ঢাকা, শুক্রবার ২৯, মার্চ ২০২৪ ১৬:২৬:৩৪ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

আবরার, আমাদের তুই ক্ষমা করিস না বাবা: মাহমুদা আকতার

মাহমুদা আক্তার

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০১:০২ এএম, ১২ অক্টোবর ২০১৯ শনিবার

নিহত আবরার।  ছবি : ফেসবুক থেকে।

নিহত আবরার। ছবি : ফেসবুক থেকে।

আবরারের হত্যা নিয়ে এক একটা সংবাদ পড়ছি আর ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। একটু আগে এক পত্রিকায় হত্যার আসামি ইফতি মোশাররফ ওরফে সকালের জবানবন্দি পড়লাম। পড়তে পড়তে আমি কেঁদে উঠেছি। কষ্টে ফেটে যেতে চাইছে বুকটা। ড্রাকুলার মতো নির্মম এরা কারা, এতটা নিষ্ঠুর ওরা কীভাবে হলো, এত অল্প বয়সে এত নিষ্ঠুরতা কীভাবে সম্ভব। এভাবেও কি একজন মানুষকে, মাত্র ২১ বছর বয়সের এক তরুণকে পেটানো যায়? এভাবে তো মানুষ একজন চোরকেও পেটায় না। অথচ  সহপাঠীরা, রোজ ঘুম ভেঙে প্রথমে তো তাদের সঙ্গে দেখা হতো তার। ঘুমাতে যাওয়ার আগেও তাদের চেহারাই দেখতো সে। প্রতিদিন কলেজের কড়িডোরে, ক্যাম্পাসে, ক্লাসে, লাইব্রেরিতে ওরাই তো ছিলো তার নিত্যসঙ্গী। অথচ তাকে এভাবে পেটাতে একটুও বুক কাঁপলো না তাদের। আমরা অর্থ আর শ্রম দিয়ে কি রকম একটা অমানুষ প্রজন্ম তৈরি করছি!
আমরা তো আমাদের সন্তানদের কোনো মানবিক শিক্ষা দেইনা। অন্যদের সঙ্গে তুলনা করে সারাদিন তাদের কানের কাছে কেবল বলি, ‘পড়, পড়, আরো পড়তে হবে। মা-বাবা আর আত্মীয়-স্বজনদেরও একই কথা,‘বাবা, তোকে ফার্স্ট হতে হবে। বড় চাকরি নিতে হবে। বিসিএস পরীক্ষায় টিকতে হবে।’তাহলে তো এমনই হবে। আমরা বাবা-মােয়েরা ছেলেদের বুয়েটে ভর্তি করিয়েই ভাবি সব দায়িত্ব শেষ। ছেলেকে স্বর্গের সিড়িতে পৌঁছে দিলাম, আর কোনো চিন্তা নাই। দু দিন পর পাস করে বিদেশ চলে যাবে, তারপর তো খালি টাকা আর টাকা। শুনতে খারাপ লাগলেও অনেকটা এরকমই আমাদের অভিবাবকদের মানসিকতা। এজন্য বুয়েতে ভর্তি হয়ে ছেলেটা বা মেয়েটা কি করছে সে খবরও তারা রাখার প্রয়োজন বোধ করেন না। আবরার হত্যায় ধৃত আসামিদের কয়েকজনের বাবা-মায়ের প্রতিক্রিয়া বেরিয়েছে পত্রিকায়। সেখানে তাদের সবার একই কথা, ছেলেরা যে ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে, সাধারণ ছাত্রদের ওপর টর্চার করছে, এটা তারা জানেনই না! কী করে জানবেন, তারা তো ভাবছেন ছেলে আবার মস্ত ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে, সারাদিন শুধু পড়ছে আর পড়ছে। হায় ভবিতব্য!
অভিভাবদের আপনি কি দোষ দিবেন বলুন! তারা তো বুয়েট প্রশাসনের হাতে ছেলেদের তুলে দিয়ে গেছেন। ভেবেছেন বুয়েজের এত এত দিগগজ পণ্ডিত তারাই তো আমাদের বাচ্চাদের নিজের সন্তানদের মতো দেখে রাখবেন। কিন্তু তাদের ভূমিকাটি কি? দিনের পর দিন ছাত্রলীগের ছেলো‘টর্চার রুমে’নিয়ে ছাত্রদের পেটাচ্ছে অথচ তারা সে খবর জানেনই না। তাহলে হলগেুলোতে প্রভোস্ট থাকার দরকার কি। তাদের সব হম্বি তম্বি কেবল সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে! রাজনীতি করলে সেই ছেলেদের কিছু বলা যায় না! ভিসি থেকে শুরু করে সব শিক্ষকরা সেসব তথাকথিত সেইসব নেতাদের সমীহ করেন। তাই আবরার হত্যার দায় তারা কিছুতেই এড়াতে পারেন না, এখন যত মায়াকান্নাই কাঁদুন না কেন।
সেইদিন এই হল প্রশাসন যদি একটু সচেতন হতেন, একটু যদি খোঁজখবর নিতেন তাহলে হয়তো আবরারকে এভাবে মরতে হতো না। অবশ্য এমনটা হলেই বা কি হতো, তখন হয়তো আহত আবরারকে শিবির পরিচয় নিয়ে রাতের অন্ধকারে চিরদিনের মতো হল ছেড়ে চলে যেতে হতো। এরপর হয়তো তার বাবা এসে ভিসি বা প্রভোস্টের হাতে পায়ে ধরে কান্নাকাটি করতেন। বলতেন,‘স্যার, দয়া করেন, আমার ছেলেকে আরেকবার সুযোগ দিন, আবরারের জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে।’জানি, তখনও আবরারের বাবার কান্নায় মন গলতো না এইসব শিক্ষকদের। তারা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনটির সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে আবরারকে হলে ফিরিয়ে নিতে পারতেন না। তার চেয়ে এই ভালো হয়েছে আবরার, তুই মরে গিয়ে সবাইকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেছিস। কবরের নির্জতায় নিশ্চিন্তে শুয়ে থাক তুই। সেখানে আর কেউ তোকে শিবির সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদ করবে না। তোর মোবাইল, ল্যাপটপে আতিপাতি করে খুঁজবে না তুই সরকার বা ভারতের বিরুদ্ধে কি স্ট্যাটাস দিয়েছিস। তাই আশা করি কবরে তুই ভালোই থাকবি আবরার।
তাই বলে তুই কিন্তু ওদের কাউকে ক্ষমা করিস না। শুধু ঘাতকদের নয়, এই বুয়েট, ভিসি, শিক্ষক, প্রশাসন, এই রাষ্ট্র, সমাজ অথর্ব সুশীল কাউকে নয়। আমাদের কাউকে তুই ক্ষমা করিস না।

১১ অক্টোবর ২০১৯

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক