ঢাকা, শুক্রবার ২৬, এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৩১:৪৯ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

শহীদ সেলিনা পারভীন : নির্ভীক কলম সৈনিক

অনু সরকার

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৪:০৭ পিএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯ শুক্রবার

শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন

শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন

সবকটা জানালা খুলে দাও না/ওরা আসবে চুপি চুপি/যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ…। হ্যাঁ। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও আমরা অপেক্ষা করি তাদের জন্য যারা নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে আমাদের দিয়ে গেছেন একটি ভূ-খণ্ড, একটি মুক্ত দেশ। আমরা তাদের ভুলিনি, তাদের ভুলতে পারি না।

দেশকে ভালোবেসে প্রাণ দিয়েছেন সাংবাদিক সেলিনা পারভীন। শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীন ছিলেন স্বাধীনচেতা এক নারী। একজন নির্ভীক কলম সৈনিক। যিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সাংবাদিকতা করে গেছেন।

জন্ম : সেলিনা পারভীনের জন্ম ফেনীতে ১৯৩১ সালে। তার পিতা মো. আবিদুর রহমান শিক্ষকতা করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের ফেনীর বাড়ি দখল হয়ে যায়। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই তিনি সাহিত্যের অনুরাগী হয়ে গল্প ও কবিতা লেখা শুরু করেন।
 

কর্মজীবন : ১৯৪৫ সাল থেকে পুরোদমে তিনি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের হল পরিচালক হিসেবে চাকরি নেন। পরের বছর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতের অমিল হওয়ায় তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। পরবর্তীতে একজন রাজনীতিককে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন। তিনি ‘ললনা’ পত্রিকায় কাজ করতেন বিজ্ঞাপন বিভাগে। বিজ্ঞাপন সংগ্রহ, টাকা তোলাসহ সব কাজ একাই করতেন। পত্রিকা অফিস থেকে বেতন হিসেবে অনেক সময় তেমন কিছুই পেতেন না।


ললনায় কাজ করার সময় ১৯৬৯ সালে বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বের করেন শিলালিপি নামে একটি পত্রিকা। তিনি নিজেই এটি সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন। শিলালিপি ছিল সেলিনার নিজের সন্তানের মতো। দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত শিলালিপি সকলেরই নজর কেড়েছিল। স্বাধীনতার পক্ষের পত্রিকা শিলালিপি। এই সুবাদে ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলে অনেকের সাথেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন তিনি।


মুক্তিযুদ্ধে অবদান : ১৯৬৯-এর রাজনৈতিক আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ। নিজেও শরিক হন গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলন কর্মকাণ্ডে। ছেলেকে সঙ্গে নিয়েই বেরিয়ে পড়তেন ‘৬৯-এর ২১ ফেব্রুয়ারি পল্টনের জনসভায় বা শহীদ মিনার থেকে বের হওয়া নারীদের মিছিলে যোগ দিতে। শরিক হতেন বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদসভাতেও। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার প্রমুখদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে সমাজতন্ত্রের প্রতিও আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। এরই মধ্যে শুরু হয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেলিনা পারভীন ঢাকায় ছিলেন। তার বাসায় মাঝে-মাঝে রাত হলে কয়েকজন তরুণ আসতেন। এই তরুণদের সকলেই ছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা। খাওয়া-দাওয়া করে চলে যাওয়ার আগে এরা সেলিনা পারভীনের কাছ থেকে সংগৃহীত ঔষধ, কাপড় আর অর্থ নিয়ে যেতেন। শিলালিপির বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়েই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন।


চারদিকে তখন চলছে আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ, প্রতিরোধ। চারপাশে শুধু বুলেটের শব্দ আর বারুদের গন্ধ, চিৎকার, গোঙানি, রক্তস্রোত আর মৃত্যু। এরই মাঝে ললনা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। শিলালিপির ওপরও নেমে আসে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর খড়্গ। হাশেম খানের প্রচ্ছদ করা একটি শিলালিপির প্রকাশিতব্য সংখ্যা নিষিদ্ধ করে দেয় পাকিস্তান সরকার। পরে প্রকাশের অনুমতি মিললেও নতুনভাবে সাজানোর শর্ত দেওয়া হয়। সেলিনা পারভীন বরাবরের মতো প্রচ্ছদ না নিয়ে তার ভাইয়ের ছেলের ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ করে আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে শিলালিপির সর্বশেষ সংখ্যা বের করেন। কিন্তু এর আগের সংখ্যার জন্যই সেলিনা পারভীন পাকিস্তানী ও তাদের দালালদের নজরে পড়ে যান—যেটাতে ছিল দেশবরেণ্য বুদ্ধীজীবীদের লেখা এবং স্বাধীনতার পক্ষের লেখা। তাই কাল হলো। শিলালিপির আরেকটি সংখ্যা বের করার আগে নিজেই হারিয়ে গেলেন।


মৃত্যু : ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। দেশ স্বাধীন হতে আর মাত্র তিন দিন বাকি। সাংবাদিক সেলিনা পারভীন তখন বাস করতেন সিদ্ধেশ্বরীতে। ১১৫ নম্বর নিউ সার্কুলার রোডে তার বাড়িতে থাকতেন তিনজন মানুষ। তার মা, পুত্র সুমন আর ভাই উজিরউদ্দিন। সেদিন শীতের সকালে তারা সবাই ছিলেন ছাদে। সেলিনা পারভীন সুমনের গায়ে তেল মাখিয়ে দিচ্ছিলেন। সুমন যখন ছাদে খেলাধুলা করছিল তখন সেলিনা পারভীন ছাদে চেয়ার টেনে একটি লেখা লিখছিলেন। শহরে তখন কারফিউ। রাস্তায় মিলিটারি। পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য বিমান থেকে চিঠি ফেলা হচ্ছে। হঠাৎ দূরে একটা গাড়ির আওয়াজ হলো। সেলিনাদের বাড়ির উল্টো দিকে খান আতার বাসার সামনে ফিয়াট মাইক্রোবাস ও লরি থামল। সেই বাসার প্রধান গেইট ভেঙে ভিতরে ঢুকে গেল কিছু আল-বদর কর্মী। তাদের সবাই একই রঙের পোশাক পরা ও মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা। এক সময় সেলিনাদের ফ্ল্যাটে এসেও কড়া নাড়ে তারা। সেলিনা পারভীন নিজে দরজা খুলে দেন। লোকগুলো তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয় এবং এ সময় সেলিনা পারভীনের সঙ্গে লোকগুলোর বেশ কিছু কথা হয়। এরপর তারা সেলিনা পারভীনকে ধরে নিয়ে যায়।


মোহাম্মাদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে প্রায় ৩০ জনকে মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত একটি ঘরে বন্দি করে রেখেছিলেন ঘাতকরা। বন্দিদের মধ্যে ছিলেন— শিক্ষক মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীসহ আরও অনেকে। সেখানে একমাত্র নারী বন্দি হিসেবে ছিলেন সেলিনা পারভীন।


১৪ ডিসেম্বর গভীর রাতে সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রায়েরবাজারের বটতলায়। লম্বা রশি দিয়ে ৩০-৪০ জনকে সোজা লাইনে দাঁড় করিয়ে হাত বাঁধা হয়। পরিণতি বুঝতে পেরে সেলিনা পারভীন চিৎকার শুরু করেন। অনুরোধ করে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন। তার চিৎকারে ঘাতকদের অসুবিধা হচ্ছিল। তাদের পরিকল্পনা মতো বন্দিদের হত্যা করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই ঘাতকরা তখন তার মুখে বেয়ানেট চার্জ করে মুখ ফেড়ে দেয়। তিনি মাটিতে পড়ে যান আর ব্যথার আর্তনাদ ও গোঙানোর শব্দ শোনা যায়। ঘাতকরা তখন তার বুকেও বেয়ানট চার্জ করে। পরে তাকে গুলি করা হয়।

১৮ ডিসেম্বর সেলিনার গুলি-বেয়নেটে ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া গেলো রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। ডিসেম্বরের হীম শীতের কারণে সেলিনা পায়ে মোজা পড়া ছিলেন। মৃতদেহ যখন পাওয়া যায় তখনও তার পায়ে ছিলো সাদা মোজা। এটি দেখেই তাকে সনাক্ত করা হয়। ১৪ ডিসেম্বর আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো পাকিস্তানের দালাল আলবদর বাহিনীর ঘৃণিত নরপশুরা সেখানেই সেলিনা পারভীনকে হত্যা করে। পরে ১৮ ডিসেম্বর আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।

নির্ভিক সাংবাদিক সেলিনা পারভীন শুয়ে আছেন আজিমপুর কবরস্থানে। তিনি ঘুমাননি। পাহারা দিচ্ছেন দেশকে। তিনি জেগে আছেন। তিনি ঘুমান না। কারণ শহীদরা জেগে থাকে, শহীদরা ঘুমায় না।