ঢাকা, শুক্রবার ১৯, এপ্রিল ২০২৪ ৪:০২:১৪ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
জাতির পিতা বেঁচে থাকলে বহু আগেই দেশ আরও উন্নত হতো টাইমের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় বাংলাদেশের মেরিনা নান্দাইলে নারী শ্রমিককে কুপিয়ে হত্যা তীব্র গরমে জনজীবনে দুর্ভোগ, বাড়ছে জ্বর-ডায়রিয়া কারাগার থেকে সরিয়ে গৃহবন্দী অবস্থায় সুচি কৃষকরাই অর্থনীতির মূল শক্তি: স্পিকার মধ্যপ্রাচ্যের দিকে নজর রাখার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

রোকেয়া খাতুর রুবী চিরসবুজ পাতা

প্রবীর বিকাশ সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৩:৪০ পিএম, ২৭ জানুয়ারি ২০২১ বুধবার

শিশু সাহিত্যিক রোকেয়া খাতুর রুবী

শিশু সাহিত্যিক রোকেয়া খাতুর রুবী

মাঝেমাঝে ভাবি কী রোমান্টিক সময়টা কেটেছে স্বদেশে, প্রিয় শহর কুমিল্লায়। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৪ এই ৮টি বছর ছিল স্বর্ণালী যুগ আমার ছড়ালেখার। ছড়ালেখার সূচনা হয়েছিল ১৯৭৬ সালে জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন চাঁদের হাটের কর্মী হওয়ার পর। কুমিল্লায় তখন চাঁদের হাটের একটি শাখা ছিল প্রফেসর পাড়ায়। দ্বিতীয় শাখাটি গড়ে উঠল ধর্মসাগর পশ্চিম পাড়ে, যেখানে তখন আমার বসবাস। তখনকার তুখোড় ছড়াকার এবং চাঁদের হাটের কর্মী হানিফ সংকেত আমাকে উৎসাহিত করলেন নবগঠিত ধর্মসাগর পাড় চাঁদের হাট শাখার সাহিত্য সম্পাদক হওয়ার জন্য। পাড়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবীরাও নির্বাচিত করল আমাকেই। সাহিত্য সম্পাদক তো হলাম, নিয়ম অনুযায়ী সাহিত্য সংকলন সম্পাদনা করতে হবে বলা হল। বলে কি! সাহিত্যের “স” জানি না, কীভাবে কী হবে!
আমার প্রবল অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও “ঝিলিমিলি” নামে একটি ছড়া সংকলন প্রকাশের উদ্যোগ গৃহীত হল। অনভিজ্ঞ আমাকে ছড়ালেখার নিয়মকানুন ইত্যাদি হানিফ ভাই শিখিয়ে দিলেন। হেসে বললেন, তোমাকেও একটি ছড়া লিখতে হবে। এই সেরেছে! মাথা চক্কর দিল আমার! কী ঝামেলায় পড়া গেল রে বাবা! নিস্তার নেই,অনেক লড়ালড়ি করে ছড়া একটি লিখলাম, হানিফ ভাই ছন্দ ঠিক করে দিলেন। সম্পাদনা ও সম্পাদকীয় লেখায় আরেক উদীয়মান কবি, গল্পকার প্রফেসর পাড়া চাঁদের হাটের কর্মী এবং হানিফ সংকেতের পরম বন্ধু সুমন্ত চট্টোপাধ্যায় সহযোগিতা করলেন। সেই যে ছড়ালেখার নেশায় পেয়ে গেল আমাকে সেটা স্থিমিত হল জাপানে আসার পর। ছড়ালেখার সেই দুর্দান্ত দিনগুলোতে সারাদিনই আমি যত্রতত্র ছড়ার ভেলকিভাজি দেখতে পেতাম। স্বপ্নের মধ্যে ছড়া এসে ধরা দিত। কবি কবি ভাব, ছড়ার নেই অভাবÑÑবিচিত্র সব ছড়া লিখেই চলেছি, কুমিল্লাসহ দেশের পত্রিকা ও ছড়া সংকলনে প্রকাশিত হচ্ছে। বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলতে লাগল, ভালো কবিরোগেই তোকে পেয়ে বসেছে! রাস্তাঘাটে সাবধানে চলাফেরা করিস! তা নাহলে গাড়িঘোড়ার ধাক্কায় চিট-পটাং হয়ে পড়ে থাকবি!  
কী প্রাণচঞ্চল ছিল দিনগুলো! আজ ভাবলে স্বপ্নের মতো মনে হয়। ছড়ালেখার পাশাপাশি গল্প লেখার চেষ্টা করেছিলাম। লিখেও ছিলাম দু-একটি। কলেজে পড়ি, সেই বয়সে বাংলা ভাষা তেমন বুঝি না, সাধু ও চলতি ভাষায় অবাধ মেলামেশা, দলাদলি চলতই। তাই সাহস হত না গল্প লেখার। একবার তবু সাহস করে একটি ছোট্ট গল্প লিখে রাজশাহীর দৈনিক বার্তা পত্রিকায় পাঠিয়ে দিলাম। আমাকে দারুণ অবাক  করে  দিয়ে সেটা হুবহু ছাপা হয়ে গেল শিশুপাতায়! সম্ভবত, আমার প্রজন্মের ছড়াকারদের মধ্যে আমিই প্রথম এরকম একটি অসাধ্য সাধন করেছিলাম। গল্পটি পড়েছিল ছড়াকার এবং শাপলা শালুকের কর্মী আবু হাসান শাহরিয়ার, তখন সে বাবার চাকরি সূত্রে কুমিল্লায় থাকত। একদিন ভিক্টোরিয়া কলেজের ফটকের সামনে দেখা হতেই সে তার ফেন্সি সাইকেল থেকে নেমে করমর্দন করে বলল, অভিনন্দন প্রবীর! তোমার গল্পটি পড়লাম। গদ্যে তোমার হাতেখড়ি হয়ে গেল দেখে আনন্দিত হলাম। গদ্যলেখা অব্যাহত রাখো।
কিন্ত গল্পলেখা তত সহজ ছিল না। থিম জানা নেই। একটা কিছু লিখলেই সেটা গল্প হয়ে যাবে না, গল্পের মতো গল্প হতে হবে। সেই সময় “গল্পের মতো গল্প” লেখায় অর্থাৎ কিশোর গল্প লেখার ক্ষেত্রে অগ্রজদের মধ্যে এগিয়ে ছিলেন, খ্যাতি অর্জন করেছিলেন রোকেয়া খাতুন রুবী। এরপর জাকির হোসেন বুলবুল, আবু সাঈদ জুবেরী, দীদার চৌধুরী প্রমুখ। তাঁদের গল্পের জন্য অধীর প্রতীক্ষায় থাকতাম।
বিশেষ করে, রোকেয়া খাতুন রুবীর গল্পে একটা চমৎকার কোমল রোমান্টিক আবহ আছে। খুবই আন্তরিক, বন্ধুভাবাপন্ন, স্বপ্নালু ভালোলাগা অনুরণন তুলত মনের মধ্যে। থিমগুলোও বাস্তবতার সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমাদের চারপাশে ঘটেযাওয়া ঘটনাগুলোকেই তিনি নিপুণ আঙুলে গল্পের আদল দিতেন। পড়ার পর মনে হত এ যেন আমারই গল্প! এই আকর্ষণটা তখককার উদীয়মান একজন লেখক হিসেবে আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করতাম। যতখানি মনে পড়ে সিলেটের যুগভেরী পত্রিকা, সম্ভবত রুবী আপাদের পারিবারিক কাগজই ছিল এটা সেই পত্রিকায় তার গল্প পড়েছি, অন্যান্য জাতীয় দৈনিকের শিশুদের পাতায় তো বটেই। সাপ্তাহিক কিশোরবাংলা কাগজেও মনে হয় পড়েছি। যতখানি ঝাপসা মনে পড়ে, তার লেখা বড়দের গল্পও পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। পাঠ করেছি বড়দের জন্য লিখিত কবিতাও। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, সিলেটে থাকতেন কিনা অনামিকা হল লিলি নামে এক তরুণী কবিতা লিখতেন। তিনি কি রুবী আপার বান্ধবী ছিলেন?
সে যাই হোক, রোকেয়া খাতুন রুবী শুধু গল্পকার নন, তিনি একজন স্বনামধন্য ছড়াকারও বটেন! আবার সুদক্ষ একজন কিশোরমনস্ক কবিতারও স্বপ্নময় কবি। কত ছড়া ও কবিতা তার পড়েছি বিভিন্ন পত্রিকা ও সাহিত্য সংকলনে, হিসাব নেই! সিলেটেও সেই সময় বেশকিছু ছড়াকার ছিলেন, ছড়া সংকলনও কম প্রকাশিত হত না! তার লেখা বাদ দিয়ে শুধু সিলেটেই নয়, বাংলাদেশের কোনো ছড়া-কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। যেকোনো সংকলনে তার ছড়া না হয় কিশোর কবিতা পাঠ করার সৌভাগ্য হয়েছে। আমরা যেমন সাহিত্য সভায় অংশগ্রহণ করেছি, আমার মনে হয় তিনি খুব একটা প্রকাশিত হতেন না। খুবই কমই দেখেছি তার ছবি কোথাও ছাপা হতে। আড়ালে-আবডালে শিশুসাহিত্যের এক অনন্যাÑঅভিজাত এবং প্রেরণাদায়ী সৃজনশিল্পী হিসেবে সুদীর্ঘ বছর কাজ করে চলেছেন। বাংলাদেশ সরকারের কর্মক্ষেত্রে এবং সাংসারিক কর্মক্ষেত্রে শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি লেখালেখির চর্চা বন্ধ করেননি। একাধিক তার গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ইন্টারনেটে দেখতে পাই, তার গ্রন্থের সংখ্যা নেয়াহাত কম নয়, আমাদের একটি ছাদ ছিল, রাজপথের রাজা, ক্লাস এইটের গিয়াসউদ্দিন, কামিনী ফুল কিশোরবেলা, আমাদের পাখি নেই, প্রজাপতি প্রজাপতি, মুক্তিযুদ্ধের ছড়া কবিতা, মুক্তিযুদ্ধের গল্প ইত্যাদি লোভনীয় বই। কিছুদিন আগেও ইন্টারনেটে তার একটি দীর্ঘ স্মৃতিকথা পড়ে দুচোখ জলমগ্ন হয়েছে। কৈশোর আর তারুণ্যের ঊষালগ্নের দিনগুলোতে দেদার লেখালেখির স্মৃতিগুলো ডাহুকডাকা দুপুরকে স্মরণ করিয়ে দেয়। বুকের ভেতরটা কেমন যেন শূন্য শূন্য মনে হয়। যেমনটি চন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায় গেয়েছেন,
                         “সেই শান্ত ছায়ায় ঘেরা
                         কৃষ্ণকলির দিনগুলি যদি থাকত
                         এই অলসবেলায় যদি একটি ডাহুক
                         আনমনে আজও ঢাকত.......”

রোকেয়া খাতুন রুবীর সঙ্গে আমার কখনো প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ ঘটেনি। ফেইসবুকে মাঝেমাঝে কিছু কথা হয়েছিল। তার একটি গল্প সংকলন, “রাজপথের রাজা”, ২০০৮ সালে প্রকাশিত। একদিন ঢাকার শাহবাগের একটি দোকানে দেখতে পেয়ে কিনেছিলাম। গল্পগুলো পাঠ করার পর মন ভিজে গিয়েছিল। কী অসাধারণ টানটান--নিটোল ভাষা আর মর্মস্পশী গল্পগুলো! অভিভূত হয়েছিলাম! স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছিলাম। সেই অনুভূতি থেকে ২০১০ সালে মাসিক দশদিক ম্যাগাজিনে একটি আলোচনাই লিখে ফেলেছিলাম!। তার সাহিত্যকর্মগুলো আমাদের চিরদিনের মূল্যবান বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ যার যথার্থ মূল্যায়ন হওয়ার দাবি রাখে।
এমন একজন স্বনামধন্য জ্যেষ্ঠ শিশুসাহিত্যিক হিসেবে তিনি এখনো জাতীয় কোনো পুরস্কারে পুরস্কৃত হননি দেখে অবাক না হয়ে পারি না! জীবদ্দশায় তাঁকে সম্মানিত করা জরুরি বলে মনে করি। তার অবর্তমানে তাকে পুরস্কৃত করে যেন অপমানিত করা না হয় আমাদের মতো ভক্তদের।

টোকিও ২৭.১.২০২১
প্রবীর বিকাশ সরকার: শিশুসাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক