বামন রাজ্য ও প্রজাপতি বাগান : শান্তা মারিয়া
শান্তা মারিয়া
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ১১:৩২ পিএম, ১১ নভেম্বর ২০১৯ সোমবার
শান্তা মারিয়া
স্নো হোয়াইট অ্যান্ড সেভেন ডোয়ার্ফ, রেড রোজ অ্যান্ড স্নো হোয়াইট, স্লিপিং বিউটিসহ ইউরোপের অনেক রূপকথাতেই পড়েছি ডোয়ার্ফদের কথা। আর কার্টুনে দেখেছি স্মার্ফদের। গালিভার আর লিলিপুটের গল্পও সকলের জানা।বাস্তবে ইউননানে রয়েছে বামন রাজ্য। কুনমিং শহরের খুব কাছে শিশান বা পশ্চিম পাহাড়ের একটা অংশে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল এক থিম পার্ক। এই থিম পার্কে চাকরি পেয়েছেন চীনের অনেক বামন মানুষ। জিনগত কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে অনেক মানুষ উচ্চতা-প্রতিবন্ধীতে পরিণত হন। তারা অনেক সময় চাকরি পান না। জীবিকার জন্য ভিক্ষা করতেও বাধ্য হন কেউ কেউ। সমাজে তাদের নিয়ে হাসি তামাশা ও নিষ্ঠুরতাও চলে। এই দুর্দশা থেকে তাদের উদ্ধার করতে এবং তাদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে গড়ে তোলা হয়েছে একটি থিম পার্ক। ডোয়ার্ফ কিংডম নামে এই থিম পার্কে তিনফুট উচ্চতার নিচের মানুষরা চাকরি পেয়েছেন। তাদের রূপকথার বামনের ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়। এই থিম পার্কটি দেশে-বিদেশে বেশ আলোচিত। তাই ভাবলাম একবার দেখেই আসা যাক না।
নভেম্বরের এক হিমেল সকালে রওনা হলাম থিমপার্কের উদ্দেশ্যে। সঙ্গী হলেন ভারতের মনিপুরবাসী রনিবালা লাইসারাম, রুহিমা খান, পাকিস্তানের কাশ্মীরীকন্যা জাভারিয়া চুঘতাই এবং শ্রীলংকার দুরন্ত মেয়ে চাতুরিকা জৈমিনি। এরা আমার সহকর্মী ও বন্ধু।
সাবওয়ে স্টেশন থেকে নেমে, ট্যাক্সি নিয়ে আমরা চললাম পার্কের উদ্দেশ্যে। সাবওয়ে থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে এই রাজ্য। পার্কের প্রবেশ পথেই রয়েছে প্রায় ২০টি ভাস্কর্য। সবই পরীর। প্রথমে ঢুকতে হলো বাটারফ্লাই পার্কে। হাজার হাজার প্রজাপতির নমুনা রয়েছে এখানে। এমন শৈল্পিকভাবে সেগুলো সাজানো যে দেখে অবাক হতে হয়। দর্শকদের মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশি যারা প্রজাপতির চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর। প্রজাপতি প্রদর্শনীর পর বাগান। এবং বাগানের পরই বামন রাজ্যের প্রবেশপথ। রাজপ্রাসাদে যাবার পথ বেশ লম্বা। পুরোটাই পাহাড়ি পথ,ফুলে ফুলে চোখ জুড়ানো শোভা। আমরা তো ছবি তুলতে তুলতে সময়হারা হয়ে গেছি প্রায়। বামনদের জন্য এখানে পাহাড়ের উপর বানানো হয়েছে রূপকথার আদলে ঘরবাড়ি। এগুলো মাশরুম কটেজ। রঙিন আর দারুণ সুন্দর। ভিতরেও প্রবেশ করে দেখা যায় ছোট ছোট খাট, টেবিল চেয়ার। মনে হয় যেন স্নোহোয়াইট হয়ে আমরাই চলে এসেছি সেভেন ডোয়ার্ফের বাড়িতে।
বেশ উঁচু একটা টাওয়ারে উঠলাম ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে। তারপরেই কাচের সেতু। চীনে আজকাল গ্লাস ব্রিজ বা কাচের সেতু খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সব থিম পার্কেই একটা না একটা কাচের সেতু রয়েছে। এখানে দুই পাহাড়ের মাঝখানে রয়েছে ঝুলন্ত কাচের সেতু। আমি কি এই সেতুতে চড়ে ভয় পেয়েছিলাম? আচ্ছা সে কথাটি নাহয় গোপনই থাকুক। এই পার্কে রয়েছে আরও দুটি ঝুলন্ত সেতু। তারমধ্যে একটি বিশাল দৈর্ঘ্যের। এক পাহাড় থেকে চলে গেছে অন্য পাহাড়ের চূড়ায়। আরও রয়েছে ডায়নোসর পার্ক।যেখানে বিশাল সব ডায়নোসরের মূর্তি। সেগুলো আবার কোনটি লেজ নাড়ায়, কোনটি মাথা ঝাঁকায়। গর্জন তো করেই। রয়েছে স্লাইড চড়ার ব্যবস্থা। পাহাড়ের গা বেয়ে স্লাইডে চড়ে নামতে হয় পাহাড়ের নিচে। ঝর্না, নদী, লেক রয়েছে। ফেয়ার হইল, রোলার কোস্টার এসব তো আছেই। সব দেখে বেশ ক্লান্ত হয়ে আমরা বেলা তিনটা পঞ্চাশ নাগাদ পৌছালাম বিশাল কোলা মঞ্চের কাছে। এর মধ্যে অবশ্য এক ফাঁকে আমরা দুপুরের ভোজন সেরে নিয়েছি আলুভাজা আর ফ্রাইড রাইস দিয়ে।
ঠিক সময়ে বিশাল স্টেডিয়ামে শুরু হলো ডোয়ার্ফ প্রদর্শনী। নাচ গান, অ্যাক্রোবেট সবই দেখালেন খুদে মানুষরা। এখানে কারও কারও উচ্চতা ২ ফুটেরও কম। এদের মধ্যে অনেকে বেশ উচ্চ শিক্ষিত। পরীর ডানা লাগানো পোশাক পরে চমত্কার নাচ গান পরিবেশন করলেন অনেকে। এখানে ১৮ থেকে ৪৯ বছর বয়সের বেতনভুক শিল্পী আছেন। কোন শিশু নেই। বেশি বয়স্কও কেউ নেই। জাদু দেখালেন দুজন। গান মোনালেন কয়েকজন মিল্পী। দর্শকদের মধ্যে শিশু ও শিশুর অভিভাবকের সংখ্যাই বেশি। একটা বিষয় খেয়াল করলাম, দর্শকদের মধ্যে কেউই এই খুদে মানুষদের প্রতি কোন রকম অসম্মানজনক বা অপমানজনক আচরণ করছেন না। তাদের উদ্দেশ্যে হাসি তামাশাও করছেন না কেউ। যথাযথ সম্মান দিয়েই তাদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা উপভোগ করছেন সবাই। খুদে মানুষদের সঙ্গে ছবি তোলারও কোন অনুমতি নেই। একমাত্র সাংস্কৃতিক পরিবেশনার সময় তাদের ছবি তোলার অনুমতি রয়েছে। আমরা বিদেশি বলে অনুরোধ করায় একজন সিনিয়র শিল্পী আমাদের সঙ্গে আলাদা করে ছবি তুললেন। মোটকথা কোনভাবেই তাদের সঙ্গে ‘এক্সিবিট’ হিসেবে আচরণ করা যাবে না। তাদের শিল্পী হিসেবে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হবে।
পুরো পার্কের প্রাকৃতিক পরিবেশ অসাধারণ সুন্দর। মনে হয় সত্যিই যেন রূপকথার রাজ্য।সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে কখন যে সন্ধ্যা নেমেছে তা টেরই পাইনি। পার্ক বন্ধের ঘোষণা শুনে চমক ভাঙলো। সারাদিনের ভালোলাগা ও মুগ্ধতা নিয়ে আমরা ফিরে চললাম আমাদের বাসস্থান ছেংকংয়ের পথে।