ঢাকা, মঙ্গলবার ২৩, এপ্রিল ২০২৪ ২১:৫৩:৩৯ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
‘পদ্মশ্রী’ গ্রহণ করলেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা কাতার-বাংলাদেশ ১০ চুক্তি-সমঝোতা সই কয়েক ঘণ্টায় ৮০ বারেরও বেশি কেঁপে উঠল তাইওয়ান ঢাকা থেকে প্রধান ১৫টি রুটে ট্রেনের ভাড়া যত বাড়ল মাকে অভিভাবকের স্বীকৃতি দিয়ে নীতিমালা করতে হাইকোর্টের রুল আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করেছি : শেখ হাসিনা নতুন করে ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি

শুধু নিজের ভাষাটা জানি বলেই, কম তো কিছু পাইনি

শামীম আজাদ | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০২:৫৯ পিএম, ২৬ আগস্ট ২০২১ বৃহস্পতিবার

লন্ডনে একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন শামীম আজাদ।

লন্ডনে একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন শামীম আজাদ।

পাখির কোন পাশপোর্ট লাগে না। ভিসা বা ভষ্ম মাখতে হয় না। ডিঙি নাও  লাগে না। তাদের জন্য কোন বর্ডার পুলিশ নেই। মানুষেরাই মানুষকে আটকে দেয়। মানুষ আটকে যায় তারকাঁটায়, বৈদূতিন জালে, প্লেনের পাখায়, ডিঙিতে ডুবে যায় সাগরে, পিষে যায় চ্যানেল টানেলের ট্রেনের চাকায় ও না খেয়ে শুকিয়ে মরে মরুভূমিতে। তারপর নানান কৌশলে, ভাষায়, ভালোবাসায় ও বিদ্যায় যে ক’জন বেঁচে থাকে তারা যা জোটায় তা যা এক স্বত্ত্ববিহীন, মালিকানাহীন, গৃহবিহীন গৃহ। কিন্তু এই খন্ডকালিন জীবনে আমি বিশ্বাস করি যতটা যাওয়া যায়- ততটাই যাওয়া যায়। 

এখনো আমার যাত্রা রয়েছে অব্যাহত। বাংলাদেশের চল্লিশ আর বিদেশের ত্রিশ মিলে সত্তরের এই সুফলা যাত্রা। আমার এ জলন্ত যাত্রাপথে বাতাস ও  বর্ষা, আকাশ ও আশপাশ, নতুন ফুল ও কুঁড়ির মদ্যপান করেছি অনবরত আর বার বার এলপি হার্টলীর লাইন বলেছি “দ্যা পাস্ট ইজ অ্যা ফরেন কান্ট্রি; দে ডু থিংস ডিফারেন্টলি দেয়ার।” সুতরাং শামীম অতীতের জ্ঞানে পাঠ করে যাও বদলে যাওয়া সমাজ। রপ্ত করো তার ভাষা।

আমি নিজ বাসভূমে পরবাসী, এক নোম্যাড। যখন বেরিয়ে পড়েছি তখন মাতৃভাষায়ই জ্ঞাত ছিলাম পৃথিবীর তরিবৎ। সে বোধই আমি ভাঙিয়ে মেখেছি, খেয়েছি, পান করেছি, দুঃখ দিয়েছি, দুঃখ পেয়েছি। সবই সেই এক ও অনন্য বাংলা থেকে ভাষান্তরে, তার নানাবিধ ব্যবহারে, বহুবিধ প্রক্রিয়ায়। গদ্য ও পদ্যে, কবিতা ও কানুনে, স্টোরিটেলিং ও স্টোরিরাইটিংয়ে, পারফর্মেন্স ও পিকেটিংয়ে, শিক্ষকতা ও সৃজনশীলতায়, নাটক লেখা ও দেখায়, উপস্থাপনা ও  নির্দেশনায় (বাংলা, ইংরাজী, গ্রিক, হাঙ্গেরিয়ান, সিলেটি)।

সত্তরের সন্নিকটে এখন জাবরকাটা, অতীতবাটা, চোখের কুসুম খোলা এক প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী সদৃশ হয়ে বুঝি কম সঞ্চয় করিনি। 

আদি ঠিকানা সিলেটের মনুগাঙ। জন্মক্ষণে মা ছিলেন ব্রম্মপুত্রের ঘাটে। তাই ময়মনসিংহের মনোহর হাওয়ায় পুষ্ট হয়ে বাবার চাকুরিসুত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে আয়ত্ব করেছি সকল সৌরভ। বাংলাদেশ নির্মান-নৃত্বত্তের আঁশে আঁশে সুবাসে আমিও ছিলাম। যেমন লিপিবদ্ধতার আগেও হোমারের মত মুখ ছিলো, বাল্মিকীর মতো, কাহ্ন’র মতো শ্লোক ছিলো। কিন্তু কে আর অতীতের খোঁজে হাঁটে? অতীততো আরেক বিদেশ বিভূঁই। সেখানে ইয়েলো স্টোরেজে ক’টি অ্যালবাম আর মৃত মানুষের ক’খানা ছবি ফ্রেমে আটকে পড়ে আছে।  

এখানে ইতিহাসের শিক্ষক পড়ায় কৃতদাসের, বন্যার ও মানুষের বাঁদর কাহিনী। কিন্তু ডিয়ার টিচার একবারও কি ভেবেছো তোমাদেরও বহু আগে তারা মুক্ত ছিলো। তাদের নিজের ভাষা ছিল। পশু বধের পর পুড়িয়ে খাবার প্রক্রিয়া বের করেছিলো তারাই। তাদের মাটি তাদেরই ছিলো। যাযাবর বাণিজ্যে কার নৌকা আগে মাটি ছুঁয়েছে সেটা ঠিক না। তবে নিজের বেলা আমি বুঝে গেছিলাম, তিষ্টাবার প্রথম কৌশলই ভাষা। ভাষাবোধ। সারমেয়ের মত শব্দ নয়, অর্থময়তার জন্য সব রকম ইঙ্গিতে সংযোগ স্থাপন। ভাষাবীজই অভিবাসীর প্রথম বপন। 

মনে পড়ছে আমার মায়ের কথা। গত শতাব্দীতে হারিয়ে যাওয়া আমার মা’ও সেটা বুঝেছিলেন দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম। সেবার আম্মা তার লন্ডন সফর কোটা শেষে বুজানের কাছে টেক্সাস যাবেন। এরপর যাবেন ভাইয়ার কাছে ক্যানাডায়। সেখান থেকে শুবুর কাছে বাংলাদেশে। একাকী প্লেনে মহাসাগর পাড়ি দিতে পথে তার পানি, ওষুধ, বাথরুম, ব্যাগ, খুচরা পয়সা, চা কত কিছু লাগবে! কী করে সামলাবেন! জিজ্ঞেস করতেই গুয়ামুরী হাসি দিয়ে হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটি পুরানো নোট বই বের করলেন। তাতে তিনি তার ভ্রমণকালীন অত্যাবশ্যকীয় ইংরাজী সংলাপগুলো বাংলায় বানান করে লিখে রেখেছেন! দরকার মত বই দেখে ব্যবহার করে করে পৃথিবীর দেশগুলো টপকে বেড়াচ্ছেন। সব দেশেই তার পৌত্র পৌত্রী আছে, তারাই তার ঠিকাদার। ভাবা যায়! ভাষার গুলাইল মেরে মেরে আকাশেও মাটি খুঁজে নেন মহিলা। ব্রেভো মিসেস আনোয়ারা খানম তরফদার!

তাকে এয়ারপোর্ট দিতে গিয়ে বুঝি এ ছাড়া আর বিকল্প কী! প্লেনের অ্যারাইভ্যাল দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে সুন্দর সুন্দর বুড়ো-বুড়িরা হুইল চেয়ারে ঈটির মত উড়তে উড়তে বেরিয়ে আসছেন। বাংলাদেশের মানুষ আজ পৃথিবীর সব দেশ ও মহাদেশেই আছেন। সন্তানদের সূত্র ধরে তারাও দখল করছেন ভিনদেশের মাটি, বাল্‌ জল ও পাথর আর আমরা তার তেজারতি করছি অবিরল। করছি বিদ্যা, বাণিজ্য, বংশবৃদ্ধি- ভাষায়, আশায়, ভালোবাসায়। 

তবু কিছু অন্তর্জ্বালা থাকবেই। তুমি তোমার ইচ্ছে মত মানুষের হাত ধরতে পারবে না। তোমার যৌনতা, জীবন, জগৎ, জাত সব ঠিক করে দেবে সেখানে আগে আসা পুরুষ ও পুরোহিত, মক্তব ও মোল্লা, পিতা ও পাদ্রী। এদেরও কাল শেষ হবে শিগগিরই। হবে তখনই যখন তাদের নিজসৃষ্ট ভূয়া নিয়মবিধিগুলোকে খুলে ধরা যাবে। সেটা সম্ভব হবে ভুল নয়, মূল বই পড়লেই। জেনে সেই ভাষা।

শুধু মাতৃভাষাটা জানি। তাই বলে কম তো কিছু পাইনি!
 
২৫ আগস্ট ২০২১ 
লন্ডন