রাজধানীর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর বেহাল অবস্থা
আফরোজা ফিরোজ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশিত : ০৮:০৭ এএম, ১৩ নভেম্বর ২০১৩ বুধবার
রাজধানী ঢাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর বেহাল অবস্থা৷ সরকারী পর্যায়ে বহু অনুদান ও প্রণোদনা দেয়া সত্ত্বেও বিদ্যালয়গুলোর অবস্থায় কোন পরিবর্তন নেই৷ বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে অবকাঠামোগত সমস্য৷ এমনকি রয়েছে পানি, বিদু্যত্সহ টয়লেট সমস্যা৷ গত কয়েকদিন ঢাকার কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরজমিনে পরিদর্শনে জানা গেছে গত এক দশকেও এ বিদ্যালয়গুলোতে উন্নয়নের কোনও ছোঁয়া লাগেনি৷ শিক্ষক ও পিয়ন সংকট ঃ মোহম্মদপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের অভাব৷ খিলগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশপাশে বিক্রি হয় মাদক দ্রব্য৷ শানত্মিনগর কো-অপারেটিভ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই ঝাড়ুদার ও পিয়ন৷ শিক্ষার্থীরা নিজেরাই ঝাড়ু দেয় ক্লাসরুম৷ রায়ের বাজার রাজ মুসুরি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিজস্ব প্রবেশ দ্বার বন্ধ রেখে অন্য আরেকটি বিদ্যালয়ের গেট ব্যবহার করা হয়৷ ঢাকায় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাপ্রদান পদ্ধতি নিম্নমানের৷ রয়েছে চরম শিক্ষক সংকট৷ কোনো কোনো স্কুলে আছে মেট্রিক পাশ শিক্ষক৷ বিদ্যালয়গুলোর বাহ্যিক অবস্থা নাজুক৷ রয়েছে ভবন সংকট ও শিক্ষা উপকরণ স্বল্পতা৷ শিক্ষকদের বিভিন্ন সরকারী কর্মসূচিতে নিযুক্ত করা হয়৷ জন্মনিয়ন্ত্রন কর্মসূচি, শিশু জরিপ কর্মসূচি এবং নির্বাচনী ভোটার তালিকা তৈরিতেও তাদের কাজ করতে হয়৷ এদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, শিক্ষককের স্বল্পতা, ছাত্র-ছাত্রী ঝরে পরা ও জবাবদিহিতার অভাব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মান নেমে যাওয়ার জন্য দায়ী৷ রাজধানীর বেশ কয়েকটি বিদ্যালয় সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে বিদ্যালয় বসছে পরিত্যক্ত ভবনে৷ দেয়ালে উঠেছে আগাছা৷ শ্যাওলা পড়ে সঁ্যাতস্যাতে দেয়ালে বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপনে ভরা৷ শতকরা ৯৮ ভাগ বিদ্যালয়ে নেই খেলার মাঠ৷ বিদ্যালয় কক্ষ সপ্তাহে একদিনও ঝাড়ু দেওয়া হয় না৷ নেই পাখা, নেই পর্যাপ্ত বিদু্যত্৷ দেয়া হয় না টিফিন৷ নেই ক্যান্টিন৷ অথচ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র বলছে, এক চতুর্থাংশ প্রাথকি বিদ্যালয়গুলোর শ্রেণী কক্ষে বৈদু্যতিক বাতি ও পাখা রয়েছে৷ পরিসংখ্যান মতে, দেশে সরকারী ও বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট সংখ্যা ৮০ হাজার ৩`শ ৯৭টি৷ সরকারী বিদ্যালয় ৩৭ হাজার ৬`শ ৭২টি৷ রাজধানী ঢাকায় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২৯৫টি৷ মোট শিক্ষার্থী ৬ লাখ ৯১ হাজার ৯২৮ জন৷ ছাত্রের সংখ্যা ৩ লাখ ২৭ হাজার ৬১০৷ ছাত্রীর সংখ্যা ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৩১৮৷ প্রধান শিক্ষককের সংখ্যা ২৯৬ জন, সহকারী শিক্ষক ২ হাজার ৭২ জন৷ প্রাথমিক শিক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে৷ শ্রেণী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কমতে থাকে৷ সরকারী হিসাবে ২০১২ সালে শিক্ষার্থী ভর্তির হার ছিল ৯৯.৪৭ শতাংশ৷ প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ২১ শতাংশ৷ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, ঝরে পড়ার হার ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ৷ কারণ হিসেবে এ সংস্থাটি বলে শিক্ষার গুনগত মানের অভাব, শিক্ষার্থীদের আয়মূলক কাজে যুক্ত থাকা, শিক্ষার ব্যয় নির্বাহ করতে না পারা, বিদ্যালয়ে অনিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম ও অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে না আনা৷ এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, পরীক্ষায় ঝরে পড়ার হার কমেছে৷ অভিভাবকদের আনত্মরিকতা ও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনযোগী হয়ে ওঠায় ঝরে পড়ার হার কমানো সম্ভব হয়েছে৷ এ ছাড়া পরীক্ষা নিয়ে পরীক্ষার্থীদের যে ভীতি ছিল তা শিশুদের কমেছে৷ সব মিলিয়ে লেখাপড়ার ধারাবাহিকতায় ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে৷ তবে বাংলাদেশে এখনও ১০ শতাংশ শিশু স্কুলে যায় না৷ এদিকে ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত মোহম্মদপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ৭`শ ৩০ জন৷ ২০০৭ এ ছিল মোট ৬`শ ৫৭ জন৷ বর্তমানে ৩`শ ৭০ জন ছাত্র ও ৩`শ ৫৪জন ছাত্রী৷ মোহম্মদপুর থানাধীন ১৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সাড়ে ১২ হাজার৷ মোহম্মদপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামরুন নাহার কানত্মা জানান, এখানে সব কিছুরই সংকট৷ যেমন শিক্ষকের অভাব রয়েছে তেমনি নেই চেয়ার, বেঞ্চ, ফার্নেল বোর্ড৷ একটি বেঞ্চে ৪ জন বসে৷ আর ৪ জন শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে থাকে৷ রয়েছে পিয়নের অভাব৷ শিক্ষক মাত্র ১৬ জন৷ তার মধ্যে ৪ জন ছুটিতে৷ কেউ মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আবার কেউ কর্মশালায়৷ দুটি পদ খালি৷ শানত্মিনগর কো অপারেটিভ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রয়েছে ক্লাশরুম সংকট৷ মাত্র চারটি রুমে এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ক্লাশ করে৷ ক্লাশ চালাতে হয় চার শিফটে৷ প্রধান শিক্ষক তোহা পাটোয়ারী জানান, শিফটিং ক্লাশ করায় শিক্ষকদের ওপর চাপ পড়ে৷ সকাল ছয়টা থেকে শুরু করে বিকেল পাঁচটা পর্যনত্ম ক্লাশ নিতে হয়৷ শিক্ষকদের আলাদা বসার ঘর নেই৷ আলমারী দিয়ে আড়াল করে বসার জায়গা করা হয়েছে৷ রয়েছে শিক্ষক সংকট৷ মাত্র ৯ জন শিক্ষক৷ প্রয়োজন ১৫ জনের৷ শিক্ষা সচিব কামাল আব্দুল নাসের বলেছেন, বিভিন্ন রকমের প্রশিক্ষণ ও ছুটিতে থাকার কারণে রয়েছে শিক্ষক সংকট৷ শিক্ষা নিয়ে বেসরকারি সংস্থাগুলোর মোর্চা গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, সরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষার পরিবেশ আরও শিশুবান্ধব করতে হবে৷ এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষকদের বেতন ভাতা বাড়ানোর পাশাপাশি অভিভাবকদের মানসিকতা বদলাতে হবে৷ ১৫টি বিদ্যালয়ের জমি দখলঃ ভূমিদসু্যরা কেবল বসতবাটি ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জমিই দখল করে না৷ স্কুলের জমিও দখলে নেয়৷ সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে ঢাকার ১৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জায়গা দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালীরা৷ চলছে মামলা৷ চলছে দেন দরবার৷ কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না৷ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ১৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জায়গা বেদখল হয়ে গেছে দীর্ঘদিন আগেই৷ বিদ্যালয়ের জমিতে ভবন, ঘর ও দোকান করা হয়েছে৷ কাপ্তানবাজারের খোদাবঙ্ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় দখলের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে৷ মোহম্মদপুর টাউন হল সংলগ্ন শাহীন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩১ শতাংশ জমি দখল হয়ে গেছে৷ এ স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৮ সালে৷ দখলকৃত জায়গায় বসবাস করছে আটকে পড়া পাকিসত্মানীরা৷ ওরাই খাজনা দেয়৷ আশপাশের বাসিন্দারা অভিযোগ কওে বলেন, এরা সবাই ভোটার৷ তবে ক্যাম্পে না থেকে তারা থাকে স্কুলের জায়গা দখল করে৷ স্কুলের প্রধাণ শিক্ষক শুক্লা ব্যার্ণাজী জানান, এখানে শিক্ষার্থী মাত্র ১`শ ৫০ জন৷ পরিবেশের জন্য কেউ এ স্কুলে আসতে চায় না৷ সবাই একেবারে নিম্নবিত্ত৷ তবে পড়াশোনায় ভাল৷ গত প্রাথমিক পরীক্ষা সবাই পাশ করেছে৷ এখানে পিওন দু`জন৷ একজনের বেতন মাত্র ২`শ টাকা৷ মোহম্মদপুরের থানা শিক্ষা কর্মকর্তা শাহানা আহমেদ বলেন, স্কুলের জমি দখলমুক্ত করা দরকার৷ আমরা চেষ্টা করছি৷ নাজিরাবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়৷ এর দশ শতাংশ জায়গা দখল করে নিয়েছে নাজিরাবাজার উচ্চবালিকা বিদ্যালয়৷ এ স্কুল প্রাঙ্গণে প্রায় প্রতি সপ্তাহে চলে বিয়ের রান্নাবান্না৷ স্কুলের ভেতর মঞ্চ৷ বড় হাঁড়িতে চলে রান্না৷ কোতয়ালি থানার শিক্ষা কর্মকর্তা রুমানা সাবি্বর বলেন, আমরা স্কুল কর্তপক্ষকে বলেছি তারা যেন এসব রান্না বান্নায় রাজি না হন৷ স্কুল কর্তর্ৃপক্ষ জানায়, তারা বার বার প্রতিবাদ করলেও কোনও কাজ হয়নি৷ ৯৬ সালে নিজ জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় মতিঝিল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়৷ ২০০৭ সালে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ন ঘোষণা করা হয়৷ এর ফলে ঐ স্কুলের শিক্ষার্থীদের ক্লাশ করতে হয় পোষ্ট এন্ড টেলিগ্রাফ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে৷ নতুন ভবন করতে গেলে বাঁধা দিয়ে জমিটি দখল করে নেয় পাশের কলোনি উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ৷ শেরে বাংলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৯৬ শতাংশ জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত৷ এ স্কুলের ৩৩ শতাংশ জায়গা দখল হয়ে গেছে৷ কামরাঙ্গীরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪২ শতাংশ জমির মধ্যে ১০ শতাংশই দখল হয়ে গেছে৷ ওয়ারীর এম এ আলীম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১১ শতাংশ জমির ৫ শতাংশই দখল হয়ে গেছে৷ সেখানেও উঠেছে পাঁচতলা ভবন৷ গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট জমি ৩৭ শতাংশ৷ স্কুলের দখলে রয়েছে মাত্র ১২ শতাংশ৷ সামাজিক শিক্ষাকেন্দ্র সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার কাঠা জায়গা দখল হয়ে গেছে৷ ১৯৬২ সালে বেইলী রোডে প্রতিষ্ঠিত এ স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০৷ এ ছাড়া এফ কে এম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সুরিটোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাচকৃঢ়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হাজী ইউসুফ আলী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জায়গাও দখল হয়েছে অনেক আগেই৷ ১২ নভেম্বর`২০১৩
