ঢাকা, মঙ্গলবার ১৬, এপ্রিল ২০২৪ ১৪:২০:৫৮ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

ভাষাকন্যা রিজিয়া খাতুন: ৬৯ বছরেও মেলেনি স্বীকৃতি

অপর্ণা আনন্দ

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৩:১৬ পিএম, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ মঙ্গলবার

ভাষাকন্যা রিজিয়া খাতুন।  ফাইল ছবি।

ভাষাকন্যা রিজিয়া খাতুন। ফাইল ছবি।

ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়/ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে পায়ে...। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে উত্তাল ঢাকা। এর প্রভাব প্রথম দিকে গ্রামাঞ্চলে তেমন না পড়লেও ক্রমেই ছড়িয়ে জেলা শহরগুলোতেও।

বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি রক্তাক্ত হয় ঢাকার রাজপথ। এদিন রফিক, বরকত, জব্বার এবং সালামের তাজ রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার পিচঢালা কালো রাজপথ। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ঢাকা শহর। এবার সেই উত্তাপের ‘আঁচ’ লাগে সারাদেশে। ব্যতিক্রম হয়নি নড়াইলেও।

চিত্রা নদী পাড়ের এ জেলা শহরের তখন স্কুল পড়ুয়া কিশোরী রিজিয়া খাতুন। এই কিশোরী নিজের ছোট চাচার মাধ্যমে জানতে পারেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালিয়েছে পুলিশ। রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাওয়ায় ছিল তাদের অপরাধ। এ কথা শুনে ঠিক থাকতে পারেননি কিশোরী রিজিয়া। উত্তাল হয়ে ওঠে তার মন! বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে নেমে পড়েন মিছিলে। মিশে যান মিছিলেন ভিড়ে। ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ এ স্লোগানে মুখরিত করে তোলেন স্কুল পেড়িয়ে শহরের রাস্তাতেও। গড়ে তোলেন শহীদ মিনার। শহীদদের স্মরণে ২২ ফেব্রুয়ারি পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন রিজিয়া খাতুনসহ অন্যরা।

ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ শিক্ষার্থীদের স্মরণে নড়াইল জেলা শহরে প্রথম যে ১০-১৫ জন মিলে শহীদ মিনার স্থাপন করে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন রিজিয়া তাদের একজন।

ব্রিটিশবিরোধী তেভাগা আন্দোলনে তার বাবা গ্রেফতার হলে তিনি আন্দোলনকারী বর্গাচাষীদের সাথে অংশ নিয়ে পুলিশ-চাষী সংঘর্ষে সরাসরি অংশ নেন এই সাহসী কিশোরী।

জন্ম ও শৈশব: রিজিয়া খাতুন নড়াইল পৌরসভার ডুমুরতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা নুর জালাল এবং মা জিন্নাতু নেসা। রিজিয়া খাতুন নড়াইল শহরের আলাদাতপুর এলাকায় বসবাস করতেন তিনি।

তেভাগা আন্দোলনের নেতা আব্দুল মালেক উকিল। তার স্নেহধন্য রিজিয়া। এই নেতার পছন্দেই যশোরের কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশের (সিপিবি) তৎকালিন জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট কমরেড আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে বিয়ে হয় রিজিয়ার। বিয়ে আয়োজনও করা হয় আব্দুল মালেকের বাসায়। ভাষাকন্যা রিজিয়া খাতুনের চার ছেলে এক মেয়ে। তার এক ছেলে মৃত্যুবরণ করেছেন।

শিক্ষা ও কর্মজীবন : ইতিহাস বলছে, রিজিয়া খাতুন ভাষা আন্দোলনের সময় দিলরুবা গার্লস স্কুলে (বর্তমান নাম নড়াইল সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়) অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন।

পরবর্তিতে পেশা হিসেবে তিনি বেছে নেন শিক্ষকতাকে। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবন তার। ১৯৬৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ডুমুরতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শহর সরকারি প্রাইমারি স্কুল এবং মহিষখোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন তিনি।

তার বাবা কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ কারণে পরিবারে একটা উদার রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল। ভাষা আন্দোলনের সময় রিজিয়া খাতুনের বাবা তেভাগা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই অপরাধে তখন তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই সময় চাচা নুরুল আফসারের অনুপ্রেরণায় ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন রিজিয়া। মাতৃভাষা রক্ষায় তিনি রাজপথে আন্দোলন করেছেন।

ভাষা আন্দোলনে অবদান : ১৯৫২ সালে ঢাকায় মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আন্দোলন শুরু হয়। এর ঢেউ গিয়ে লাগে জেলা শহরগুলোতেও। এরই ধারাবাহিকতায় ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে নড়াইলেও শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। সেদিন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে শিক্ষার্থীরাও ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ’ এই স্লোগানে মুখরিত করে তোলে চারদিক।

সেদিন ছাত্ররা আন্দোলনে যোগ দেয়ার জন্য ছাত্রীদের আহ্বান জানালে নড়াইলে মাত্র তিনজন নারী মিছিলে সরাসরি যোগ দেন। এদের একজন রিজিয়া খাতুন।

ভাষা আন্দোলনের সময় নড়াইল শহরের মহিষখোলা বর্তমানে নড়াইল সদর এলাকার বাসিন্দা ও তৎকালীন মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফসার উদ্দিন মোক্তারের বাড়িতে গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো। এসব বৈঠকে অংশগ্রহণ করতেন রিজিয়া খাতুন, আফসার উদ্দিনের কন্যা সুফিয়া খাতুন ও রুবি।

এসব বৈঠকে ছাত্র-জনতাকে সংগঠিত করার জন্য কাজের পরিকল্পনা নেয়া হতো। রিজিয়া ভাষার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে মিছিল-মিটিং এ সক্রিয় ছিলেন। ছাত্র-জনতাকে সংগঠিত করার কাজ করতেন তিনি।

রিজিয়া খাতুনসহ ১০-১৫ জন মিলে শহরের তৎকালীন কালিদাস ট্যাংকের (বর্তমান টাউন ক্লাব) পাশে প্রথম শহীদ মিনার তৈরি করেন এবং পুস্পমাল্য অর্পণ করেন।

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড : ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়ে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চলে তেভাগা আন্দোলন। এ আন্দোলনে গ্রেফতার হন রিজিয়া খাতুনের বাবা নুর জালাল। ভাষা আন্দোলন শেষে বাবা নুর জালালের মুক্তির দাবিতে ১৯৫৪ সালে নড়াইলে ২০ হাজার লোকের এক বিশাল জনসভায় রিজিয়া খাতুন বক্তব্য রাখেন।

সম্মান ও স্বীকৃতি : সরকারিভাবে আজ পর্যন্ত কোনো সম্মান না মিললেও স্থানীয়রা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে রিজিয়া খাতুনকে ভাষা সৈনিক হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

রিজিয়া খাতুনের ছেলে কামাল উদ্দিন রাসেল বলেন, ‘আমার মা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে সময়ে রাজপথে মিছিল-মিটিং করেছেন। মায়ের ভাষা রক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ হয়ে লড়াই করেছেন। কিন্তু সেসব আজ স্মৃতির অতেলে তলিয়ে যাওয়া ইতিহাস। ৬৯ বছর কেটে গেছে। জাতি ভুলে গেছে তাকে। আজও রাষ্ট্রীয়ভাবে আমার মাকে কোনো স্বীকৃতি দেয়ার হয়নি।’