মিরাশের মা এবং মদন গ্রামের মুক্তিযুদ্ধ
অনু সরকার
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৬:৩৫ পিএম, ১৬ মার্চ ২০২১ মঙ্গলবার
প্রতীকী ছবি
১৯৭১ সালে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল দেশপ্রেমী মানুষ দেশকে বাঁচাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় শুধু পুরুষ বীরদের কথাই লেখা থাকে; বড় বড় হরফে৷ নারীদের আত্মত্যাগ মূল্যায়িত হয় খুব কম। আজ আমি এক নারী মুক্তিযোদ্ধার গল্প শোনাবো।
বাংলাদেশের মানচিত্রের একদম পূর্ব কোণে নেত্রকোনা জেলা। এই জেলার এক ছোট্ট গ্রাম ‘মদন’।
১৯৭১ সালে সারাদেশের মত নেত্রকোনার মদনেও শুরু হয়েছিল মুক্তিসংগ্রাম। দলে দলে সাহসী বীর বাঙালীরা অস্র ধরেছিল। দেশকে স্বাধীন করতে হবে, শত্রুমুক্ত করতে হবে। তাদের সাথে ছিলেন সাহসে অদম্য এক নারী মুক্তিযোদ্ধা মিরাশের মা। তার প্রকৃত নাম মিরাশী বেগম। কিন্তু এলাকায় তিনি মিরাশের মা নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন।
মিরাশের মা বা মিরাশী বেগম স্বশিক্ষিত এক গ্রাম্য গৃহবধু। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ত্রিশোর্ধ। যুদ্ধের সয় তিনি চার সন্তানের মা। তার বাবার নাম চাথু মিয়া, গ্রাম: মদন, থানা-মদন, মহকুমা (বর্তমান জেলা) নেত্রকোণা। মদন গ্রামেই তিনি স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে বসবাস করতেন।
একাত্তরে দেশ উত্তাল হয়ে উঠলে মিরাশী মুক্তিযুদ্ধে না লেখান। মিরাশী বেগম মুক্তিযুদ্ধের সময় মদন থানাসহ মুক্তিযোদ্ধাদের রাঁধুনীর কাজ করতেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাক হানাদারদের বর্বরতার কথা শুনে তার হানাদাদের প্রতি ঘৃণা জন্মেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে থাকতে থাকতে অস্ত্রচালানাও রপ্ত করেছিলেন তিনি। ভাদ্র মাসের ১৩ তারিখ থেকে মিরাশী বেগম সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন। ১ নভেম্বর থেকে ১শ ৭২ ঘন্টা মদন যুদ্ধের সময় মিরাশী বেগম দু:সাহসী ভূমিকা পালন করেন। সে যেন এক সত্যি রূপকথা। এক ভয়ঙ্কর সত্যি গল্প। অস্র হাতে যুদ্ধ করেছেন এই নারী। হত্যা করেছেন পাক বাহিনীর সদস্যদের। সাহসের সঙ্গে সমুখযুদ্ধে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
তবে তিনি সম্মুখ যুদ্ধের চেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করতেন বেশি। যুদ্ধচলার সময় গোলাবারুদ উপেক্ষা করে যুদ্ধরত প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার খাদ্য সরবরাহ করতেন নিজের জীবন উপেক্ষা করে।
মুক্তিযোদ্ধা এম.এ গণি আকন্দ তার বই ‘মুক্তিযুদ্ধ আমার প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তি’তে লিখেছেন, এক গাঁয়ের বধু, জীবনের মায়া, লাজ লজ্জা ত্যাগ করে, এখানে আমার জন্য খাবার নিয়ে এলেন। তার প্রতিদান কী কোনো দিন দিতে পারবো আমরা? এ মেয়ে কী সাধারণ মেয়ে?
১৯৭১ সালের ২৮ আগস্ট বিকেল তিনটার দিকে অল্প শক্তির এই মুক্তিযোদ্ধা দলটি খবর পায় কেন্দুয়া থেকে আসছে পাকবাহিনীর একটি বিশাল দল। দলের সদস্য কুদ্দুস গিয়ে নিশ্চিত হয়ে আসে এই খবরের সত্যতা। কি করবে এই স্বল্প শক্তির দল? পিছু হটবে? তা কি হয়!
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত্রুদের মুখোমুখি হতে অস্রহাতে প্রস্তুত মিরাশী বেগম, প্রস্তুত সকল যোদ্ধা। তারপর সকল ভয় ও পরিসংখ্যানকে মিথ্যে প্রমাণ করে নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থান নেয় মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলটি। আর যখনই তিনটি বড় নৌকাতে করে পাকবাহিনী মাঝ নদীতে আসে তখনই তারা পরিণত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের মুহুর্মুহু গুলি এবং অভেদ্য লক্ষ্যের শিকার। দুটো নৌকা ডুবে যায় প্রথমেই। নদীতে লাফ দেয় তৃতীয় নৌকার অনেকে। জীবনে কখনো পুকুর-নদী না দেখা ও সাঁতার না জানা পাঞ্জাবীদের সেখানেও বিপদ। ডুবে মরতে থাকে একে একে। হানাদারদের রক্তে লাল হতে থাকে মগরা নদী।
এদিকে এই আক্রমণ থেকে বেঁচে যাওয়া নদীর অপর পাড়ে থাকা বাকী পাকসেনারা নদীর অপর পারে একটি স্কুলে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। এ সময় মিরাশী বেগমসহ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল নদী পেড়িয়ে তাদের অবস্থান দেখতে গিয়ে বুঝতে পারে ওই পাকসেনারা অপ্রস্তুত অবস্থায় স্কুল মাঠে আছে। তখন তারা আবার আক্রমণ চালায় তাদের উপর। আবারো তীব্র ক্ষতির সম্মুখীন হয় পাকসেনারা। প্রাণ হারায় অনেকে। স্কুলের ভেতরে গিয়ে পালিয়ে বাঁচে কেউ কেউ।
এভাবেই চলে দীর্ঘ দুদিনের ভয়াবহ মদন যুদ্ধ। একটানা লড়ে চলেন মীরাশের মা, এখলাস, কুদ্দুস এবং আলী আকবরসহ অন্যান্য যোদ্ধারা। জান দেব, তবু মাটি ছাড়বো না। এমনই ছিল তাদের দুর্দমনীয় মনোভাব।
মিরাশের মা ও তার এই ছোট দলের কাছে পাকবাহিনী এত ক্ষতির সম্মুখীন হয় যে পরদিন তারা হেলিকপ্টারনহ আক্রমণ চালায় এই দলটির উপর। সেই সাথে তুলে নিয়ে যায় আহতদের। কখনো বুঝতেও পারেনি এত ছোট একটি দলের বিরুদ্ধে লড়ছে তারা।
এই ছিল আমাদের মিরাশের মার দেশপ্রেম; আমাদের যোদ্ধাদের দেশভক্তি। বারবারই তারা প্রমাণ করেছে, উন্নত অস্ত্র বা প্রশিক্ষণ নয়, অস্ত্রের পেছনে দাঁড়ানো মানুষটির সাহস এবং দেশপ্রেমের উপরই নির্ভর করে যুদ্ধের ফলাফল।
যুদ্ধের পর এই এলাকায় পাকিস্তানিদের ৪১টি কবর পাওয়া যায়। মানুষ এতই ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল পাকিস্তানিদের যে, তারা পরবর্তীতে কবর থেকে এই লাশগুলো তুলে নদীতে ফেলে দেয়। স্বাধীন বাংলায় পাকিস্তানিদের ঠাঁই নেই।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা পুরুষ যোদ্ধাদের সম্মান দেই, শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু আমাদের স্মৃতির অতলে তলিয়ে যান মিরাশী বেগম বা মিরাশের মায়েরা। মিরাশের মা কিংবা ইলা মিত্রদের আমরা মনে রাখি না; ভুলে যাই খুব সহজেই। এটাই হয় তো মেয়েদের নিয়তি।