ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১৮, এপ্রিল ২০২৪ ৬:০৯:০৯ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

হারিয়ে ফেলেছি সোনালী শৈশব: মাহাসরূপা টুবন

মাহাসরূপা টুবন

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১২:২২ পিএম, ২৮ জানুয়ারি ২০২০ মঙ্গলবার

হারিয়ে ফেলেছি সোনালী শৈশব: মাহাসরূপা টুবন

হারিয়ে ফেলেছি সোনালী শৈশব: মাহাসরূপা টুবন

কতদিন হিজল ফুলের মালা ছুঁয়ে দেখি না। ছোটবেলায় যখন গ্রামের বাড়ির পুকুরপাড়ের নেতানো হিজল গাছটায় বসে টলটলে পানিতে পা ডুবিয়ে থাকতাম। আহ, তখন আমার পুরো পৃথিবীটা জুড়ে কি শান্তি আর শান্তি খেলা করতো।

হিজল ফুলের তুলতুলে মালা যখন আমার ছোট্ট তুলতুলে গলায় সুড়সুড়ি দিতো তখন কেমন মায়াবী মিষ্টি একটা গন্ধ আমাকে মাতাল করে তুলতো।

আর সেই, সোনাবাড়ির তিতিজাম গাছটা? যেই গাছের মগডালে বসে প্রায়ই তিতিজাম খেতাম।

ছোট্টবেলায় খুব দস্যি ছিলাম আমি। পারতপক্ষে ছোটরা ভূতের ভয়ে দিনের বেলা সোনাবাড়ির নাম মুখে নিতো না,
আর আমি সেখানে দিব্যি ভর দুপুরে ওই জাম গাছটায় উঠে বসে থাকতাম।

একবার বাবাকে নিয়ে পুরো গ্রামে চিন্তার ঝড় উঠেছিল। বাবাটা আমার বোহেমিয়ান ছিল চিরটা কাল। প্রায়ই দূরদেশের টানে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেতেন কখনো পাকিস্তান কখনো বা কলকাতা কিংবা থাইল্যান্ড।

একবার সাতদিনের জন্য কলকাতা গিয়ে বাবা যখন এক মাস পরেও ফিরে এলেন না তখন সবাই ধরেই নিয়েছিলেন বাবা আর ফিরবেন না।

অথচ ঠিক একদিন আমিই প্রথম দেখলাম বাবা ফিরে আসছেন। ওই মূহূর্তের অনুভূতিটা আজো আমি ভুলিনি। কিছুটা সময়ের জন্য খুশিতে কেমন বোধহীন হয়ে গিয়েছিলাম আমি। ছোট্ট এই আমাকে এক ঝটকায় তুলে ধরে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন বাবা। আমি প্রাণভরে শ্বাস নিয়েছিলাম শূন্যের ওপর ভেসে।

মায়ের মুখে শোনা, আমার সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবার বীরত্বের কাহিনী, বাংলাদেশ জন্মের আগে বাবা পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ছিলেন। কিন্ত মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পূর্ব বাংলায় চলে আসেন বিবেকের তাড়নায়, মিথ্যা অযুহাতে ছুটি নিয়ে দেশকে স্বাধীন করার তাগিদে। পূর্ব বাংলায় ফিরে নিজ গ্রাম গোড়ানের প্রতিটি যুবককে ট্রেনিং করিয়েছেন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে। তারপর ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল গ্রাম বাংলার প্রথম যুদ্ধ গোড়ান-সাটিয়াচড়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে আহত হন তিনি। পরে মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাকবাহিনীর তল্লাশি অভিযানের সময় দ্রুত তাকে সরিয়ে নেন গোড়ান গ্রামের একজন নতুন আত্মীয় (নাম জানা নেই)। পরে বাবাকে তার বোনের শশুড়বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হয়। ওখানেই আমার মায়ের সাথে বাবার দেখা হয় এবং বাবা মোটামুটি সুস্থ হলে দুই পরিবারের সম্মতিতে বাবা মায়ের বিয়ে সম্পন্ন হয়। এর কিছুদিন পরই স্থানীয় করিম রাজাকার বাবাকে ধরিয়ে দেয় পাক হানাদারদের হাতে। টাঙ্গাইলের ডিস্ট্রিক এলাকার শামছুল হক তরুণ গেটের কাছে পাক বাহিনীর ক্যাম্পে বন্ধী থাকেন কয়েক মাস। টর্চারে টর্চারে ক্ষতবিক্ষত বাবা আমার দুইবার ফায়ার স্কোয়ার্ডে গিয়েও বেঁচে গেছেন আল্লাহর অশেষ রহমতে। অবশেষে স্থানীয় জয়নাল মামা যিনি অন্তরে মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু বাইরে রাজাকার সেজে পাকিস্তানিদের সাথে থাকতেন। আর রাতের বেলা পাক হানাদারদের অভিযানের আগেই স্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সতর্ক করে দিতেন বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার জন্য। ক্যাম্প থেকে তিনিই উদ্ধার করেন আমার বাবাকে। সাহসী বাবা আমার নিজ প্রাণের ঝুঁকির পরও বন্ধি অন্য এক কিশোরকেও বাঁচিয়ে আনেন ওই ক্যাম্প থেকে।

অথচ কি ভয়ঙ্কর আত্মপ্রত্যয়ী আমার বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন কখনো কোনো সরকারের কাছেই যাননি নিজের কৃতিত্ব জাহির করতে, যাননি মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিতে। মাঝেমধ্যে মা কখনো এ বিষয়ে কিছু বললে বলতেন,‘যুদ্ধ করেছি দেশের জন্য, নিজের স্বার্থের জন্য নয়’।

আমার বাবার ডাক নাম ছিল বড় বাবু। এলাকার মানুষ এই নামেই বেশি চিনতেন তাকে। আর অফিসিয়াল নাম ছিল গাজী মো. মোশারফ হোসেন। সত্যিই বাবুর মতোই কাটিয়ে গিয়েছেন তার জীবন। বাপ-দাদার শত শত বিঘা জমি বিক্রি করে নিজে বাবুর মতো চলেছেন মানুষকেও সাহায্য করেছেন। কখনো দেশের জন্য নিজের কৃতিত্ব জাহির করে কোনো সুবিধা পেতে চাননি।

অথচ বাবার এই উদার মানসিকতার মাসুল গুনতে হয়েছে আমার মাকে। তাইতো আমাদের জীবনের সোনালী স্বপ্নের দৌড়গোড়ায় পৌঁছে দিতে শক্ত হাতে হাল ধরেছিলেন আমাদের অপরাজেয় মা। আর তাইতো সেই ছোট্টবেলার হিজলের মিষ্টি গন্ধের সুধা অবগাহনের আগেই আমাদের গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল মায়ের নতুন চাকরিতে জয়েন করার কারণে। আর সেই সাথে আমিও হারিয়ে ফেললাম আমার ছোট্টবেলার টলটলে পুকুরপাড়, নেতানো হিজল গাছ এবং বেগুনি রঙের গুটিগুটি তিতিজামের নীলাভ জিহবার টকমিষ্টি স্বাদ।

জীবন এবং সময় বড় বেশি স্বার্থপর যার কাছে হারিয়ে যায় সোনালী শৈশব। যা আজো বোবা কান্না হয়ে বুকের ভেতর গুমড়ে মরে হারিয়ে যাওয়ার নীল কষ্টে।

মাহাসরূপা টুবন: লেখক ও সাংবাদিক।