ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৫, এপ্রিল ২০২৪ ১০:৫৩:১২ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
যুদ্ধ কোনো সমাধান দিতে পারে না, এটা বন্ধ হওয়া উচিত: প্রধানমন্ত্রী ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন মা আরও ৩ দিন হিট অ্যালার্ট জারি যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ করার বিল সিনেটে পাস ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ফের কমল স্বর্ণের দাম মক্কা ও মদিনায় তুমুল বৃষ্টির শঙ্কা খালেদার গ্যাটকো মামলায় চার্জগঠনের শুনানি পেছাল

ময়মনসিংহের শশী লজ : স্মৃতির আয়নায় ইতিহাস

অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪.কম

আপডেট: ০১:৩৪ এএম, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ শনিবার

শশী লজ

শশী লজ

শরতের মেঘমুক্ত আকাশ। পেজা তুলোর মত সাদামেঘের ভেলা ঘুরে বেড়াচ্ছে আকাশের বুকে। ময়মনসিংহ শহরের কালো পিচঢালা পথ ধরে এগিয়ে চলেছে আমাদের রিক্সা। গন্তব্য ‘শশী লজ’। 

 

শশী লজ, ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত মহারাজা শশীকান্ত আচার্যের বাড়ি। ময়মনসিংহ রাজবাড়ি নামেও পরিচিত। শহরের কেন্দ্রস্থলে, ব্রহ্মপুত্র নদের অদূরে, শশী লজ অবস্থিত। ১৯৫২ সাল থেকে শশী লজ ব্যবহার করা হচ্ছে মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে। 

 

ময়মনসিংহে এর আগে আমি এসেছি একাধিকবার। প্রথমবার এসেছিলাম রিপোর্টার হিসেবে সংবাদ সংগ্রহ করতে। তারপর আরো কয়েকবার। এই সম্প্রতি গত ৩১ অগাস্ট গেলাম ঘুরে বেড়াতে। এবারের বেড়ানোর প্রধান আকর্ষণ ‘শশী লজ’।

 

মুক্তাগাছা জমিদারীর প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর তৃতীয় উত্তরপুরুষ রঘুনন্দন আচার্য চৌধুরী নিঃসন্তান ছিলেন। অথচ পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী সম্পত্তি সংরক্ষণে সক্ষম একটি পুত্র সন্তান ভীষণভাবে প্রয়োজন! 

 

কি করা যায়? জীবনের জটিল অংক কষতে কষতে দত্তক পুত্র গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তিনি। এর পর গৌরীকান্ত আচার্য চৌধুরীকে দত্তক নেন রঘুনন্দন। দত্তক পুত্রের হাতে জমিদারীর ভার অর্পণ করার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মারা যান।

 

জমিদার গৌরীকান্ত আচার্য চৌধুরীর প্রতিও সদয় ছিল না নিয়তি। সন্তানহীন অবস্থায় অকালপ্রয়াণ ঘটল তারও। গৌরীকান্তের বিধবা পত্নী বিমলা দেবী দত্তক নিলেন কাশীকান্তকে। কাশীকান্তের কপালও মন্দ ছিল ভীষণ। দীর্ঘ রোগযন্ত্রণায় ভুগে সন্তানহীন অবস্থায় পরলোকগমন করলেন তিনিও। তার বিধবা পত্নী লক্ষ্মী দেবী আচার্য চৌধুরানী পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ করে দত্তক নিলেন চন্দ্রকান্তকে। ভাগ্যের বিরুদ্ধাচরণে চন্দ্রকান্তও অতিদ্রুত ত্যাগ করলেন পৃথিবীর মায়া। তবে হাল ছাড়লেন না লক্ষ্মী দেবী। পুনরায় দত্তক নিলেন তিনি। দ্বিতীয় দত্তক পুত্রের পূর্বনাম পূর্ণচন্দ্র মজুমদার। কুলগুরুর সামনে মহাসমারোহে লক্ষ্মী দেবী নতুন নাম রাখলেন পুত্রের—সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী।

 

সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর শাসনামলে ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী জনপদে যুক্ত হলো সোনালি মাত্রা। প্রায় ৪১ বছর জমিদারি পরিচালনার প্রশস্ত প্রেক্ষাপটে বহু জনহিতকর কাজ করলেন তিনি। ময়মনসিংহে স্থাপন করলেন একাধিক নান্দনিক স্থাপনা। ঊনবিংশ শতকের শেষপদে ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থলে নয় একর ভূমির ওপর একটি অসাধারণ দ্বিতল ভবন নির্মাণ করলেন সূর্যকান্ত। নিঃসন্তান সূর্যকান্তের দত্তক পুত্র শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর নামে এই ভবনের নাম রাখা হলো শশী লজ।

 

বিখ্যাত এই ভবনটি ১৮৯৭ সালের ১২ জুন গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হলে অত্যন্ত ব্যথিত হন সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। ১৯০৫ সালে ঠিক একই স্থানে নতুনভাবে শশী লজ নির্মাণ করেন পরবর্তী জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী। ১৯১১ সালে শশী লজের সৌন্দর্যবর্ধনে তিনি সম্পন্ন করেন আরও কিছু সংস্কারকাজ। নবীন জমিদারের প্রাণান্ত প্রয়াসে শশী লজ হয়ে ওঠে অনিন্দ্যসুন্দর, অপরূপ।


পুরো বাড়িটি ৯ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। শশীলজের মূল ফটকে রয়েছে ১৬টি গম্বুজ। ভেতরে প্রায় প্রতিটি ঘরেই রয়েছে ছাদ তেকে ঝুলন্ত, প্রায় একই রকম দেখতে, ঝাড়বাতি। সাধারণ বাসভবন ছাড়াও বাড়িটিতে আছে নাচঘর, স্নানঘর। স্নানঘরে রয়েছে একটি সুড়ঙ্গ। ধারণা করা হয় এই সুড়ঙ্গপথে মুক্তাগাছা যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল।

 

মূল ভবনের পেছনভাগেও রয়েছে একটি স্নানঘর। পিছনের স্নানঘরটি দোতলা। এই স্নানঘরে বসে রানী পাশের পুকুরে হাঁসের খেলা দেখতেন। পুকুরটির ঘাট মার্বেল পাথরে বাঁধানো। শশী লজের মূল ভবনের সামনে রয়েছে বাগান। সেই বাগানের মাঝখানে আছে শ্বেতপাথরের ফোয়ারা, যার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে গ্রিক দেবী ভেনাসের স্বল্পবসনা স্নানরতা মর্মর মূর্তি।

 

বাগানের ঠিক পেছনেই লালচে ইট আর হলুদ দেয়ালে নির্মিত শশী লজ। এর পাশেই রয়েছে পদ্মবাগান। এই ভবনের পূর্বপ্রান্তের ঘরটি বর্তমানে ব্যবহার করা হয় নারী শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষের কার্যালয় হিসেবে। শশী লজের অন্দরে বারান্দা অতিক্রম করে কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরোলেই রঙ্গালয়। সুদৃশ্য সেই রঙ্গালয়ের এক প্রান্তে বিশ্রামঘর। বিশ্রামঘরের পর কাঠের মেঝেযুক্ত হলঘর। হলঘরের পাশেই বর্ণিল মার্বেল পাথরে নির্মিত আরেকটি জলফোয়ারা।

 

জলফোয়ারার ঠিক ওপরের ছাদ থেকে নিচে ঝোলানো স্ফটিকস্বচ্ছ কাচের ঝাড়বাতি। ভবনটির পেছনে একচিলতে উঠান। সবুজ ঘাসের আঁচল পাতা সেই উঠান পেরোলে একটি অপরিসর জলাশয়। জলাশয়ের পূর্ব ও পশ্চিম পারে দুটি জরাজীর্ণ ঘাট থাকলেও দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত দ্বিতল স্নানঘাটটির সৌন্দর্য সত্যিকার অর্থেই অসাধারণ।

 


বাড়িটির আশেপাশে রয়েছে বেশকিছু দুষ্প্রাপ্য ও প্রচীন গাছগাছালি। আছে দুষ্প্রাপ্য নাগলিঙ্গম, যা তখন হাতির খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আছে পদ্মবাগান। 

 

এলাকার প্রবীণ মানুষদের ভাষ্যে, বিশাল জায়গা জুড়ে অবস্থিত শশী লজের চারদিকে নিকট অতীতেই ফুল বাগান ছিল, ছিল বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষবীথি। কিন্তু মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ব্যবহারিক উপযোগযুক্ত নানা স্থাপনা নির্মাণের ফলে ঐতিহাসিক এই ভবন ও তার পরিপাশের ফুল-বৃক্ষবীথির সৌন্দর্য আজ বিলুপ্তপ্রায়!