নূরজাহান বেগমের মৃত্যুবার্ষিকী আজ
অনলাইন ডেস্ক
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০১:২৫ এএম, ২৩ মে ২০২০ শনিবার
নূরজাহান বেগম
`বেগম` পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগমের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ শনিবার। ২০১৬ সালের এই দিনে ৯১ বছর বয়সে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘ ছয় দশক ধরে উপমহাদেশে নারীদের প্রথম সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
বাংলাদেশের নারী সাংবাদিকতায় অগ্রদূত নূরজাহান বেগম। আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন আমাদের মাঝে, থাকবেন আমাদের কাজের দিশারি হয়ে।
তিনি তো কেবল ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদকই ছিলেন না, তিনি বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার জগতে আন্দোলনের অগ্রসেনানী, নারী সাংবাদিকদের পথপ্রদর্শক।
তারই তৈরি করা পথে সহজেই বিচরণ করছে এসময়ের নারী সাংবাদিকরা। সাংবাদিকতার এই পথ তৈরি করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে নূরজাহান বেগমকে, সরাতে হয়েছে সমাজ বাস্তবতার হরেক রকম প্রতিবন্ধকতার জঞ্জাল। সেই সময়ে যা ছিল দুঃসাহসের কাজ। আর তার এই সাহসী কাজের প্রথম ও প্রধান সহায় হয়েছেন সওগাত পত্রিকার সম্পাদক বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন।
নূরজাহান বেগম কলকাতায় ১৯৪২ সালে ‘রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল’ থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪৬ এ ‘লেডি ব্রেবোর্ন’ কলেজ থেকে স্নাতক পাস করার পর সওগাত পত্রিকায় বাবার সঙ্গে সাংবাদিকতায় যুক্ত হন। বাবার কাছে তিনি সাংবাদিকতার পাঠ ছাড়াও শিখেছেন দায়ীত্বশীল সম্পাদকের করণীয়। যার স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন আজীবন ‘বেগম’ পরিচালনায়।
পত্রিকাটিকে তিনি লালন-পালন করেছেন সন্তানের মতো পরম যত্নে। ‘বেগম’ আর নূরজাহান বেগম ছিলেন যেনো অভিন্ন আত্মা।
১৯৪৭ সালে প্রথম কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘বেগম’-এর প্রথম সম্পাদক ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল এবং যুগ্ম সম্পদক ছিলেন নূরজাহান বেগম। ১৯৫০ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পান নূরজাহান বেগম।
তখনকার সমাজ বাস্তবতার বেড়াজাল ভেঙে একদিকে তিনি নিজে তৈরি হয়েছেন, অন্যদিকে তৈরি করেছেন লেখক, কবি, সাংবাদিক। একটা পর্যায়ে গড়ে তুলেছেন ‘বেগম ক্লাব’। এই সংগঠনটি নারীদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মানসিক উৎকর্ষতার চর্চায় বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রথম থেকে ‘বেগম’কে ঘিরে সমাজের বাধা আর সংসারের চৌকাঠ ডিঙিয়ে অসংখ্য নারী নিজের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে সুযোগ পেয়েছেন; নিজের পরিচয় গড়ে তুলেছেন এবং প্রতিষ্ঠা ও সুখ্যাতি পেয়েছেন স্ব স্ব ক্ষেত্রে।
এক সাক্ষাৎকারে নূরজাহান বেগম বলেছেন, ‘প্রথমদিকে আমি দেখেছি কলকাতা’য় মেয়েদের কী অবস্থা (১৯৪৭- এ) এবং ঢাকায় এসে মেয়েদের কী অবস্থা, সেটাও দেখেছি। বেগমে সবাই লেখা দিতে আসে। লেখা দিয়ে বলেন লেখাটা একটু দেখে দিন। ঈদ সংখ্যায় লেখার সাথে নিজ ইচ্ছায় ছবি দেন সকলে।’
সেসময়ের বাস্তবতায় লেখিকার ছবি ছাপানোটা ছিল সাহসের কাজ। যা ছিল অচলায়তন ভাঙা প্রগতিশীল সাংবাদিকতার মনোভঙ্গি। তার এই সাহসের প্রেরণা ছিলেন বাবা নাসিরউদ্দীন।
পত্রিকাটির জন্ম থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের তত্ত্ববধানে বেগম সম্পাদনা করেছেন নূরজাহান বেগম। এভাবেই নূরজাহান বেগমের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাহসী সাংবাদিকতায় পত্রিকাটি ক্রমেই শহর থেকে গ্রামে সবার হয়ে উঠেছে। বেগম’ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন এদেশের গ্রাম, শহর ও উপশহরের অন্তঃপুরবাসিনীরা।
সাংবাদিকতায়, সমাজ ও সংস্কৃতিতে আলো জ্বেলে গেছেন নূরজাহান বেগম; তার অবদান স্মরণীয়, তিনি প্রাসঙ্গিক হয়েই ফিরে ফিরে আসবেন আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের করণীয়তে।
মৃত্যু অবধি তিনি বন্ধুসম ‘বেগম’ নিয়েই থেকেছেন। নূরজাহান বেগম এবং পত্রিকাটিকে বাঁচিয়ে রাখার আহবান জানিয়েছেন বার বার।
এ প্রসঙ্গে সন্তানদের ওপর ভরসা করে বলেছেন, আমার মনে হয়, ওরা যদি অন্যকিছুর দিকে না তাকিয়ে শুধু নারীসমাজের উন্নয়নের দিকে তাকায়, তাহলেই ‘বেগম’ চলবে।
দীর্ঘ কর্মময় জীবনের অভিজ্ঞতার আলোয় উদ্ভাসিত নূরজাহান বেগম দৃঢ়ভাবে বলে গেছেন, ‘মেয়েদের আর পেছন ফিরে তাকানোর প্রয়োজন নেই, পথ এখন প্রশস্ত। আপনারা এগিয়ে চলুন। পুরুষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এগিয়ে চলুন।’
নারী জাগরণের পথিকৃৎ নূরজাহান বেগমের এই আকাঙ্খা, আদেশ ও শুভাশীষ আমাদের কর্মপ্রেরণায় পাথেয় হোক নিরন্তর। তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি ।
নূরজাহান বেগমের জন্ম ১৯২৫ সালের ৪ জুন, চাঁদপুরের চালিতাতলী গ্রামে। মা ফতেমা বেগম ছিলেন তার সব কাজের নীরব প্রেরণা, বাবা মোহাম্মদ নাসরিউদ্দীন ছিলেন তার সকল প্রেরণার উৎস। তার স্বামী দেশে প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক রোকনুজ্জামন খান (দাদাভাই)।
নূরজাহান বেগম ১৯৯৬ সালে পেয়েছেন ‘নন্দিনী সাহিত্য পুরস্কার’, ‘রোকেয়া পদক’ পেয়েছেন ১৯৯৭ সালে। অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার পান ২০০২ সালে, ২০১০ এ পেলেন ইনার হুইল ডিস্ট্রিক্ট সম্মাননা এবং একুশে পদক দিয়ে নূরজাহান বেগমকে সম্মান জানানো হয় ২০১১ সালে।