ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৮, মার্চ ২০২৪ ২২:৪৩:৪০ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

জলে কার ছায়া: আহমেদ মুশফিকা নাজনীন

আহমেদ মুশফিকা নাজনীন

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১২:৩১ এএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯ শুক্রবার

আহমেদ মুশফিকা নাজনীন

আহমেদ মুশফিকা নাজনীন

তখন স্কুলে পড়ি। হঠাৎ করে ‘সুস্থ থাকু‘ এ নিয়ে সচেতন হয়ে উঠি তিন বোন। এক শীতের সকালে বোনরা মিলে খালি পায়ে সবুজ ঘাসে হাঁটি। শিশির নিয়ে চোখে মাখি। মুখে মাখি। তাতে নাকি চোখ আরাে ভালো হয়। রাজশাহী টিটি কলেজের মাঠের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় আমরা হেঁটে বেড়াই। এক ঘণ্টা পর বাসায় এসে আস্ত ফুলকপি সিদ্ধ খাই।

তারপর ধপাস করে বিছানায় শুয়ে ঘুম। সারাদিন আর সে ঘুম ভাঙ্গে না। আব্বা একটু পর পর আসেন, মা ওঠো ভাত খাও। ঘুম জড়ানো গলায় বলি, আব্বা আর একটু ঘুমাই। মাথা ব্যাথা করছে। সারাদিন যায় আমাদের ঘুমাতে ঘুমাতে। রাতে সে ঘুম ঝরঝরে হয়। আব্বা হেসে বলেন, থাক মা, তোমাদের আর ভোরে হাঁটার দরকার নেই। তোমরা সারাদিন চুপচাপ থাকলে আমার ভালো লাগে না। আমরাও বলি হ্যাঁ আব্বা, ভোরে ওঠা খুব ঝামেলা, কষ্ট।

ইংরেজি শেখার জন্য বসি স্পোকেন কোর্সের বই নিয়ে। বিশটা করে শব্দ মুখস্ত করি। সাথে সাধারণ জ্ঞান। একজন আরেকজনকে ধরি। যখনই পাঁচ মিনিট ইংরেজিতে কথা বলার জন্য রেডি, তখনই ইয়েস নো ভেরি গুড এ যেয়ে কথা শেষ হয়। ইংরেজী কথা আর এগোয় না। আমরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরি। আব্বা আম্মাও হাসেন। দেখেন তাদের ছেলেমেয়েদের কান্ড।

মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক আমার বাবা পড়তে বসার আগে বলেন, তোমরা আধাঘন্টা করে পড়বে তারপর ১০মিনিট ঘুরে বেড়াবে। আমরা প্রায়ই সময়ই ১০ মিনিট পড়ি, আধাঘণ্টা গল্প করি। আব্বা একটুও বকেন না। প্রশয়ের হাসি হাসেন। আম্মা মাঝে মাঝে একটু বকার চেষ্টা করেন। কিন্তু আব্বার ভালোবাসার তোড়ে তা ভেসে যায়। নিজেও এসে বসেন আড্ডা দিতে। বছর শেষে তার ছেলেমেয়েরা যে ফেল ছাড়াই রেজাল্ট দেয় এতেই যেন খুশি তারা।

আন্টিরা মাঝে মাঝেই আব্বাকে প্রশ্ন করেন, স্যার ওরা পড়ে কখন? সারাক্ষণ তো দেখি হৈ চৈ করে বেড়ায়। বাসায় তো অতিথি ভরা। রেজাল্ট তো কেউ খারাপ করে না। আব্বা স্নেহের হাসি হাসেন। ওরা মানুষের মধ্যেই বড় হোক।

আমরা আব্বার কাছে কখনো বড় হই না। তবে আব্বা আমাদের কাছে হিমালয়ের মতো বড় হয়ে ওঠেন। আব্বার জন্মদিনে আমরা অলিখিত প্রতিযোগিতা করি, কে সবার আগে তাকে উইশ করবে। ফোন ধরেই বলেন, মা তোমার একটু আগে মুক্তি ফোন করেছে। তার আগে মিলি, শিলু। তুমি আজ চতুর্থ। আমি তখন হড়বড় করে ব্যাখা দেই। আব্বা চুপ করে সব কথা শোনেন।

আজ বাবার জন্মদিন। তিনি কখনো বুড়ো হতে চাইতেন না। তাই তাঁর সব জন্মদিনই আমার কাছে, আমাদের কাছে নতুন। আমাদের কাছে তাঁর বয়স কখনো বাড়ে না। আমরা এখন খুব নীরবে অপেক্ষায় থাকি ১২ ডিসেম্বরের জন্য। আমাদের মন জুড়ে নীরবে থাকে বাবা আর শুধু বাবা।

ক’দিন আগে ছোট ভাইটার না থাকার ৪০দিনের মিলাদে যাই। বাসায় যেয়ে অবাক হয়ে দেখি আমাদের শান্ত বাসা! এ বাসা আমি চিনি না। কোনো শব্দ নেই, কোলাহল নেই। কে বলবে একসময় সপ্তবর্ণা নামের এ বাসায় চায়ের কাপ আর চামচের টুংটাং আওয়াজ বাজতো বাঁশির মতো, সারাক্ষণ গুনগুন করে টেপরেকর্ডারে বাজতো ভুপেন, হেমন্ত, মান্না, সতীনাথ, সাগর সেন, মিতা হক আর বন্যার গান।

শিউলী তলায় যেয়ে চুপ করে বসে থাকি। ১৬ ডিসেম্বর নতুন লাল সবুজ পতাকা বানানোর জন্য নেই ব্যস্ততা কারো। বাংলাদেশের জন্মদিনে যার হাত ধরে যেতাম শহীদ মিনারে সেই মানুষটাই যে আজ নেই। নেই ছোট ভাইটাও। ভালো লাগে না কিছুই। মন খারাপ বুঝেই হয়তো টুপ করে ঝরে পরে একটা শিউলী। তাকিয়ে থাকি। মনে মনে ভাবি ইস এমন যদি হতো, চাইলেই সেই ছোটবেলা আবার যদি ফিরে ফিরে আসতো। আবার আমি যদি হয়ে যেতাম বাবার আদরের ছোট মেয়ে। আহলাদে আটখানা হয়ে বাবাকে তখন কিনে দিতাম রুপালী একটা ঘড়ি। কিন্তু সময় যায়... বাবা এবং ভাই আর আসেনা!!

১২.১২.২০১৯

লেখক : সিনিয়র নিউজরুম এডিটর, একুশে টিভি