ঢাকা, শুক্রবার ২৯, মার্চ ২০২৪ ১৬:০০:১৬ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

বৈধব্য, আর মায়ের নাকফুল : নাদিরা কিরণ

নাদিরা কিরণ

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৩:২৩ পিএম, ৭ নভেম্বর ২০২০ শনিবার

মায়ের সঙ্গে লেখক।  ছবি ফেসবুক থেকে নেয়া।

মায়ের সঙ্গে লেখক। ছবি ফেসবুক থেকে নেয়া।

২০০৩ সালের কথা। গ্রামে গিয়ে এক সকালে বাবার স্ট্রোক করে। জমিজমা নিয়ে শরীকদের সাথে সমস্যা মিটাতে এবং নিজের কেনা জমির সুরাহা করতে গিয়ে ভাইয়ের পরিবারের অসহযোগিতায় বাবা বেশ মানসিক চাপে ছিলেন সেসময়। তাই কাজ অসমাপ্ত রেখে ছোট খালার বাসায় চলে যান। সেখানেই অসুস্থ হয়ে পড়লে খালা- খালুর তত্ত্বাবধানে তাৎক্ষনিক চিকিৎসা শেষে ঢাকায় আনা হয় তাকে। এরপর বাবার সার্বিক শুশ্রূষা বলা চলে একা সামলেছিলেন মা। দুটো বোন তখন বেশ ছোট এবং এক বোন যশোরে থাকায় হাসপাতাল- চিকিৎসকের কাছে দৌড়াদৌড়ি সামলাই আমি। আর স্ট্রোকের মানুষের ভিন্ন রান্না, মুখে তুলে খাইয়ে দেয়া, রাত জেগে পাহারা সবই করতেন মা। এমন অবস্থায় বাবার ছিলো অনেকটা শিশুর মতন আবদার। বাইরে যেতে চাইতেন, তাই চোখে চোখে রাখতে হতো যেন একা কোথাও চলতে চেষ্টা না করেন। সারা দিনে এটা ওটা খেতে চাইতেন, তার ব্যবস্থা করা সবটাই সামলাতেন মা। তারই সেবায় অনেকটা সুস্থ হয়েও ওঠেন। তবে এক সকালে নিজে খাট থেকে নামতে গিয়ে টেবিলে আঘাত পেয়ে দ্বিতীয় বারের স্ট্রোকে আর ফিরে আসেননি বাবা। হঠাৎ ধাক্কা সামলে আশায় ভর করা মুহুর্তে আবারও তীর ভেঙ্গে পড়ার মতন অবস্থায় আমরা তখন। তড়িঘড়ি বাবাকে হাসপাতালে নেয়া হলেও আর চেতনা ফেরেনি। নিজের চোখে দেখলাম অক্সিজেন দেয়ার এক পর্যায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস উঠছেনা তার। অজানা শঙ্কা তবু বেঁচে যেতে পারেন ভরসায় আল্লাহকে ডাকছি। তবে চিকিৎসক এসে সে আশাও ছেড়ে দিলেন। মৃত্যু অমোঘ, তবু সন্তান হিসেবে এবং এত একান্ত আপনার জনের বিদায়ের কষ্টটা কেমন তার প্রথম অনুভব করলাম। তা যাদের গেছে তারা ছাড়া কেউ ততটা বুঝবে না । তবে এতটা শোকের মাঝেও মাথায় প্রথম চিন্তায় এলো মায়ের কথা। আমাদের মাথার ওপরের ছায়াটা আলগা হয়ে গেলো, স্নেহ-ভালোবাসার শুণ্যতা, হারালাম পরম অভিভাবক। কিন্তু মা, তিনি হারালেন তার পরম ভরসার মানুষটিকে। প্রায় বত্রিশ বছরের একাট্টা জীবন সঙ্গীকে।
সন্তান পাশে থাকলেও একান্ত জনের শূণ্যতা কি তাতে পূরণ হয়?

৭২ সালে মাকে যখন বাবা বিয়ে করেন, তখন মায়ের বয়স পনেরো । ততদিনে বাবা পড়াশুনা শেষ করে প্রথমে চাকরি তার কিছুদিন পরে ব্যবসায় নেমে অল্পদিনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। স্বাভাবিকভাবে মায়ের সঙ্গে বাবার বয়সের গ্যাপটা বেশ। তারপরও ঐ কিশোরী অবুঝ বয়সেই নতুন একজন মানুষের সঙ্গে সোজা গ্রাম ছেড়ে ভিন্ন এক শহরে সংসার শুরু করে নতুন পরিবেশে ঠিক মানিয়ে নিলেন। এমনকি সমীহ ও যত্নের সুন্দর সম্পর্ক ছিলো শাশুড়ির সঙ্গেও। বয়সের গ্যাপে বাবা- মায়ের দুজনের ইচ্ছে- অনিচ্ছের বোঝাপড়াটা ঠিক একই সুরের হয়ত ছিলোনা। তবে স্বামীর ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেয়া, শশুর বাড়ির আত্মীয় স্বজন সামলানো, চাহিদার আধিক্যকে গুরুত্ব না দেয়ার এ মানুষটির জন্যই সংসারে যে নিশ্চিন্তের বাস, তাকে বাবা ভালোবাসবেন না তা কি হয়? কেবল আর্থিক যোগান ছাড়া পরিবারের যাবতীয় চাহিদা, আমাদের লেখাপড়া সামলানো, টিউটর বাছাই সবই সামলেছেন মা। এতকিছুর পরও নানা ধরনের সেলাই,কারুশৈলীরও গুন ছিলো মায়ের।

দাদীর কাছেই শোনা, বিয়ের সময় কন্যা ও তার পরিবারের সন্তুষ্ট মেলে তেমন টিকলি থেকে গলা, কান, হাতের সবটাই গহনায় সাজিয়ে নিয়ে এলেও ঐ বয়সে এসব নিয়ে তেমন আদিখলেপনা ছিলো না মায়ের। গলায় চেইন ,কানে ছোট্ট দুল আর হাতে সাদামাটা দুখাছা সোনার চুড়িই তার অলঙ্কার হিসেবে থাকতো সর্বদা। শুনেছি এবং পরে দেখেছিও বাইরে বেরুলে একটু চোখে কাজল ছাড়া কিছুই সাজতেন না মা। তবু প্রসাধনহীন মুখশ্রীর খাড়া নাকটিতে ছোট্ট একটি মুক্তার নাকফুলেও মাকে লাগতো অসামান্য সুন্দরী। যা বোঝার বয়সে সন্তান হিসেবে আমাদেরও ছিলো মুগ্ধতার। সে আমলের বাবা-মায়ের রোমান্টিকতা সন্তান হিসেবে ঠিক না বুঝলেও অহঙ্কারহীন, সংসারের কান্ডারী এ মানুষটির প্রতি বাবারও যে মুগ্ধতা ছিলো তা বুঝতাম বড় হয়ে।
সেই বোঝাপড়ার মানুষটিকে হারিয়ে মায়ের শোকটা কতটা তা অনুভব যতটা করতে পারি, বেশ বুঝি কষ্টটা তার চেয়ে আরও অনেক গভীর।

নিথর বাবাকে এক নজর দেখতে আশপাশের মানুষজন এলেন। এলেন ফুফু, মামা তাদের সন্তানসহ নিকট-দূরের আত্মীয়রাও। সবার মুখে বাবার মৃত্যুর কারণ,তার পুরোনো স্মৃতি, এতিম হয়ে যাওয়া আমাদের অসহায়ত্ব এসব ঘুরেফিরে আলোচিত হচ্ছে। এর মাঝেই ক্রদনরত, মানসিক বিধ্বস্ত মায়ের স্নান সেরে নেয়ার তাগিদ। স্নান শেষে মায়ের নাকি নতুন শাড়ি পড়তে হবে। আত্মীয়ের দেয়া শাড়ি। ছোটফুপু- ফুপা মায়ের শাড়িও কিনে এনেছেন। ধুসর তার রঙ। স্বামী নেই তাই তাকে নাকি ধুসর সাদা শাড়ি পড়তে হবে। বাঁধ সেধে বললাম, বৈধব্যের এ রীতি বানালে কে? তার শোক যে জন্য তা প্রদর্শনের বা জানান দেয়ার কি আছে?

স্বামী নেই সেই শোকে কাতর মানুষটি কি আলাদা গ্রহের হয়ে গেলো যে তাকে আলাদাভাবে প্রকাশ করতে হবে? বড় মামাও শাড়ি কিনতে যাচ্ছেন জেনে নিষেধ করলাম। তিনি প্রথা মানতে হবে বলে বোঝানোয় শর্ত দিলাম হালকা রঙের হলেও সাদা যেন নয়।
এরই মাঝে নাকফুলটার প্রসঙ্গও কানে এলো। ফুপু-খালাদের গোল জমায়েতে শক্ত করে বলে দিলাম, কেউ যেন মায়ের নাকফুল নিয়ে কথা না তোলে। এও বললাম বৈধব্যের চিহ্ন প্রকাশ করতে হবে ধর্মে এমন কোনও বিধি-নিষেধ কোথাও নেই। নাকফুল খুলতেই হবে বলা নেই কোথাও। আর বৈধব্য প্রকাশের বিষয় নয়। যার যায় সে বোঝে। তার সেই শোক অন্যকে দেখানোর কি? একে অন্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেও কেউ কিছু বলার সাহস পেলেন না। বললাম, মায়ের শোক আর বাড়াবেন না।

ক'দিনে শোকে মায়ের নিজেরও এদিকে নজর ছিলো না। তবে অল্প ক’দিন পরেই একদিন ডেকে নাকফুলটা খুলতে সহযোগিতা চাইলেন। বহুদিনের নাকছাবিটা আটকে রাখা পুশের সাথে আটকে গেছে তাই খুলতে পারছেন না। বললাম, এতদিনের সঙ্গিটা আপনাকে ছাড়তে চায় না, আপনি কেন তাকে ছুঁড়ে ফেলতে চান?

‘সবাই ভালোভাবে নেবে না’ এমনটা বলায় মাকে বোঝালাম, এনিয়ে কোথাও কোনও নিয়ম নেই। স্বামীহীন আপনি কারো জানবার বা অবলোকনের কিছু নন। আপনার কষ্ট আপনার। এগুলোর সমাজের সৃষ্টি। অন্য বোনরাও এসে বোঝালো, বিষয়টি মা মানছেন তবু আশপাশের মানুষজন কি বলবেন, তাই সিদ্ধান্ত বদলাতে চাইছেন না। আমরাও নাছোড়বান্দা। এ সমাজের কারো অধীনস্ত আপনি নন। এমনকি সন্তানদের ওপরও নন নির্ভরশীল। সেই সমাজ কি ভাবলো কি যায় আসে। অনেকে এসব মানছেও না। আর আমরা সন্তানরাই তো পাশে আছি।

অনেক বুঝিয়ে সেদিন খুলতে না দিলেও মা প্রায়শ নাকফুলটা খোলার জন্য উল্টো আমাদের বোঝাতেন। আর আমরা তাকে বোঝাতাম, নিজের মুখটিতো কাউকে বর্গা দেয়া নেই। বলতাম, তাঁর খাড়া নাকটিতে নাকফুলটি কি সুন্দরই না লাগে। আরো বলতাম, বিষন্নতায় এমনিতেই মুখটা মলিন করে রাখেন, চটকতো কিছু নয়। কেউ কিছু বললে জানতে চাইবেন, কোথায় আছে এমন নিয়ম। নতুবা আমরা সামলাবো।

আমাদের চাপে হার মানেন ঠিকই। কিন্তু মাস কয়েক পরে একদিন বাড়ি ফিরে দেখি মায়ের মুখটা কেমন যেন খালি খালি। চট করে চোখ যায় নাকে, নাকফুলটা নেই। কই জিজ্ঞেস করতেই মা জানালেন, অনেক কষ্ট করে সেটা খুলেছেন। আমরা হৈ চৈ শুরু করলেও কারণ বলেন না।

পরে অনেক জোরাজুরিতে জানালেন, বাসার নিচেই ওষুধ কিনতে গেলে এলাকার এক চেনা ভদ্রলোক কথার চতুরতা দিয়ে ঘুরিয়ে কুশলাদি জেনে বলেছিলো, ভাবিকে অবশ্য বোঝা যায় না বয়সটা। কত পরিশ্রমী। ভাই যে নাই তাও ভুলে যাই আমরা। প্রচন্ড রেগে লোকটিকে কিছু বলতে চাইলে মা নিবৃত করেন। বললেন, নারীদের নিয়ে মাথাব্যথাটা এ সমাজের বেশিরভাগেরই। সে সমাজেরই প্রতিভু।

হ্যাঁ সমাজ বটে, পুরুষতান্ত্রিকতার সমাজ। যে সমাজ নারীটির স্বামী বিয়োগের অসহায়ত্ব দেখতে চায়। সে বিধবা, তাই তাকে আলাদা করতে হবে যেন। তার চিহ্ন থাকা তো চাই!

কিন্তু স্ত্রী মারা গেলে স্বামীকে কি তা প্রমাণ দিয়ে বোঝাতে হয়? ছাড়তে হয় কিছু ? হয় কি রঙের অদলবদল? পরতে হয় ভিন্ন কিছু ? তাহলে নারীকে কেন?

সনাতন ধর্মে অবশ্য ধর্মীয় রীতি মেনে বিয়ের সময় শাখা সিঁদুর পলা পরা আর আবার স্বামী বিয়োগে তা খুলে সাদা কাপড় পরার নিয়ম রয়েছে। সে নিয়মও আজকাল মানছে না অনেকেই। কপালেও লাল না হলেও অন্য রঙের টিপও পরছেন কেউ কেউ । কারণ সমাজপতিদের সৃষ্ট এসব নিয়ম কেবল নারীদের নিয়ন্ত্রণে রাখারই নামান্তর ভেবে ভ্রুকুটি তাদের। ধর্মীয় ব্যাখ্যায় না যাই। তবে এওতো ঠিক, সকল ধর্মের চর্চাটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। ফলে ধর্মের নামে নিয়ম রীতি,আচারের ব্যাখ্যাটা অনেকটাই এসেছে তাদের মত করে। বিশেষত কিছু রীতি-আচার যে নারীকে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োগে তা বলবার অবকাশ রাখে না।

নতুবা যে কারো শোকও তো একসময় কাটে। মনের রঙটা আবার উঁকি দিলেই তখন সমাজের কার তাতে বাধে? পুরুষের ক্ষেত্রে বাধে না তাহলে নারীকে কেন নিতে হবে তার দায়? এ দায় তৈরী পুরুষতান্ত্রিক সমাজের। নারীকে দূর্বল চিত্তের, করুণার পাত্র দেখতে পুরুষের বেশ লাগে।

অথচ, স্ত্রী বিয়োগের তিন মাসও কাটাতে চান না, বিয়ের পিঁড়িতে বসতে তর সয় না ৭০ বছরের বুড়োরও। সমাজ তা নেতিবাচক দেখে না। দেখি না আমিও । একাকী জীবনে ভুগতে চাননা, তাই তিনি সঙ্গী বেছে নেবেন। ভালো তো। কিন্তু ৭০ নয় ৪০ বছর বয়সী বিধবা নারীর একজন সঙ্গী দরকার সহজে কি ভাবে সমাজ? গুলতেকিনের বিয়ে তাই এতটা আলোচিত হয়। তাও তার সামাজিক অবস্থান ও সাবেক লেখক স্বামীর অালোচিত ২য় বিয়ের কারণে কিছুটা ইতিবাচক দেখেছেন অনেকে। এদেরও বেশিরভাগই পাশের বাড়ির পরিচিত এ বয়সের কোনও নারী বিয়ে করলে ঝড় তুলতেন ঠিকই । গুলতেকিনের মত সাহস আমাদের সেকালের মা ভাবতেও পারেন নি নিশ্চয়ই । তবু এতদিনের অভ্যস্ততার একটা নাকফুল তার নাকে শোভা পাক, এটুকুও তিনি চাইতে পারবেন না?

মা সবই বোঝেন। তবুও বাড়ির বাইরে বেরুতে গেলে কতগুলো চোখ মায়ের মুখে তির্যক দৃষ্টি ফেলুক। ভ্রু কুঁচকে তাকাক। যাত্রার মুহুর্তটা নষ্ট হলেও তার কঠিন জবাব দেয়ার মানসিক জোরটা নেই মায়ের। নেই মুখের সামনে থুথু ফেলে সমাজকে ভ্রুকুটি করে ফালতু নিয়ম ভেঙে গটগট করে চলে যাওয়ার মত শক্তিটা। তাই মায়ের সুন্দর মুখশ্রীর সরু নাকটিতে নেই সেই ছোট্ট নাকফুলটা। ছোট্ট পাথরের সেই নাকফুল যা প্রসাধনহীন মায়ের মুখটিকে করে তুলতো অপরুপা, অনন্যা।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।