ঢাকা, শনিবার ২০, এপ্রিল ২০২৪ ১:২৪:১৮ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
হাসপাতালের কার্ডিয়াক আইসিইউ পুড়ে ছাই, রক্ষা পেল ৭ শিশু সবজির বাজার চড়া, কমেনি মুরগির দাম সারা দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি কৃষক লীগ নেতাদের গণভবনের শাক-সবজি উপহার দিলেন প্রধানমন্ত্রী চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি, হিট এলার্ট জারি শিশু হাসপাতালের আগুন সম্পূর্ণ নিভেছে

শাহাদাতের জবানবন্দিতে নুসরাত হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা

নিজস্ব প্রতিবেদক | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০২:৩৪ পিএম, ১৬ এপ্রিল ২০১৯ মঙ্গলবার

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

নুসরাত জাহান রাফির গায়ে আগুন ধরানোর সময় মাদ্রাসার ছাদে পাঁচজন উপস্থিত ছিলেন বলে নিশ্চিত হয়েছে তদন্ত সংস্থা পিবিআই, তার মধ্যে অধ্যক্ষের ভাগ্নি উম্মে সুলতানা পপিও ছিলেন।

এদিকে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নুসরাতে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছে এ ঘটনায় গ্রেফতার শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম। শাহদাত সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার ফাজিল দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সে মাদ্রাসা ছাত্রলীগের সভাপতি।

সে জানায়, বান্ধবী নিশাতকে মারধরের খবর পেয়ে ছাদে ছুটে গিয়েছিলেন নুসরাত জাহান রাফি। সেখানে পাঁচজন মিলে তাকে ছাদে চিত করে শুইয়ে ফেলেন। তার পরনের ওড়নাটি দুভাগ করে বেঁধে ফেলেন হাত-পা। এরপর এক লিটার কেরোসিন নুসরাতের গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢালা হয়।

ম্যাচের কাঠি দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় পায়ে। আগুন যখন সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, তখন এই পাঁচজন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসেন।

গত ৬ এপ্রিল আরবি প্রথমপত্র পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসায় গেলে নুসরাতকে ডেকে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। শরীরের ৮০ শতাংশ পোড়া নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে পাঁচ দিন পর মারা যান নুসরাত।

নুসরাতের পরিবার জানায় গত ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ আনার পর থেকেই। ওই ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিন আক্তার সোনাগাজী থানায় মামলা করেন।

এরপর থেকেই মামলা তুলে নেওয়ার জন্য নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল পরিবারটিকে। তবে প্রতিবাদে অনড় ছিলেন নুসরাত। আগুন ধরিয়ে দেওয়ার আগ মুহূর্তেও তাকে মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়া হয়। কিন্তু নুসরাত তা মানেননি। পরবর্তী সময়ে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায়ও তিনি প্রতিবাদ করে গেছেন।

নুসরাত হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার শাহাদাত হোসেন ও নুর উদ্দিন রোববার ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম জাকির হোসাইনের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ১১ ঘণ্টা ধরে ৫৭ পৃষ্ঠার জবানবন্দিতে তারা ওই দিনের ঘটনার আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন।

এই দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে জড়িত তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রেফতার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার সঙ্গে দেখা করতে ৩ এপ্রিল যারা কারাগারে গিয়েছিলেন, অধ্যক্ষ তাদের সবার কাছে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। এরপর তিনি আলাদাভাবে মাদ্রাসাছাত্র ও ‘সিরাজ-উদ-দৌলার মুক্তি পরিষদ’ নামে গঠিত কমিটির আহ্বায়ক নুর উদ্দিন, যুগ্ম আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম এবং আরেক ছাত্রের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেন।

তদন্ত কর্মকর্তারা জানান জিজ্ঞাসাবাদে শামীম জানিয়েছে, কারাগার থেকে ফেরার পর ওই দিন রাত সাড়ে ৯টায় মাদ্রাসার পশ্চিম হোস্টেলে তিনি, নুর উদ্দিন, মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের প্রধান আবদুল কাদেরসহ পাঁচজন সভা করেন। সেখানে কে বোরকা আনবে, কে কেরোসিন আনবে, কে কোথায় থাকবে, সে বিষয়ে পরিকল্পনা করা হয়। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় অধ্যক্ষের জেঠাসের (স্ত্রীর বড় বোন) মেয়ে উম্মে সুলতানা পপিকে দিয়ে নুসরাতের বান্ধবী নিশাতকে মারধর করা হচ্ছে এমনটা বলে তাকে ডেকে পাঠানো হবে।

মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী উম্মে সুলতানা পপিই নুসরাতকে ডেকে নিয়ে আসেন। কিন্তু নুসরাতের সামনে তারা তাকে কৌশল করে ‘শম্পা’ নামে ডাকেন। এ কারণেই নুসরাত তার জবানবন্দিতে শম্পার কথা বলে গেছেন। উম্মে সুলতানাই যে ‘শম্পা’, সেটি জিজ্ঞাসাবাদে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

জিজ্ঞাসাবাদে শাহাদাত হোসেন জানিয়েছেন, আন্দোলন ও বোরকা কেনার জন্য সোনাগাজী পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাকসুদ আলম তাদের ১০ হাজার টাকা এবং এক শিক্ষক ৫ হাজার টাকা দেন। এর মধ্যে ৫ হাজার টাকা তিনি নূর উদ্দিনকে দেন। আর তিনটি বোরকা কেনার জন্য তার চাচাতো বোনের পালিত মেয়ে ও ওই মাদ্রাসার ছাত্রীকে দেন দুই হাজার টাকা।

শাহাদাত হোসেন ঘটনার দিনের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, ঘটনার দিন সকাল আটটার দিকে তিনি সোনাগাজী বাজারে আসেন। তখন তার চাচাতো বোনের পালিত মেয়ে তাকে একটি পুরোনো ও দুটি নতুন বোরকা দিয়ে যান। তিনি তাকে উম্মে সুলতানা পপির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সঠিকভাবে কাজ করতে বলে বাজারে কেরোসিন কিনতে যান। এক লিটার কেরোসিন কিনে তিনি ‘ডাবল পলিথিনে’ করে নিয়ে আসেন। এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি ও মাদ্রাসাছাত্র জোবায়ের আহম্মেদ (২০) ও জাবেদ হোসেন (১৯) সাইক্লোন শেল্টারের (মাদ্রাসার প্রশাসনিক ভবন) নিচতলার শ্রেণিকক্ষে বসেন।

তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগুন ধরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে জড়িত পাঁচজনের প্রত্যেকেই বোরকা এবং নেকাব ছাড়াও হাত ও পায়ে মোজা লাগিয়ে নিয়েছিলেন।

জিজ্ঞাসাবাদে আগুন লাগানোর বর্ণনা দিতে গিয়ে শাহাদাত হোসেন বলেছেন, সকাল পৌনে নয়টার দিকে নুসরাতকে ডাকতে যান উম্মে সুলতানা। তখন তারা নিচের শ্রেণিকক্ষ থেকে তৃতীয় তলার একটি কক্ষে এসে অবস্থান নেন। কিছুক্ষণ পর উম্মে সুলতানা ও নুসরাত ছাদে ওঠেন। তাদের পিছে পিছে ওঠেন তার (শাহাদাতের) চাচাতো বোনের পালিত মেয়ে। এরপর তৃতীয় তলা থেকে তারা তিনজন ছাদে যান।

ছাদে ওঠার পর উম্মে সুলতানা পপি প্রথমে নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে বলেন। নুসরাত তখন নিশাতকে ছাদে খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরপর শাহাদাতের চাচাতো বোনের পালিত মেয়েও নুসরাতকে একই কথা বলেন। নুসরাত তখন জবাবে বলেছিলেন, মামলা উঠাব না। আমার গায়ে কেন হাত দিল। ওস্তাদ তো ওস্তাদ। আমি এর শেষ দেখেই ছাড়ব।

জিজ্ঞাসাবাদে শাহাদাত বলেছেন, নুসরাতের এই জবাব শুনে তিনি নিজে পেছন থেকে এক হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরেন ও অন্য হাত দিয়ে হাত ধরেন। উম্মে সুলাতানা পপি তখন নুসরাতের পা ধরেন। আর শাহাদাতের চাচাতো বোনের পালিত মেয়ে নুসরাতের শরীর চেপে ধরেন। তিনজন মিলে নুসরাতকে তারা ছাদের মেঝেতে ফেলে দেন। এই সময়টাতে উম্মে সুলতানাকে তাঁরা কৌশলে শম্পা বলে ডাক দেন।

শাহাদাত বলেছেন, নুসরাতকে মেঝেতে শুইয়ে ফেলার পর জোবায়ের নুসরাতের ওড়না দুই টুকরো করে তার হাত ও পা বেঁধে ফেলেন। জাবেদ তখন নুসরাতের সারা শরীরে কেরোসিন ঢেলে দেন। এরপর শাহাদাতের চোখের ইশারায় জোবায়ের তার পকেট থেকে দেশলাই বের করে কাঠি জ্বালিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। এরপর পাঁচজনই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসেন। নামতে নামতেই তিনজন ছাত্র তাদের বোরকা খুলে শরীর কাপড়ের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলেন। ছাত্রী দুজন মাদ্রাসায়ই তাদের পরীক্ষার কক্ষে চলে যান। আর বাকি তিনজন নিজেদের মতো করে পালিয়ে যান।

তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিঁড়ি দিয়ে ওই পাঁচজন যখন নামছিলেন তখন নুসরাতের আগুন, আগুন, বাঁচাও, বাঁচাও বলে চিৎকার তারা শুনতে পান। পা থেকে আগুন ধরানোয় প্রথমে নুসরাতের পায়ের বাঁধন খোলে। এরপর আগুন যখন ওপরে উঠে তার হাতের বাঁধন খুলে তখনই তিনি উঠে দৌঁড়ে নিচে নেমে আসেন।

তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নুসরাতের মুখ শাহাদাত চেপে ধরায় সেখানে আর কেরোসিন ঢালা হয়নি। তাই পুরো শরীর পুড়লেও মুখে আগুন লাগেনি।

মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলাকে (৫৫) ঘটনার আগেই নুসরাতের শ্লীলতাহানির অভিযোগে গ্রেফতার করে পুলিশ। তিনি নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনারও এজাহারভুক্ত আসামি।

অধ্যক্ষ বাদে মামলার এজাহারভুক্ত গ্রেফতার বাকিরা হলেন, ‘সিরাজ উদদৌলা সাহেবের মুক্তি পরিষদ’ নামে গঠিত কমিটির আহ্বায়ক ও মাদ্রাসাছাত্র নুর উদ্দিন, যুগ্ম আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম, সোনাগাজী পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, মাদ্রাসার ইংরেজির প্রভাষক আফছার উদ্দিন, মাদ্রাসাছাত্র জোবায়ের আহম্মেদ, জাবেদ হোসেন এবং উম্মে সুলতানা পপি।

-জেডসি