ঢাকা, শুক্রবার ২৯, মার্চ ২০২৪ ১৪:১৭:৫৭ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

শহীদ ডা. আয়েশা বেদোরা চৌধুরী: মৃত্যুহীন প্রাণ

অনলাইন ডেস্ক

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১১:৫৩ এএম, ১ জানুয়ারি ২০২১ শুক্রবার

শহীদ ডা. আয়েশা বেদোরা চৌধুরী

শহীদ ডা. আয়েশা বেদোরা চৌধুরী

মাত্র ২১ বছর বয়সে কলকাতার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ থেকে দুটি গোল্ড মেডেল পেয়ে এমবিবিএস পাস করেন মেধাবী চিকিৎসক আয়েশা বেদোরা চৌধুরী ডোরা।  দেশসচেতন ডা. আয়েশা মনে-প্রাণে এবং কাজেও মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিলেন। একাত্তরের দিনগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের শুধু চিকিৎসায় দেননি তাদের দিয়েছিলেন আশ্রয়, সেবা ও প্রয়োজনীয় জিনিসের জোগান।

১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ডা. আয়েশা ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। তিনি যুদ্ধাহত মানুষদের চিকিৎসা দিতে সাধ্যেও বাইরে গিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করে যান। গোপনে অনেক ওষুধপত্র প্রয়োজন হয় এমন অনেক সরঞ্জাম মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ডা. আয়েশা যুদ্ধের ৯ মাস নীরবে সক্রিয় থেকে কাজ করে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে। সাদামাটা বেশভূষা আর অতি-অমায়িক ব্যবহারের কারণে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব তার সহকর্মীদের মধ্যে তিনি ছিলেন সকলের প্রিয়জন।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। দেশ স্বাধীন হওয়ার সংবাদ পেয়েই ডা. আয়েশা উত্তেজনা আর ধরে রাখতে পারেননি। নিজের গাড়িতে খালা-খালু ও ভাইয়ের স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ঢাকার রাস্তায়। মানুষের বিজয় উল্লাসে শামিল হতে চেয়েছিলেন। এ যে দেশ জয়ের আনন্দ। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। শেষ বেলার বর্বরতার শিকার হন ড. আয়েশা। পাকিস্তানি বাহিনীর শেষ মুহূর্তের উন্মত্ততার করুণ নির্মমতার শিকার হয়ে বিজয় উদ্্যাপন করবার আগেই পাকিস্তানি সেনার ছোঁড়া বুলেটে ঝাঝরা হয়ে গিয়েছিল ডা. আয়েশার শরীর।

৯ মাস আড়ালে থেকে গোপনে যে সহযোগিতা দিয়েছেন ১৬ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয় দেখতে সেদিন আর চুপ করে ঘরে বসে থাকতে পারেননি। তিনি বেড়িয়েছিলেন তার খালু সড়ক বিভাগের সাবেক চিফ ইঞ্জিনিয়ার হাতেম আলী খান কে সঙ্গে নিয়ে তার নিজের গাড়িতে। সঙ্গে ছিলেন খালা ও ভাই বউ। তারা প্রথমেই ছুটে যান ১৮ নং রাস্তার সেই বাড়িতে যে বাড়িতে বেগম মুজিব ছিলেন বন্দী। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বেগম মুজিবকে বিজয়ের খবর জানানো। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। তখনো খান সেনারা মেশিনগান উচিয়ে পাহারা দিচ্ছিল এই বাড়ি। পাকিস্তানি সেনারা জানতো না যে তারা আত্মসমর্পণ করছে। ড. আয়েশার গাড়িটা ওই বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সঙ্গে শিকার পেয়ে আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠেছিল নৃশংস বর্বর পাক সেনারা। মুহূর্ত মাত্র দেরী না করেই তারা একটানা গুলিবর্ষণে ঝাঝরা করে দিয়েছিল গাড়িটিকে।  গুলি এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় ডা. আয়েশাকে।

শত্রুমুক্ত ঢাকা’র মুক্ত হাওয়ায় মুক্তির আস্বাদ পেতে। নিজেদের এ স্মরণীয় সময়ের সাক্ষী করবার বাসনায় এই দুর্লভ সময়ের সাথী হয়েছিলেন বেগম হাতেম আলী খান (ছোট খালা) এবং তাদের পুত্রবধূ মাহবুবা রশীদ চপল (ড. আয়েশার ভাইয়ের বউ)। যিনি চিকিৎসা দিয়ে প্রতিটি সময় মানুষকে বাঁচিয়ে তুলেছেন তিনি এতটুকু সময় পাননি চিকিৎসার, ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আর নিহত হন গাড়ির চালক মুনির আহমেদ। খালু হাতেম আলী খানের পায়ে এসে গুলি লাগে। বেগম খানের লাগে হাতে। তাদের পুত্রবধূর মাথার তালু ছুয়ে গুলি চলে যায়। অল্পের জন্য রক্ষা পান তিনি। বুলেটবিদ্ধ গুরুতরভাবে আহত খালা খালু ভাইবউ আশ্রয় নেন পাশের একটি বাড়িতে। পরে সেখান থেকে তাদের পাঠানো হয় হাসপাতালে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই যারা হাতের অস্ত্র ফেলে দিয়ে দুহাত তুলে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিল সামান্য সময় আগেই তাদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের শিকারে পরিণত হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করেন ডা. আয়েশা বেদোরা চৌধুরী।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ডা. আয়েশা বেদোরা চৌধুরী ছিলেন তৎকালীন স্টেট ব্যাংকের চিকিৎসক। ১৯৩৫ সালের ৬ এপ্রিল কলকাতায় জন্ম হয় ডা. আয়েশার। বাবা ইমাদউদ্দিন চৌধুরী আর মা কানিজ ফাতেমা মাহমুদা। ছয় ভাই বোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন প্রথম। ডা. আয়েশা কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে আসাম সরকারের অধীনে কিছুদিন চাকরি করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চাকরিতে যোগ দেন। এরপর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্টেট ব্যাংকের মেডিকেল অফিসার হিসাবে ঢাকার অফিসে যোগদান করেন।

১৯৬৮ সালে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ড. আবুল বাশারের সঙ্গে বিয়ে হয়।  তার দুই মেয়ে মোনালিসা ও বেলারোসা জন্মায় ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালে।  আর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর শহীদ হন তিনি।