ঢাকা, মঙ্গলবার ১৬, এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৪৪:০৬ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

চীনের চিঠি-পূর্ণিমা ও অন্যান্য গল্প : আইরীন নিয়াজী মান্না

আইরীন নিয়াজী মান্না

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১২:৩১ এএম, ৬ মার্চ ২০২০ শুক্রবার

আইরীন নিয়াজী মান্না ও পূর্ণিমা ভিরাসেকারা (শ্রীলঙ্কা)

আইরীন নিয়াজী মান্না ও পূর্ণিমা ভিরাসেকারা (শ্রীলঙ্কা)

সম্পর্ক আসলে কি! সম্পর্ককে আমরা কিভাবে বিশ্লেষণ করি। সম্পর্ককে কি কোনো সংজ্ঞায় ফেলা যায়। একটা গল্প বলি, একটু অতীতের দিকে যাই। অতীত হয়ে উঠুক বর্তমান।

চাকরি সূত্রে চীন এসেছি প্রায় দু’বছর। কাজ করছি বিদেশীদের সাথে। এখানে আমাদের একটি নিজস্ব সমাজ গড়ে উঠেছে। আমরা পৃথিবীর প্রায় চৌষট্টিটি দেশের নাগরিক একটি ক্যাম্পাসে বসবাস করছি। এ ক্যাম্পাসের একপ্রান্তে আমাদের অফিস অপরপ্রান্তে বাসা।  বাংলাদেশের মেয়ে আমি একা।

আমরা দেশে রেখে এসেছি পরিবার-পরিজন। এখানেও যেন সকলে মিলে আমরা একটি পরিবার।  সম্পর্কের বন্ধনগুলো বেশ পরিণত। আমরা একজন অন্যজনের জন্য অনুভব করি। বিপদে-আপদে- প্রয়োজনে ছুটে যাই একজন অন্যজনের কাছে। ছুটির দিনগুলো এক সাথে কাটাতে চেষ্টা করি। এক সাথে বাইরে খেতে যাই; বেড়াতে যাই। একাকিত্বের বেদনা কাটাতে চেষ্টা করি এভাবে।

আমার অফিসের পরিবেশটা খুবই চমৎকার। আমি ভাগ্যবান চীনা সহকর্মীরা আমাকে অসম্ভব পছন্দ করে; শুধু পছন্দই নয় ওরা আমাকে ভালোবাসে। আর আমার বিভাগীয় প্রধানের (পরিচালক) প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তিনি আমাকে অকৃত্রিম স্নেহ দিয়েছেন। এসব কারণেই হয়তো দেশ ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে।  তা না হলে হয়তো পারতাম না।  কারণ আমি খুব হোমসিক মানুষ। মা-বাবা-ভাই-বোনদের ছেড়ে থাকতে পারি না।

বেইজিং আসার ঠিক দু মাস চার দিন পর আমার মা মারা যান। সে কি দূর্বিসহ যন্ত্রণা! বিদেশ-বিভূইয়ে বসে মায়ের মৃত্যু খবর শোনা, সে যে কি যন্ত্রনার তা শুধু সেই বোঝে যার জীবনে এমন করুণ ঘটনা ঘটেছে। আমি আমার মায়ের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান। যে মাকে ছেড়ে জীবনে একটি রাতও বাইরে থাকিনি সে মায়ের পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার খবর এলো ‘স্কাইপ’-এ ভেসে। ১৭ মার্চ ২০১৫! শোকে আমি যেন পাথর হয়ে গেলাম। মনে হলো এই কি তবে কেয়ামত!

বেইজিংয়ে আমি সম্পূর্ণ একা। দেশে এখন কি করছে আমার ভাই-বোনরা! বাবাকে হারিয়েছি সেই শৈশবে। মাকে ঘিরেই আমাদের সব স্বপ্ন, সব আহলাদ। এ কি হলো! আমি দিশেহারা। এখনই আমাকে দেশে ফিরতে হবে! কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে বিমানের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। আমার পরিচালক এবং সহকর্মীরা অনেক চেষ্টা করছেন। ১৮ তারিখ ভোরের টিকিট নেই। আমাকে যেতে হবে ১৯ মার্চ। বিকেলে পৌঁছাবো ঢাকায়। মার প্রিয় ওই চেহারাটা শেষবারের মত একবার দেখতে চাই আমি।  অপেক্ষার প্রহর যেন আর শেষ হয় না।  একেকটি মিনিট যেন এক একটি বছরের চেয়ে দীর্ঘ।

মায়ের খবর শোনার পর আমার বিভাগের প্রধান ইউ ম্যাডাম খুব ভোরে আমার বাসায় চলে এসেছেন। চলে এসেছেন আমার সহকর্মীরা। আসছেন অন্যান্য দেশের পরিচিত, বন্ধু, প্রতিবেশিরা সকলে।

অনেক রাতে, রাত প্রায় এগারটার পর এলো শ্রীলঙ্কার মেয়ে পূর্ণিমা ভিরাসেকারা। সে আমার নিকটতম প্রতিবেশি। এর আগে তার সাথে আমার মাত্র দুয়েকবার দেখা হয়েছে। তাঞ্জানিয়ার মেয়ে ক্যারল ডি কষ্টার বাসায় তার সাথে প্রথম দেখা হয়। তখন আমরা অনেকটা সময় ধরে আড্ডা দিয়েছিলাম। তারপর হয়তো একদিন লিফ্টে দেখা হয়েছিলো।

পূর্ণিমা রাজধানী কলম্বোর মেয়ে। শ্রীলঙ্কান হলেও ইংরেজিতে দক্ষতার কারণে সিআরআইয়ের ইংরেজি বিভাগে চাকরি করছে গত দু বছর।  বেশ মেধাবী মেয়ে।  চটপটে।

অফিস শেষে পূর্ণিমা এলো বেশ রাতে। আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়ে সে দৃঢ়ভাবে পাশে দাড়ালো আমার। মৃদু ভাষায় অনেক কথা বলে আমাকে শান্তনা দিলো। আমি তো তখন বিপন্ন, দিশেহারা। অবসন্ন দেহে শুয়ে আছি বিছানায়। রাত বাড়ছে। শুধু ভাবছি আপনজনদের কথা। কি করছে তারা। ছোট ভাইটার অসহায় চেহারা ভেসে উঠছে হৃদয়ের গভীরে বার বার।

রাত বাড়ছে। যারা আমাকে শান্তনা দিতে এসেছিলো তারা চলে যাচ্ছে একে একে। শুধু আমার পাশে বসে আছে পূর্ণিমা। রাত গভীর হচ্ছে; কাল অফিস আছে আবার। হয়তো সেও চলে যাবে কিছু পর। কিন্তু ও গেলো না। আমাকে একা রেখে সে যেতে চাইলো না। ফ্লোরে কিছু একটা বিছিয়ে সে শুতে চাইলো। চরম মানসিক অবস্থায়ও আমি প্রচন্ড অবাক হলাম একজন বিদেশির মহানুভবতা দেখে।

ওর কথা শুনে আমার মনটা খাঁ খাঁ করে উঠলো। ক্লান্তকণ্ঠে আমি বললাম : তুমি আমার পাশে খাটে এসো শোও প্লিজ। মাটিতে নয়।

সাদা বিছানায় আমি শুয়ে আছি বিষন্নভাবে। ও ঠিক বসে রইলো আমার মাথার পাশে। শান্তকণ্ঠে আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করলো। সারাটা রাত সে জেগে থাকলো আমার সাথে। একটুও ঘুমালো না। শেষ রাতে আমাকে বিমানবন্দরে যেতে হবে। সকাল সাড়ে ৮টায় ফ্লাইট। অফিসের গাড়ি আসবে ভোর পাঁচটায়। আসবে একজন সহকর্মীও। পূর্ণিমা আমার সব কিছু গুছগাছ করে দিয়ে আমাকে এয়ারপোর্টের পথে এগিয়ে দিয়ে তারপর ফিরে গেলো নিজ ঘরে।

কে সে! এই মাত্র ক’দিন আগেও তো আমরা কেউ কাউকে চিনতাম না! এই বিপদে আপনজনের মত সে এসে দাঁড়িয়েছে আমার পাশে! কি সম্পর্ক তার সাথে আমার! এ সম্পর্ক আসলে মানবিকতার; হৃদয়ের উষ্ণতার, মানসিক ও মানবিক মূল্যবোধের। হৃদয়ের সম্পর্ক কোনো সীমানা মানে না। কাঁটাতারের বেড়া মানে না। সম্পর্ক সৃষ্টি হতে কোনো পাসপোর্ট, ভিসা লাগে না। নির্দিষ্ট ভাষা লাগে না। মন-হৃদয় সে তো সর্বজনিন।

এখন হাজার ব্যস্ততার ফাঁকেও আমাদের অনেক গল্প হয়। হয় আড্ডা। কখনো কখনো সে আড্ডায় অংশ নেয় অন্য বন্ধুরাও। সময়ের প্রবাহে সম্পর্ক যেন আরো দৃঢ় হয়। বাড়ে টান। ঠিক তখনই মনে হয়, আমরা বিদেশী; চাকরির চুক্তি শেষ হলে আমাদের পথ আলাদা হয়ে যাবে। কেউ আগে যাবো, কেউ পরে। কিন্তু চলে যাবো বলেই কি সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে! নাহ্; দূরত্ব কোনো সম্পর্ক শেষ করতে পারে না। ভালোবাসা থাকলে সম্পর্ক শেষ হয় না। বিশ্বাস সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যায়। সে যেই হোক; ভাই-বোন, বন্ধু কিংবা প্রণয়।

স্নেহ-ভালোবাসা কোনো সীমা মানে না, ভাষা মানে না। পুরো বিশ্ব যে আসলে একটি পরিবার। মুখের ভাষা আলাদা হতে পারে, সংস্কৃতি আলাদা হতে পারে, কিন্তু মনের ভাষা সকলের এক; হৃদয় এক।

আর তাই তো দূর দেশে ভাই-বোন আপনাজনদের রেখে এসে এখানে আমরা বাঁচতে চাই একে অন্যকে আক্রে ধরে। পরিবারের গন্ধ আবিস্কারের চেষ্টা করি বিদেশী চেহারাগুলোতে। কখনো কখনো বড় আপন হয়ে ধরা দেয় সেই চেহারা। আর ঠিক তখনই হারানোর বেদনায় কেঁপে ওঠে প্রাণ।

জানি নির্দিষ্ট সময় বিচ্ছেদের পর পরিবারের সদস্যদের সাথে আবারো দেখা হবে। কিন্তু পরবাসে যে সম্পর্কগুলো গড়ে উঠেছে আপনজনদের ফেলে আসার তৃষ্ণা থেকে; তাদের সাথে কি আবার দেখা হবে! হয় তো হবে; হয় তো হবে না। তবে এই ‘না’র পাল্লাটাই বেশি ভারি। আর এ কথা যখন মনে দোলা দেয় তখনই নতুন এক বেদনার জন্ম হয় হৃদয়ে। দু’চোখ ভোরে ওঠে জলে।

আর তাই তো নিজেকে বার বার প্রশ্ন করি পূর্ণিমা কে! তার সাথে আমার সম্পর্ক কি! ঠিক তখনই মেলে উত্তর, সে আমার আত্নার আত্নিয়।

লেখক : সম্পাদক-উইমেননিউজ২৪.কম। সাবেক ফরেন এক্সপার্ট, চীন আন্তর্জাতিক বেতার, বেইজিং।