী, নারীবাদী নারী, তাদের প্রত্যেককেই একটা নির্দিষ্ট ফ্রেমের মধ্যে থাকতে হয়।’

তিনি বলেন, যারা নারীর স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করেন অনেক সময় তিনিও মনে করেন যে, নারীকে তার চিন্তার মতো করে চলতে হবে। কিন্তু এটা ঠিক নয়। কারণ নারী কী পরবে নিজে সেই সিদ্ধান্ত নেয়াটাও স্বাধীনতার অংশ। সময়ের সাথে সাথে চিন্তায় পরিবর্তন আনতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন বলেন, ‘এই ছবিটার বার্তা হওয়া উচিত একজন মা তার সন্তানকে উৎসাহিত করার জন্য নিজেই খেলছেন। এটাই বড় বার্তা। তার পোশাক নয়। কারণ আমাদের মায়েরা তো ক্রিকেট খেলেন না। এটাও তো একটা অনিয়মিত ঘটনাই বলা চলে।’

‘পোশাক নিয়ে বিতর্কটা আসলে অহেতুক বিতর্ক বলেই আমি মনে করি।’

এ বিষয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন বলেন, এটা আমাদের তৈরি করা নারীর ইমেজের ব্যাপার।

‘এই বিতর্ক তৈরি হয়েছে কারণ বোরকা নিয়ে আমাদের চিন্তা-জাগতিক যে ইমেজ আমরা তৈরি করে রেখেছি সেটার সাথে খাপ খাচ্ছে না।’

তিনি বলেন, সমাজে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে বোরকা মানেই রক্ষণশীলতা, বোরকা মানেই মৌলবাদিতা। এই চিত্রগুলো মানুষের মনে গেঁথে দেয়া হয়েছে।

‘একজন বোরকা পড়া নারীকে আমরা দেখি যে, সে রক্ষণশীল হবে, সে ঘরেই থাকবে, সে বাইরে যাবে না, সে ক্রিকেট খেলবে না। বোরকা নিয়ে আমাদের মনো-জাগতিক একটা চিত্র আছে। সেজন্যই এই আলোচনাটা তৈরি হয়েছে।’

বাঙালির পোশাক কী?
আদিকাল থেকে বাঙালি জাতিগোষ্ঠী কী ধরণের পোশাক পরতো সে বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক অধ্যাপক ড, মেসবাহ কামাল বলেন, আগে থেকে বাঙালি নারীদের পোশাক ছিল শাড়ি আর পুরুষের পোশাক ছিল লুঙ্গি যেটি মালকোঁচা দিয়ে পরা হতো।

ভারতীয় উপমহাদেশের এই অঞ্চলে কৃষিকাজের প্রাধান্য থাকায় এমন পোশাক হওয়ার কথা জানান তিনি।
নারীরা শাড়ির সাথে নানা অনুসঙ্গ ব্যবহার করেন। যার কারণে আদিকালের শাড়ির সাথে সাম্প্রতিক কালের শাড়ির অনেক পার্থক্য রয়েছে।

নারীরা শাড়ির সাথে নানা অনুসঙ্গ ব্যবহার করেন। যার কারণে আদিকালের শাড়ির সাথে সাম্প্রতিক কালের শাড়ির অনেক পার্থক্য রয়েছে।

তিনি বলেন, নব্য প্রস্তর যুগের সংস্কৃতি যেমন লাঙল চাষ, আদি বাসিন্দাদের সিঁদুর পরা-এগুলো এখনো দেখা যায়।

পাহাড়পুরের পালযুগের নির্মিত বৌদ্ধ বিহার খননে যে টেরাকোটা প্লেটসগুলো আছে, সেখানে মানুষের পোশাক বলতে লুঙ্গির উল্লেখ দেখা যায়। তবে সেটা মালকোঁচা মারা লুঙ্গি।

‘ওদের মধ্য থেকেই বাঙালি তৈরি হয়েছে। তাই বাঙালির পোশাক হিসেবে নারী ও পুরুষের পোশাক হিসেবে আমরা শাড়ি ও লুঙ্গি দেখি,’ মি. কামাল বলেন।

লজ্জা নিবারণ ছাড়াও জলবায়ু, পরিবেশ, আরাম, সামাজিক অবস্থা, বিশ্বায়ন- সব কিছুর সাথে পোশাক বার বার পরিবর্তিত হয়েছে।

‘শাড়ির দৈর্ঘ্যে পরিবর্তন এসেছে, এটা বেড়েছে। বাঙালি নারীরা ব্লাউজ পরতো না। রবীন্দ্রনাথের যুগ থেকে এটা শুরু হয়। শাড়ি এবং এর সাথে অনুষঙ্গ অন্য জিনিসের সমন্বয়ে একটা পরিশীলিত রূপ পেয়েছে।’

একই মত দিয়েছেন নৃ-বিজ্ঞানের শিক্ষক ড. জোবাইদা নাসরীনও। তিনি বলেন, বাঙালি নারীরা শাড়ি আর পুরুষরা লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পড়তো।

এই অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষের পেশা ছিল কৃষিকাজ। আর তার সাথে মানানসই পোশাকই ছিল লুঙ্গি।

তবে শাড়ির সাথে ব্লাউজ এবং পেটিকোটের ধারণা অনেক বেশি সাম্প্রতিক বলে জানান তিনি। আগে বাঙালি নারীরা শাড়ির সাথে ব্লাউজ ও পেটিকোট পরতো না।

তিনি জানান, ব্লাউজ ও পেটিকোটের ধারণা ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা নিয়ে এসেছে। আর এটা এসেছে ভিক্টোরিয়ান নোশন থেকে।

‘স্কার্টের ধারণা থেকে উপমহাদেশে এসেছে পেটিকোট আর টপসের ধারণা থেকে এসেছে ব্লাউজ,’ তিনি বলেন।

পশ্চিমা পোশাকের একটি সংস্করণ একটা সংস্কৃতি তার নিজের সাথে সামঞ্জস্য করে নিজের মতো তৈরি করে। যার ফলশ্রুতিতে ব্লাউজ আর পেটিকোট আসে।

বোরকা কীভাবে বাঙালি সংস্কৃতিতে আসলো?
বাংলাদেশ বোরকা, নেকাব, পর্দা অনেকগুলো ধারণা প্রচলিত রয়েছে। নেকাব দিয়ে সাধারণত মেয়েরা মুখ ঢেকে রাখে।

নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক ড. জোবাইদা নাসরীন বলেন, নেকাবের ধারণা এদেশে এসেছে উচ্চবংশীয় মুসলিমদের মধ্য থেকে।

‘আগে বলা হতো যে সৈয়দ পরিবারের মেয়েরা নেকাব পরবে। মাথা ও মুখ ঢেকে চলাফেরা করবে। এর কারণ হচ্ছে, সে কী করছে, কোথায় যাচ্ছে সেটা যাতে অন্যরা না দেখতে পায়।’

উচ্চবংশের মানুষেরা গোপনীয়তা রক্ষার জন্য নেকাব পরতো। একই রকম বোরকাও ছিল উচ্চবংশীয় নারীদের প্রতীক।

আর পর্দার ধারণা আসলে মুসলিমদের সাথে এককভাবে যুক্ত নয়। এটি নানা ভাবে এসেছে এবং একে শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার উপায় নেই বলে মনে করেন নৃবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক।

তিনি বলেন, ভারতের গুজরাট এলাকার নারীরা বড় করে ঘোমটা টানে। পর্দা করে। আবার খ্রিস্টান ধর্মে নানরা মাথা ঢেকে রাখে।

‘সংস্কৃতির অংশ হলে দেখা যায় যে, নারীরা বয়োজ্যেষ্ঠ কারো সামনেও ঘোমটা টানতো, এটা শুধু ধর্মের সাথে যুক্ত নয়,’ তিনি বলেন।

তিনি বলেন, ৩০-৩৬ বছর আগেও বাংলাদেশের একেক জেলার মানুষ একেক ধরণের বোরকা পরতো। দক্ষিণ বঙ্গের নারীরা বোরকা পরার পর সাথে অতিরিক্ত একটি ছাতা রাখতো। পুরুষদের দেখলে তারা সেটি তাদের দিকে ধরতো আড়াল করার জন্য।

তবে সমসাময়িক সময়ে নানা কারণে মানুষ বোরকা পরে বলে জানান তিনি।

বছর দশেক আগে নিজের করা এক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে ড. জোবাইদা নাসরীন বলেন, তিনি তার গবেষণায় দেখেছেন, সমাজের আদর্শ নারীর চাহিদা পূরণ করতে বোরকা পরে অনেকে। অনেকে আবার নিরাপত্তার জন্য বোরকা পরেন।

এটা সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছিল অ্যাসিড হামলার সময়টাতে। আর বর্তমান সময়ে অনেক নারীই অর্থনৈতিক অসঙ্গতি লুকাতেও বোরকা পরে থাকেন বলে জানান ড. জোবাইদা নাসরীন।