ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৮, মার্চ ২০২৪ ২০:১৯:৫৫ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

দুর্গাপূজা : নারীরা যেখানে কাঁধে তুলে নেন ঢাক

বিবিসি বাংলা অনলাইন

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১২:৫৯ পিএম, ৭ অক্টোবর ২০১৯ সোমবার

কলকাতার অনেক পূজামণ্ডপেই দেখা যাবে পুরুষদের সাথে পাল্লা দিয়ে ঢাক বাজাচ্ছেন নারীরা।

কলকাতার অনেক পূজামণ্ডপেই দেখা যাবে পুরুষদের সাথে পাল্লা দিয়ে ঢাক বাজাচ্ছেন নারীরা।

কলকাতার অনেক পূজামণ্ডপেই দেখা যাবে পুরুষদের সাথে পাল্লা দিয়ে ঢাক বাজাচ্ছেন নারীরা। দুর্গাপূজাকে হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়ে থাকে নারীশক্তির আরাধনা। কিন্তু সর্বজনীন দুর্গাপূজা মূলত হয়ে ওঠে পুরুষকেন্দ্রিক। ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে পুরোহিত কিংবা ঢাকি-সবাই পুরুষ।

নারীদের দায়িত্ব বেশিরভাগ সময়েই থাকে শুধু পূজার উপাচারের ব্যবস্থা করা। তবে পশ্চিমবঙ্গে সেই পুরুষকেন্দ্রিক দুর্গাপূজার চিরাচরিত প্রথা কিছু ক্ষেত্রে হলেও ভাঙ্গা হচ্ছে।

নারীরা যে শুধুই পূজার যোগাড়যন্ত্র করছেন তা নয়, তারা কাঁধে ঢাক তুলে নিচ্ছেন, গোটা একটা মণ্ডপ গড়ে ফেলছেন, আবার কোথাও এক সাধারণ নারী তার অনন্য পেশার কারণে হয়ে উঠছেন দুর্গাপূজার 'থিম' বা বিষয়ভাবনা।

যদিও সংখ্যাটা এখনও হাতে গোনা, তবুও কলকাতার দুর্গাপূজায় যেসব নারীরা প্রথা ভেঙ্গে এগিয়ে এসেছেন, বা পুরুষকেন্দ্রিক পূজা কমিটিগুলো নারীদের সামনে এগিয়ে দিচ্ছেন, নারীরাই সামলাচ্ছেন গুরুদায়িত্ব, তাদেরই খোঁজ বিবিসি বাংলার এই প্রতিবেদনে:

নারী ঢাকি : কথায় বলে, ঢাকে কাঠি পড়া মানেই পূজা এসে গেল। কদিন আগে শহরতলির একটা পূজা প্যান্ডেলের বাইরে এক নারী কণ্ঠ বলে উঠল, "এই তোরা ঢাকগুলো তোলরে!"

যাদের উদ্দেশ্যে বলা, তারাও নারী-কেউ গৃহবধূ, কেউ স্কুল ছাত্রী, কেউ অন্য কোনও কাজ থেকে এখন শুধুই ঢাকি।

ঢাক কাঁধে তুলে দলের বাকিদের বাজনা শুরু করতে বললেন যিনি, তিনি মানসী দত্ত। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মসলন্দপুরের নারী ঢাকিলের অন্যতম সদস্য।

ঢাক বাজানোর মতো একটা পুরুষালি পেশায় এলেন কী করে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, "ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি যে ছেলেরাই ঢাক বাজায়। আমি যে কোনোদিন বাজাবো, ভাবিনি। বেশ কয়েকবছর আগে আমাদের শিক্ষক আর গুরু শিবপদ দাস একদিন এসে বললেন যে তিনি মেয়েদের নিয়ে ঢাকের দল গড়বেন। আমি শিখব কি না! রাজী হয়ে গেলাম। ব্যাস.. তারপর থেকে এটাই পেশা আমার।"

দলের আরেক সদস্য গৃহবধূ সুলতা মালি মিস্ত্রি। তিনি বলছিলেন, "বাড়ির বৌ ঢাক বাজাবে, এটা প্রথমে কেউই মেনে নিতে পারে নি। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করাতে হয়েছে। আর এখন তো আমরা দেশে বিদেশে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াই ঢাক নিয়ে। ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে বাজিয়েছি, রাষ্ট্রপতি ভবন, প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি - সব জায়গায় গেছি। এত সম্মান পাই, তাই এখন বাড়িতে আর কিছু বলে না। সবাই উৎসাহই দেয়।"

দলের কনিষ্ঠ সদস্যদের মধ্যে প্রার্থনা দাস স্কুলে পড়েন। তার অবশ্য ঢাক বাজানো নিয়ে বাড়িতে কোনও আপত্তি ওঠে নি, কারণ তার মা, দিদি, পিসী, বৌদি - সকলেই ঢাক বাজান।

প্রার্থনা গোঁড়ার দিকে বড়দের ঢাক বাজানো দেখতেন শুধু। তারপরে একদিন নিজেই কাঁধে তুলে নিলেন ঢাক। ওর অবশ্য পূজার সময়ে ঢাক বাজানোর জন্য বাড়ি ছেড়ে বাইরে থাকতে মন খারাপ হয়।

"বন্ধুদের সঙ্গে পূজা দেখতে যেতে পারি না, ঘোরা-আড্ডা দেওয়া হয় না। মন তো একটু খারাপ লাগবেই," বলছিলেন প্রার্থনা।

কাঠের তৈরি ভারী ঢাক নিয়ে নেচে নেচে বাজাতে নারী ঢাকিদের কষ্ট হচ্ছে বুঝে তাদের দলনেতা আর গুরু শিবপদ দাস এখন টিনের ঢাক বানিয়ে দিয়েছেন। আর তিনি নারী ঢাকিদের যেখানেই বাজাতে পাঠান না কেন, তাদের নিরাপদে রাখার দায়িত্ব দিয়ে অন্তত দুজন পুরুষ ঢাকিকেও সঙ্গে পাঠান।

সাধারণ এক নারী এবার পূজার 'থিম' : কলকাতার দুর্গাপূজায় 'থিম' বা কোনও একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গোটা পূজা সাজিয়ে তোলার শুরু মোটামুটিভাবে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকে। গোঁড়ার দিকে সেগুলিকে বলা হত 'আর্টের ঠাকুর' আর চিরাচরিত, পুরাণে আখ্যায়িত রূপে যেসব প্রতিমা তৈরি হত সেগুলো 'সাবেকী ঠাকুর'।

তারপরে বিষয়টা আর শুধু প্রতিমা তৈরিতে সীমাবদ্ধ থাকল না। প্রতিমা-মণ্ডপসজ্জা-আলোকসজ্জা, সব মিলে গড়ে উঠত একটা বিষয়কেন্দ্রিক ভাবনা। সেটারই চালু নাম 'থিমের পূজা'।

সাধারণত কোনও চলতি সামাজিক বিষয় বা ক্রীড়া ক্ষেত্রের কোনও বিষয়, অথবা কোনও বিখ্যাত ব্যক্তি বা কোনও সময়ে আবার রাজনৈতিক-কূটনৈতিক এসব বিষয়ও উঠে আসে 'থিমের পূজা'য়।

কিন্তু কখনও একেবারে সাধারণ এক নারী পূজার 'থিম' হয়ে উঠেছেন, এমনটা আগে শোনা যায়নি। ওই নারী সাধারণ হলেও তিনি যে কাজটা করেন, সেটা একেবারেই অনন্য। তিনি একটা যাত্রীবাহী বাস চালান কলকাতা শহরে।

প্রতিমা পোদ্দার কলকাতার প্রথম নারী বাসচালক। গোঁড়ায় ট্যাক্সি চালাতেন, তারপরে স্বামী যে বাসে ড্রাইভার ছিলেন, সেই বাসের স্টিয়ারিং ধরেন নিজে। আর স্বামী কন্ডাক্টর। বছর ছয়েক ধরে বাস চালিয়ে দুই মেয়েকে পড়াশোনা করিয়েছেন। একজন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, অন্যজন কিছুটা ছোট। আর দুই মেয়েকেই গড়ে তুলেছেন জাতীয় স্তরের সাঁতারু হিসাবে। আবার বাড়িতে কুড়ি বছর ধরে শয্যাশায়ী শাশুড়ির দেখাশোনাও তাকেই করতে হয়।

তাকে এবং তার কাজকে সম্মান জানাতেই উত্তর কলকাতার একটি পূজা 'থিম' হিসাবে বেছে নিয়েছে মিসেস পোদ্দারকে।

"যখন এরা প্রথম জানালেন যে আমাকে পূজার থিম করতে চান তারা, খুব অবাক হয়েছিলাম। এর আগে কয়েকটা টিভি অনুষ্ঠানে গেছি - তাই অনেক মানুষ হয়তো আমার কথা জানেন, কিন্তু পূজার থিম হব আমি - এটা খুব অবাক করেছিল," বলছিলেন মিসেস পোদ্দার।

কিন্তু তারপরে পোদ্দার দম্পতি ভেবে দেখেন, যে কাজ তিনি করছেন, সেটা যে নারী হয়েও করা যায়, এই ভাবনাটা যদি পূজা দেখতে আসা নারীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তো আরও অনেকেই এগিয়ে আসতে পারেন। অন্তত এটা ভাবতে পারেন যে এমন কোনও পেশা নেই যা পুরুষরাই শুধু পারে, নারীরা পারেন না!

যে পূজাতে প্রতিমা পোদ্দারকে থিম করা হয়েছে, সেই প্যান্ডেলে রয়েছে মিসেস পোদ্দার যে বাসটি চালান তার প্রতিকৃতি - তার বাসের রুট ম্যাপ - আর আস্ত একটি মূর্তি। গোটা মণ্ডপেই ছড়িয়ে আছে নারীশক্তির এই জীবন্ত চিহ্ন।

মণ্ডপও বানাচ্ছেন নারীরা : নারীরা আবার কিছুটা অন্যভাবে হাজির দক্ষিণ পূর্ব কলকাতার একটি নামকরা পূজার প্যান্ডেলে। ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দুর্গম অঞ্চলের কয়েকটি গ্রাম থেকে আসা নারীরাই ওই মণ্ডপের অঙ্গসজ্জা হাতে তৈরি করেছেন।

সোহরাই আর কোভার পেইন্টিং নামে স্বল্প পরিচিত এই আর্টফর্মে চার রঙের মাটি দেওয়ালের গায়ে লেপে তার ওপরে চিরুনি দিয়ে ছবি এঁকেছেন ওই আদিবাসী নারীরা।

তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম প্যান্ডেল বানানোর মতো একটা পুরুষালী কাজ করার জন্য বাড়ি ছেড়ে এতদূর চলে আসতে পারলেন সাহস করে?

পার্ভতী দেবী একজন নারী শিল্পী। তিনি বলছিলেন, "পুরুষদের যে ক্ষমতা আছে, আমরাও সেই সব কাজই করতে পারি। আমাদের হাত থেকেও শিল্প বেরোয়। কোনও অংশেই পুরুষদের থেকে কম নই আমরা। আর গ্রামের বাড়িতে তো মেয়েরা এভাবেই দেওয়াল ছবি আঁকি!"

আরেকজন শিল্পী অনিতা দেবী। তিনি বলেন, "এত বড় প্যান্ডেল বানানোর ক্ষমতা যে আমাদেরও আছে, সেই সাহসে ভর করেই এত বড় কাজের দায়িত্ব নিয়েছি। অনেকদিন বাড়ি ছেড়ে থাকতে হচ্ছে ঠিকই কিন্তু তার জন্য পরিবারের কেউ কখনও বাধা দেয় না। তবে নিয়মিত ভিডিও কলে বাড়ির সঙ্গে কথা হয় - তারা আমাদের কাজ দেখে। আর শুধু কলকাতা নয় - দেশ বিদেশের নানা জায়গাতেই তো যাই আমরা শিল্পকলা দেখাতে,"।

ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নারী : নারীরা যেমন কেউ ঢাক বাজাচ্ছেন, কেউ মণ্ডপ গড়ছেন বা কেউ নিজেই পূজামণ্ডপের মূল ভাবনা হয়ে উঠেছেন, তেমনই অনেক পূজার গোটাটাই সামলাচ্ছেন নারীরাই।

দক্ষিণ কলকাতার এরকমই একটি পূজা প্যান্ডেলে নারীরাই সব ব্যবস্থার দায়িত্বে থাকেন। তাদের মণ্ডপে যেদিন সকালে গিয়েছিলাম, তারা আলোচনা করছিলেন শেষ মুহূর্তের পূজার ব্যবস্থাপনা নিয়েই।

নারীদের পরিচালিত ওই পূজার অন্যতম উদ্যোক্তা পুতুল গুপ্তের কাছে জানতে চেয়েছিলাম ঘর-সংসার সামলিয়েও পূজার ব্যবস্থা করেন কীভাবে?

"পূজার আগে আমরাই অনেকটা দশভুজা হয়ে উঠি। সবারই সংসার আছে, তারমধ্যেই মিটিং করে ঠিক করে নিই কে কোন কাজটা করবে। তারপরে আছে চাঁদা তুলতে বেরনো। প্রতিমা নিয়ে আসার কাজটা অবশ্য ছেলেরাই করে - আমরা পাশে থাকি। তারপরে পূজার দিনগুলোতে অনেক ভোরে উঠে সব যোগাড় করতে হয়। কিন্তু সারাদিনে যত মানুষ আসেন আমাদের পূজাতে, তাদের আনন্দ দেখে আমরা যেন আরও বেশী উৎসাহ পাই প্রতিবছর পূজার কাজে আরও জড়িয়ে পড়তে," বলছিলেন পুতুল গুপ্ত।

এই প্রতিবেদনের জন্য যতজন নারীর সঙ্গে কথা বলেছি, তারা হয়তো কেউ কাউকে চেনেন না--কিন্তু এক জায়গায় তাদের মতের ভীষণ মিল। নারীরা যদি মহাকাশে যেতে পারে, যুদ্ধবিমান চালাতে পারে-তাহলে পূজা সামলানো বা ঢাক বাজানো অথবা প্যান্ডেল তৈরি কী এমন কঠিন, বিশেষ করে পূজাটাই যখন নারীশক্তির উদ্দেশ্যেই।