ভাষাকন্যা শরিফা খাতুন, অন্যন্য ইতিহাসের অংশ
অপর্ণা আনন্দ
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০২:৩১ পিএম, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ বৃহস্পতিবার
ভাষাকন্যা শরিফা খাতুন, অন্যন্য ইতিহাসের অংশ
ভাষাকন্যা অধ্যাপক শরিফা খাতুন। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। এই ঘোষণার পর আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। নোয়াখালীতেও মিছিল হয়েছে বাংলা ভাষার পক্ষে। শরিফা তখন স্কুলছাত্রী। সে সময়ই তিনি মিছিলে অংশ নেন। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার দাবীতে আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন তিনি। এ কারণে ২০১৭ সালে তাকে একুশে পদক প্রদান করা হয়।
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন : নারী ভাষা সৈনিক শরিফা খাতুন ফেনী মহকুমার শশ্মদি ইউনিয়নের জাহানপুর গ্রামে ১৯৩৬ সালের ৬ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আসামের রেলওয়েতে চাকরি করতেন। পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি বাবা-মায়ের সঙ্গে আসামেই থাকতেন।
বাবা মোহাম্মদ আসলাম এবং মা জেবুন্নেছা চৌধুরাণী যখন দেখলেন বাংলা ভাষায় পড়ার উপযোগী কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আসামে নেই তখন শরীফা খাতুনকে কুমিল্লা তার খালার বাসার পাঠিয়ে দেন। বাবার চাকরির সুবাদে আসামেই থাকতেন তাদের পরিবার। ছোটবেলা কেটেছে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের কোয়ার্টারে। পরে কুমিল্লায় খালার বাসায় থেকে শহরের লুৎফুন্নেসা স্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন।
শিক্ষাজীবন : শরিফা খাতুন কুমিল্লায় শহরের লুৎফুন্নেসা স্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তখন তার চাচা তাকে ফেনীতে নিয়ে স্কুলে ভর্তি করে দেন।
১৯৫১ সালে নোয়াখালী সদরের উমা গার্লস স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৫৩ সালে ইডেন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৮ সালে এমএ পাস করেন।
১৯৫৮ সালে শিক্ষকতায় যোগ দেন। পরে বিএড কোর্স সম্পন্ন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের কলারাডো স্টেট কলেজ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেন ১৯৬৮ সালে। দেশে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। অবসরে যান ২০০২ সালে। তার ৪১টি গবেষণা প্রবন্ধ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
ভাষা আন্দোলনে অবদান : স্কুলের ছাত্রী থাকাকালীন ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের দু’একটি মিছিলেও তিনি অংশ নেন। তখনো ভাষা আন্দোলন শুরু হয়নি। ১৯৪৭ সালের আগস্টে দেশভাগের পর ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গটি প্রকাশ্যে আসে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ৪৮ সালে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। তখন আন্দোলনটা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। স্কুলের ছাত্রীরা সে মিছিলে অংশ নিয়েছে।
১৯৫১ সালে শরিফা ইডেন গার্লস কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন। এখানে এসে আন্দোলনের সঙ্গে আরও শক্তভাবে যুক্ত হন শরিফা। বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে বাংলা ভাষার পক্ষে প্রচারণা চালান।
স্কুলছাত্রীদের সংগঠিত করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ইডেন কলেজ প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেয়াল টপকে চলে আসেন আমতলায়, অমান্য করেন ১৪৪ ধারা।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির সকালবেলার কথা স্মৃতিচারণে জানিয়েছেন শরিফা খাতুন। সেদিন ১৪৪ ধারা জারি হয়ে গেছে ততক্ষণে। তবে ইডেন কলেজের ছাত্রীদের লক্ষ আমতলার সভা। ছাত্রীরা সকালবেলা উঠে প্রস্তুত হন। ততক্ষণে কলেজের গেট তালাবদ্ধ হয়ে গেছে। তখন শরীফাসহ আরো কয়েক ছাত্রী গাছ ও ডাল বেয়ে দেয়াল টপকে কলেজ আঙিনা থেকে বের হন। তারপর ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় চলে যান।
১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আরেকটি বড় ধরনের ঘটনা ঘটে। অনেক ছাত্রী গ্রেপ্তার হয়। অনেককেই সেদিন ১৪৪ ধারা ভাঙার দায়ে পুলিশ ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। সেদিন গ্রেফতার হওয়া ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ২০-২১ জন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যাপক লায়লা নূরও ছিলেন তাদের সঙ্গে। লায়লা শরীফার পরিচিতদের একজন। লায়লা নূরের সঙ্গে মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিয়েছেন শরীফা খাতুন। ২১ পরবর্তী সময়ে দেশের প্রথম শহীদ মিনার তৈরি করে তাতে যখন শ্রদ্ধা অর্পণ করা হয়, সেটিতেও অংশ নিয়েছিলেন শরিফা খাতুন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করেছেন সহযোদ্ধাদের সঙ্গে।
পুরস্কার ও সম্মাননা : ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ২০১৭ সালে একুশে পদক লাভ করেন।