ঢাকা, শুক্রবার ২৯, মার্চ ২০২৪ ৪:২১:১৫ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

করোনা: পৃথিবী বদলে দেওয়া পাঁচ ঘটনা ও কালো রাজহাঁস তত্ত্ব

বিবিসি বাংলা অনলাইন

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৩:৪২ পিএম, ৫ মে ২০২০ মঙ্গলবার

করোনা: পৃথিবী বদলে দেওয়া পাঁচ ঘটনা ও কালো রাজহাঁস তত্ত্ব

করোনা: পৃথিবী বদলে দেওয়া পাঁচ ঘটনা ও কালো রাজহাঁস তত্ত্ব

১৯৯১ সালের ১৮ আগস্ট। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখনো বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র, ইউরোপ আর এশিয়ার ১১টি টাইম জোন জুড়ে বিস্তৃত তাদের সাম্রাজ্য। চার মাস পর বিশ্বে এই রাষ্ট্রটির কোন নিশানা থাকবে না, এটি যদি সেদিন কেউ বলার চেষ্টা করতেন, সেটি কেউ বিশ্বাস করতেন না।

কিংবা ফিরে যাওয়া যাক ২০০১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। পরদিন যাত্রীবাহী জেট বিমান দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হবে নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ার, হামলা চলবে পেন্টাগনে, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোকে কয়েক দশকজুড়ে এক বিরাট যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে- এমন একটা ভবিষ্যৎ সবচেয়ে তুখোড় নিরাপত্তা বা গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞের পক্ষেও অনুমান করা ছিল কঠিন।

তিউনিসিয়ার সিদি বুজিদ শহর ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর যা ঘটেছিল সেটার কথাও বলা যেতে পারে। শহরের গভর্নরের অফিসের সামনে রাস্তায় প্রকাশ্যে নিজের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়েছিল পুলিশি হেনস্তার শিকার এক তরুণ ফল বিক্রেতা। সেই আগুনে মোহাম্মদ বোয়াজিজির নিজের প্রাণই কেবল যায়নি, এর জের ধরে শুরু হওয়া আরব বসন্তে ওলট-পালট ঘটে গেছে আরব বিশ্বে। কিন্তু ২০১০ সালের সেই দিনটিতে কারও পক্ষেই অনুমান করা সম্ভব ছিল না যে পরের দশ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে কী ঘটবে।

গত তিরিশ বছরে এরকম বড় ঘটনা আরও আছে। যেমন ২০০৮ সালের আর্থিক সংকট। যার জের ধরে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার সূচনা হয়েছিল।

এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন করোনাভাইরাস মহামারি। যা এখন ওলট-পালট ঘটিয়ে দিচ্ছে সারা পৃথিবীতে।

এধরণের ঘটনাগুলোকে এখন বর্ণনা করা হয় ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ বা কালো রাজহাঁস বলে। কিন্তু দুনিয়া তোলপাড় করা এসব ঘটনার সঙ্গে কালো রাজহাঁসের সম্পর্কটা কোথায়?

ব্ল্যাক সোয়ান বা কালো রাজহাঁস তত্ত্ব: নাসিম নিকোলাস তালেব হচ্ছেন ‘ব্ল্যাক সোয়ান‌‌’ তত্ত্বের জনক। তিনি বহু বছর কাজ করেছেন পুঁজিবাজারে। কিন্তু পরে তিনি পেশা পরিবর্তন করে চলে আসেন একাডেমিক জগতে। ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয় তার বই “দ্য ব্ল্যাক সোয়ান‌।”

বইটি প্রকাশিত হওয়ার পরের বছরই বিশ্বের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিরাট ধস নামে। তখন থেকেই আলোচিত তার এই তত্ত্ব।

নাসিম নিকোলাস তালেব তার বইতে ব্যাখ্যা করেছেন কেন তিনি এরকম ঘটনা বর্ণনার জন্য ব্ল্যাক সোয়ানের উপমা টেনেছেন।

অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত মানুষের ধারণা ছিল রাজহাঁস মানেই হচ্ছে সাদা রাজহাঁস। কারণ বিশ্বের কোথাও এর আগে কালো রাজহাঁস কেউ দেখেনি। কাজেই মানুষ তার পর্যবেক্ষণ এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই জানে যে কালো রাজহাঁস বলে কিছু নেই।

কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় যখন প্রথম কালো রাজহাঁসের দেখা মিললো, সেটা ছিল পক্ষী-বিজ্ঞানীদের জন্য এক বিরাট ধাক্কা।

আমাদের পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের যে একটা সীমাবদ্ধতা আছে এবং এই জ্ঞান যে খুবই ভঙ্গুর, এই উদাহরণের মাধ্যমে সেটি নাসিম নিকোলাস তালেব তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। হাজার বছর ধরে মানুষের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান এক লহমায় মিথ্যে হয়ে গেছে যখন সত্যি সত্যি প্রথম কালো রাজহাঁসের দেখা মিলেছে। ব্ল্যাক সোয়ান মানে হচ্ছে যা আমরা জানি না কিংবা যা আমাদের জানার অভিজ্ঞতার বাইরে ছিল, কিন্তু যা আসলে আছে বা ঘটতে পারে।

মূলতঃ এই উদাহরণ থেকেই এসেছে ‘ব্ল্যাক সোয়ান ইভেন্টের’ তত্ত্ব। খুব সহজ করে বলতে গেলে, সেসব ঘটনাকেই ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ বলে বর্ণনা করা হয়-

• যেগুলো ঘটে খুবই আচমকা, কোন পূর্বাভাস ছাড়া। একেবারেই আন-প্রেডিক্টেবল।

• এসব ঘটনার ব্যাপ্তি এবং ভয়াবহতা গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়।

• বিশ্ব ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বদলের সূচনা করে এবং এসব ঘটনার প্রভাব হয় সুদূরপ্রসারী।

নাসিম নিকোলাস তালেবের মতে, ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর বিশেষজ্ঞরা এমন ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন, যেন এরকম ঘটাটাই অবশ্যম্ভাবী ছিল। কিন্তু তাদের এই জ্ঞান আসলে ঘটনা পরবর্তী উপলব্ধি থেকে পাওয়া, ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে অর্জন করা। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ইন হাইন্ডসাইট।’

গত তিরিশ বছরে সবচেয়ে বড় পাঁচটি ব্ল্যাক সোয়ান ইভেন্টের ক্ষেত্রেই এসব বৈশিষ্ট্য একেবারেই স্পষ্ট। এসব ঘটনা যখন ঘটেছে, তার আগে পর্যন্ত কেউ কল্পনা করতে পারেনি এরকম নাটকীয় ঘটনা ঘটতে পারে, কাজেই এরকম ঘটনার পূর্বাভাস যেমন ছিল না, তেমনি ছিল ঘটনা মোকাবেলার প্রস্তুতি।

সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গন : ১৯৯১ সালের ১৯ আগস্ট। সকাল সাতটা বেজে তিন মিনিটে মস্কোর মার্কিন দূতাবাসে সেদিন একটি জরুরি ফোন কল এলো। রাষ্ট্রদূত জেমস এফ কলিন্সের কাছে ফোন করেছেন পলিটিক্যাল অফিসার এড সালাজার।

তিনি রাষ্ট্রদূতের কাছে জানতে চাইলেন, আপনি কি রেডিওতে খবর শুনেছেন? রেডিওর সেই খবরে বলা হচ্ছিল মিখাইল গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন, গেন্নাদি ইয়ানায়েভ নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। গর্বাচেভকে ক্রাইমিয়ার এক বাগানবাড়িতে কার্যত নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

এটি ছিল আসলে সোভিয়েত ইউনিয়নে মিখাইল গর্বাচেভকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য একটি অভ্যুত্থানের চেষ্টা। গর্বাচেভ তার সংস্কার কর্মসূচীর কারণে কমিউনিস্ট পার্টির কট্টরপন্থীদের দিক থেকে যে চাপের মুখে আছেন, সেটা জানা ছিল মার্কিনীদের। কিন্তু এই ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার জের ধরে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে মাত্র কয়েকমাসের মধ্যে ভেঙ্গে খন্ড-বিখন্ড হয়ে যাবে, এটি তাদের কল্পনারও বাইরে ছিল।

রাষ্ট্রদূত জেমস কলিন্স পরবর্তীকালে বলেছেন, ১৯ অগাস্ট থেকে পরবর্তী তিন দিনে যা ঘটেছিল, তা এতটাই নাটকীয় এবং অভাবনীয় ছিল যে, তা পুরো সোভিয়েত রাষ্ট্র ব্যবস্থার চেহারা বদলে দিয়েছিল। কারণ ঐ তিন দিনেই কমিউনিস্ট পার্টি সোভিয়েত রাষ্ট্র ব্যবস্থার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল। মিখাইল গর্বাচেভ যখন মস্কো ফিরে এসেছিলেন, তখন তিনি আর কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নন, কিন্তু তখনো তিনিই সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট।

এর পরের ইতিহাস আরও নাটকীয়। রাশিয়ার এই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে সবচেয়ে ক্ষমতাবান রাজনীতিক হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিলেন বরিস ইয়েল‌ৎসিন। ডিসেম্বরেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল সোভিয়েত সাম্রাজ্যের ভাগ্য। বেলারুশের এক খামারবাড়ীতে বসে সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোর নেতারা এক নৈশভোজে বসে চূড়ান্ত করে ফেলেছিলেন কিভাবে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করা হবে দেশটি। ২৫ ডিসেম্বর শেষবারের মতো ক্রেমলিনের উপরে তোলা হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতাকা, আর ২৬ ডিসেম্বর বিশ্ব মানচিত্র থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল দেশটি।

রাষ্ট্রদূত জেমস কলিন্সের ভাষায়, “সত্যি কথা বলতে সেই অগাস্টে সোভিয়েত ইউনিয়নে যা ঘটেছিল, তা মার্কিন সরকারের কেউ ধারণাই করতে পারেনি।”

সিআইএ‌’র মতো এত ক্ষমতাশালী একটি গুপ্তচর সংস্থা থাকার পরও যুক্তরাষ্ট্র বা বাকী বিশ্ব কেন টের পেল না সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেতর থেকেই এভাবে ধসে যাবে এবং কেন সেজন্যে প্রস্তুতি নিতে পারলো না সে প্রশ্ন পরে উঠেছিল। এর সদুত্তর পাওয়া যায়নি।

দুই পরাশক্তির একটি যখন তাসের ঘরের মতো ধসে পড়লো, তখন অপর পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এতটাই অপ্রস্তত হয়ে পড়েছিল যে মারাত্মক উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল বিশ্বে শক্তির ভারসাম্য, নিরাপত্তা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে থাকা বিপুল পরমাণু অস্ত্র-সম্ভারের নিরাপত্তা নিয়ে। অথচ এই সোভিয়েত কমিউনিস্ট ব্যবস্থাকে ধ্বংসের জন্যই যুক্তরাষ্ট্র সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল দশকের পর দশক ধরে।

বার্লিন প্রাচীর ধ্বংস, পূর্ব ইউরোপের দেশে দেশ কমিউনিজমের পতনের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন সময়ের ব্যাপার ছিল, এমন কথা বলার চেষ্টা করেন কেউ কেউ। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে যেরকম দ্রুত ও নাটকীয়ভাবে ভেতর থেকেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, সেটা কারো দূরবর্তী কল্পনাতেও আসলে ছিল না।

এটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে নাটকীয় ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ ইভেন্ট। পুরো পৃথিবীর ভূরাজনৈতিক মানচিত্র শুধু নয়, অনেক কিছুই পাল্টে দিয়েছিল এই ঘটনা।

নাইন ইলেভেন: সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই : যদি সাম্প্রতিক বিশ্ব ইতিহাসে আগের যুগের সঙ্গে পরবর্তী যুগের একটি পরিস্কার ছেদ ঘটিয়ে দিয়েছে এমন একটি মূহুর্তের কথা বলতে হয়, তবে সেই মূহুর্তটি হচ্ছে - সকাল ৮টা: ৪৬মিনিট: ৪০সেকেন্ড, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১।

দিনটি ছিল মঙ্গলবার। নিউইয়র্কের আকাশ ছিল নীল, রোদে ঝলমল। আমেরিকান এয়ারলাইন্সের বোয়িং সেভেন-সিক্স-সেভেন ঠিক ঐ মূহুর্তটিতে সোজা এসে আঘাত করেছিল ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের নর্থ টাওয়ারে।

১১০ তলা ভবনটির ৮০তম তলার কাছে এক বিরাট গর্ত তৈরি করে এটি ঢুকে পড়লো ভেতরে, ২০ হাজার গ্যালনের জেট ফুয়েলসহ বিস্ফোরিত হলো।

সেই একটি মূহুর্তেই নির্ধারিত হয়ে গেল বিশ্বের পরবর্তী কয়েক দশকের অনেক কিছুর গতিপথ।

ওসামা বিন লাদেন এই ঘটনার আগেই আমেরিকার ‘মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টে, কিন্তু পৃথিবীর কজন লোক ওসামা বিন-লাদেন কিংবা আল কায়েদার নাম জানতেন?

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মোট চারটি যাত্রীবাহী জেট একযোগে ছিনতাই করে যে হামলা আল কায়েদা চালিয়েছিল, তা ছিল অকল্পনীয়।

দুটি বিমান সরাসরি গিয়ে আঘাত হানে নিউ ইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের দুটি টাওয়ারে। একটি ওয়াশিংটন ডিসির কাছে পেন্টাগনে। আরেকটি টার্গেটে আঘাত হানার আগেই বিধ্বস্ত হয় এক খোলা মাঠে। সেদিনে হামলায় নিহত হয় প্রায় তিন হাজার মানুষ।

এই হামলার পরিকল্পনা, যেভাবে একযোগে এটি বাস্তবায়ন করা হয় এবং এটির যে প্রভাব - তার তুলনীয় কিছু সন্ত্রাসবাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসে নেই।

আল কায়েদা এর আগেও নানা জায়গায় সন্ত্রাসবাদী হামলা চালিয়েছে। এরকম চরমপন্থী ধর্মীয় মতাদর্শভিত্তিক সন্ত্রাসবাদ যে আমেরিকার জন্য নয়া হুমকি হয়ে উঠছে, সেটিও নতুন কথা নয়।

কিন্তু নাইন-ইলেভেনের যে হামলা- তা ছিল অনেক দিক থেকেই অভিনব- এর নাটকীয় মাত্রা, এর দুঃসাহসিকতা, যা কেবল আমেরিকাকে শুধু নয়, বদলে দিয়েছে পুরো বিশ্বকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্য যেখানে ছিল কমিউনিজম ঠেকানো, তেমনি নাইন-ইলেভেন পরবর্তী বিশ্বে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে ইসলামী জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে বুশ প্রশাসন। আফগানিস্তানে তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াই দিয়ে শুরু হয়েছিল এই ‘ওয়ার অন টেরর’,পরবর্তী টার্গেট হয়েছিল ইরাক। এখনো অব্যাহত এই যুদ্ধের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছে শত শত কোটি ডলার, প্রাণ গেছে লাখ লাখ মানুষের, কিন্তু এটির শেষ এখনো দেখা যাচ্ছে না।

২০০৮ সালের অর্থনৈতিক ধস: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮। যদি একটি দিন দিয়ে গত দশকের বিশ্ব মন্দার সবচেয়ে নাটকীয় মূহুর্তকে চিহ্নিত করতে হয়, এটি হচ্ছে সেই দিন। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যাদেরকে মনে করা হয় মহীরূহ, সেরকম এক বড় বিনিয়োগ ব্যাংক লেম্যান ব্রাদার্স এদিন নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছিল।

লেম্যান ব্রাদার্স ছিল যুক্তরাষ্ট্রের চতুর্থ বৃহত্তম বিনিয়োগ ব্যাংক। তাদের দায়ের পরিমাণ ছিল সাত হাজার কোটি ডলার। বিশ্ব অর্থ ও পুঁজিবাজারে এটি এত মারাত্মক ধাক্কা দিয়েছিল যে রাতারাতি পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছিল। বড় বড় সব ব্যাংক নিজেদের মধ্যে লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছিল। এই আর্থিক সংকট গ্রাস করছিল পুরো বিশ্বের অর্থ ব্যবস্থাকে। বাধ্য হয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, ব্রিটেন, কানাডা, জাপান, চীন থেকে শুরু করে সব বড় বড় অর্থনীতির দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক একযোগে পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মানুষের আস্থা ফেরাতে।

ইউরোপের অনেক দেশ কার্যত তাদের পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থাকেই জাতীয়করণ করেছিল দেউলিয়াত্ব থেকে বাঁচাতে।

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ফেডারেল রিজার্ভের তৎকালীন চেয়ারম্যান বেন বেরনানকের ভাষায়, এটি ছিল বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর আর্থিক সংকট।

তবে এই সংকট একদিনে তৈরি হয়নি, একটি ঝড়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল নানা ধরণের ঘটনায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, যারা বিশ্বের ব্যাংক এবং আর্থিক ব্যবস্থার হর্তাকর্তা, তারা ধারণাই করতে পারেননি যে এই সংকটে বড় বড় সব ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাবে আর এগুলোকে বাঁচাতে বিভিন্ন দেশের সরকারকে শত শত কোটি ডলার ঢালতে হবে।

ব্যাপারটি প্রথম শুরু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ির দাম কমতে শুরু করার মধ্য দিয়ে। ব্যাংকগুলো এমন সব লোকজনকে বাড়ি কেনার জন্য ঋণ দিয়েছিল, যারা ছিল ঋণগ্রহীতা হিসেবে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। সাব প্রাইম মর্টগেজ মার্কেটের এই সংকট ধীরে ধীরে পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছিল। ২০০৭ সালে এই সংকট বিস্তৃত হলো অন্যান্য দেশেও। একের পর এক ব্যাংক দেউলিয়া হতে শুরু করলো।

এই আর্থিক সংকটের জের ধরে ইউরোপ-আমেরিকায় শুরু হয়েছিল দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক মন্দা। লাখ লাখ মানুষ তাদের কাজ হারিয়েছিল। ইউরোপের বহু দেশে সরকারগুলোর আর্থিক দায়দেনা এত বেড়ে গিয়েছিল যে তাদের কঠোর কৃচ্ছতা কর্মসূচী নিতে হয়েছিল। এই আর্থিক মন্দার ধাক্কা এখনো পুরোপুরি সামলে উঠতে পারেনি অনেক দেশ।

আরব বসন্ত : ব্ল্যাক সোয়ান ইভেন্টের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য যদি হয় আনপ্রেডিক্টিটেবিলিটি, আরব বসন্ত সম্ভবত তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। ২০১১ সালের শুরুতে যে পরিবর্তনের ঘূর্ণি হাওয়া বইতে শুরু করেছিল সেখানে, তাতে উড়ে গিয়েছিল কয়েকদশক ধরে দোর্দণ্ডপ্রতাপে ক্ষমতায় থাকা অনেক স্বৈরশাসকের মসনদ। কিন্তু ঘটনা শুরুর আগে পর্যন্ত এর বিন্দুমাত্র আভাস কেউ দিতে পারেনি।

বিশ্বে যাদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পূর্বাভাসকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসযোগ্য এবং গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়, ইকনোমিস্ট ম্যাগাজিন এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট তাদের একটি।

২০১১ সালে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি-অর্থনীতি কেমন হতে পারে, এ নিয়ে যে বিশ্লেষণ তারা ডিসেম্বরে প্রকাশ করেছিল, সেখানে আরব বসন্তের মতো তুমুল রাজনৈতিক অস্থিরতা আর গণবিক্ষোভের কোন আঁচ তারা করতেই পারেনি।

তিউনিসিয়ায় নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া ফল বিক্রেতা মোহাম্মদ বোয়াজিজি মারা যান জানুয়ারিতে। সেদিন তার জানাজা পরিণত হয়েছিল পাঁচ হাজার মানুষের বিক্ষোভ মিছিলে। সেই বিক্ষোভ ক্রমে ছড়িয়ে পড়েছিল সারা তিউনিসিয়ায়। ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে স্বৈরশাসক জিনেল আবেদিন বেন আলিকে পদত্যাগ করে পালিয়ে যেতে হয় সৌদি আরবে। এটি ছিল আরব বসন্তের প্রথম সাফল্য।

এই বিক্ষোভ ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবেশি মিশর, লিবিয়া, মরক্কো, সিরিয়াসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে। মিশরে এই আন্দোলন সবচেয়ে ব্যাপক রূপ নিয়েছিল। সেখানে হোসনি মোবারাককে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। লিবিয়ায় গণবিক্ষোভ গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়, লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি নৃশংসভাবে খুন হন বিদ্রোহীদের হাতে।

কিন্তু যে গণতন্ত্রের আকাঙ্খা থেকে আরব বসন্তের বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, তা কিছুদিনের মধ্যেই ফিকে হতে শুরু করে।

মিশরের নির্বাচিত মোহাম্মদ মুরসির সরকারকে সেনাবাহিনী ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। লিবিয়ায় নৈরাজ্য দেখা দেয়। সিরিয়া আর ইয়েমেনে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ, যাতে বাইরের শক্তিধর বিভিন্ন দেশ জড়িয়ে পড়ে।

সিরিয়া আর ইরাকের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে ইসলামিক স্টেট জঙ্গিরা সেখানে তাদের ভাষায় খেলাফত প্রতিষ্ঠা করে। অনেক রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর ইসলামিক স্টেটকে এসব অঞ্চল থেক আবার হটিয়ে দেয়া হয়।

আরব বসন্তের প্রতিঘাতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে এখনো চলছে অস্থিরতা, যুদ্ধ, নৈরাজ্য।

করোনাভাইরাস মহামারি: যে মহামারি এখন পৃথিবীকে অচল করে রেখেছে, সেটির ইতিহাস এখনো রচিত হয়ে চলেছে। কাজেই করোনাভাইরাস মহামারির শুরুটা আমরা বলতে পারি, কিন্তু এর শেষ কোথায়, কখন, কীভাবে হবে, সেটি এখনো অজানা।

কিন্তু তারপরও বলা যায়, নিকোলাস নাসিম তালেব করোনাভাইরাস মহামারির যেসব বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন, সেই সংজ্ঞা অনুযায়ী করোনাভাইরাস মহামারি ব্ল্যাক সোয়ান ইভেন্টের সবচেয়ে জ্বলন্ত উদাহরণ।

গত জানুয়ারিতেও বিশ্ব চলছিল স্বাভাবিক গতিতে। সকালে রাশ আওয়ারে নগরীর রাস্তায় গাড়ির ভিড়। মানুষ ছুটছিল কাজে। শিক্ষার্থীরা স্কুলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাজারগুলো গমগম করছিল। রেস্টুরেন্ট-পানশালায় ঘনিষ্ঠ হয়ে বসা উচ্ছল মানুষের দল। ফুটবল স্টেডিয়ামে হাজারো সমর্থকের উল্লাস। বিপণিকেন্দ্রে উজ্জ্বল আলোর নীচে আগ্রহী ক্রেতাদের ভিড়।

তারপর অদৃশ্য ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লো মানুষ থেকে মানুষে, এক শহর থেকে আরেক শহরে, বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। সব কোলাহল থেমে গেল। শহরগুলো যেন মৃত্যুপুরী।

অনেক বিশেষজ্ঞই এখন বলার চেষ্টা করছেন এরকম একটা মহামারি যে হতে পারে তার হুঁশিয়ারি তারা নাকি আগেই দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, একটি মহামারি মোকাবেলার জন্য যে পুরো বিশ্বকে এভাবে অচল করে দিতে হবে, এমনটি এই বিশেষজ্ঞদেরও কল্পনার বাইরে ছিল।

নিয়মিত ছোট-খাট ঘটনার পূর্বাভাসও আমরা আগে থেকে দিতে পারি, কিন্তু একটা অনিয়মিত এত বড় ঘটনার বেলায় কেন আমরা এত অন্ধ? কোন আঁচই করতে পারি না?

নাসিম নিকোলাস তালেবের কথায়, ব্ল্যfক সোয়ান ইভেন্টের পূর্বাভাস দেয়া খুবই কঠিন, আর এটার প্রভাব খুবই ব্যাপক। এরকম ঘটনা আমাদের প্রত্যাশার বাইরে বলেই এভাবে ঘটার সুযোগ পায়। আর একারণেই ব্ল্যাক সোয়ান এক বিরাট ধাঁধাঁ।