সিলেটের বীর মুক্তিযোদ্ধা রুমা চক্রবর্তী
অনু সরকার
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৫:২৮ পিএম, ১২ মার্চ ২০২১ শুক্রবার
সিলেটের বীর মুক্তিযোদ্ধা রুমা চক্রবর্তী
রুমা চক্রবর্তী, একাত্তরে স্কুল ছাত্রী ছিলেন। দেশের টানে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন তিনি৷ এছাড়া আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য আগে থেকেই নিজেকে তৈরি করেন এই সাহসী নারী৷
১৯৫৬ সালের ৫ মার্চ সিলেটে জন্ম রুমা রায় চৌধুরীর৷ তবে বিয়ের পর থেকে তিনি রুমা চক্রবর্তী হিসেবে পরিচিত৷ বাবা রবীন্দ্র রায় চৌধুরী এবং মা সরজ বালা চৌধুরী৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় নবম শ্রেণীর ছাত্রী ছিলেন রুমা রায়৷ তিনি ঢাকায় বড় বোনের বাসায় থেকে পড়াশোনা করার কারণে তৎকালীন আন্দোলন-সংগ্রামের সাথে জড়িয়ে পড়েন৷
রুমা মিরপুর হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবার প্রশিক্ষণ নেন৷ এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে ঢাকা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়েও নার্সিং প্রশিক্ষণ নিয়ে সহকারী সেবিকা হিসেবে কাজ শুরু করেন৷ পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে এবং বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কাঠের বন্দুক নিয়ে প্রশিক্ষণ নেন কিশোরী রুমা রায়৷
তবে ২৫ মার্চ রাতেই যখন পাক হানাদার বাহিনীর নারকীয় তাণ্ডব শুরু হয় তখনই তিনি বুঝতে পারেন, এতোদিন ধরে তার নার্সিং এবং অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ নেওয়া খুব যথার্থ হয়েছে৷
২৫ মার্চ কালো রাতে পাক হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। পরের দিনের ঘটনা স্মরণ করে রুমা চক্রবর্তী বলেন, ‘সেইরাতে পাক বাহিনী নৃশংসভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়৷ তারা চেয়েছিল যেন কোন মানুষ কিংবা কোন জনপদের চিহ্নই না থাকে। এমনভাবে তারা বোমা ফেলছিল৷ সারা ঢাকা শহরে আগুন আর আগুন৷ ২৬ মার্চ ছাত্রীনিবাস থেকে আমাদের হাসপাতালে চলে যেতে বলা হয়৷ ঢাকা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হাসপাতালে এসে ছাত্রলীগের নেতা আলম সাহেবের সাথে দেখা হলো৷’
রুমা আরও বলেন, ‘আলম সাহেব আমাদের বললেন, মেয়েরা তোমরা গুণে দেখো এখানে লাশ কতগুলো আছে৷ আমরা কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী মেয়ে লাশগুলো গুণলাম। গুণে দেখলাম ৮৬টি লাশ জমা করা হয়েছে৷ লাশগুলো স্তূপের মতো ফেলে রাখা ছিল৷ এমন কি কিছু লাশ একটার উপর আরেকটা ফেলা ছিল৷ কিছু লাশ সরিয়ে সরিয়েও গুণতে হলো৷ এত লাশ এত রক্তের বন্যা আমি সারা জীবনেও ভুলতে পারবো না৷ বাঙালির উপরে এরকম অমানবিক অত্যাচার করেছিল হানাদার বাহিনী এটা ভুলবার মতো নয়৷'
যুদ্ধ শুরুর দিন থেকেই আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন সাহসী নারী রুমা চক্রবর্তী৷ মে মাস পর্যন্ত তিনি ঢাকায় থেকে সেবার কাজ করেছেন৷ কিন্তু এরপর ভুট্টো প্রচারণা শুরু করে, ভারত পূর্ব পাকিস্তানকে আক্রমণ করেছে৷ ফলে গ্রাম্য মানুষের মাঝে ‘হিন্দু মারো' প্রবণতা শুরু হয়৷ এসময় রুমা চক্রবর্তী এবং তার বড় বোন অন্যদের সাথে ভারত পাড়ি দেন৷
বেনাপোল ও কৃষ্ণনগর হয়ে ভারতে যান তারা। এই ঝুঁকিপূর্ণ দীর্ঘ পথের কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা বেশ কয়েকটি পরিবার সাংবাদিক হাবিবুর রহমানের সহযোগিতায় ভারত যাওয়ার জন্য রওয়ানা হই৷ তার নির্দেশ মতো আমরা পথ চলছি৷ আরো অনেক মানুষ সীমান্ত পার হওয়ার জন্য যাচ্ছিল৷ চুয়াডাঙ্গায় আমরা যখন পৌঁছেছি, সান্ধ্য আইন যে এলাকায় ছিল সেই এলাকায় চলে গিয়েছিলো আমাদের রিকশাটা৷ অন্যরা যারা ছিল তারা পানির মধ্যে হেঁটে যাচ্ছিল৷ কিন্তু আমি জোঁককে খুব ভয় পেতাম বলে পানি দিয়ে না গিয়ে রিকশায় যাচ্ছিলাম৷ আমি তো একেবারে ঘোমটা দিয়ে বুড়ো মহিলা সেজে হাবিবুর রহমানের সাথে রিক্সায় ছিলাম৷ আর ঠিক এমন সময় আমাদের রিক্সা পাক সেনাদের বহরের সামনে পড়ে গেছে৷ আমাদের বামদিকে সৈনিকরা আর ডান দিক দিয়ে সেনা কর্মকর্তারা গাড়িতে করে যাচ্ছিল৷ তারা কোন এক মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে অভিযান চালাতে যাচ্ছিল৷ আর সেনা কর্মকর্তারাও বহরে ছিল বলেই বোধহয় আমাদের ওরা কিছু বলেনি৷ তা নাহলে সেদিনই হয়তো আমাকে ধরে নিয়ে যেতো, আর বৃদ্ধ লোকটাকে মেরেই ফেলতো৷'
এমনই ঝুঁকির মধ্য দিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কলকাতায় পৌঁছেন রুমা চক্রবর্তী এবং তার বোন৷ সেখানে বাংলাদেশ দপ্তরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে নিজেদের আগ্রহের কথা জানান তারা৷ এ সময় চব্বিশ পরগণার বনগাঁয় রেডক্রসের সহায়তায় অস্থায়ী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়৷ সেখানে চল্লিশটি আসন ছিল৷ সেই হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা প্রদানে অন্যদের সাথে যোগ দেন রুমা চক্রবর্তী এবং তার বড় বোন৷ দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত সেই হাসপাতালে এবং মাঝে মাঝে যুদ্ধরত এলাকায় গিয়ে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন তারা৷