ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৫, এপ্রিল ২০২৪ ৫:১২:৩৭ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

লড়াকু এক সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ইলা দাস

অনু সরকার

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৪:১২ পিএম, ২১ মার্চ ২০২১ রবিবার

লড়াকু এক সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ইলা দাস

লড়াকু এক সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ইলা দাস

মুক্তিযুদ্ধে অনেক নারী সশস্ত্র অভিযানে অংশগ্রহণ করেন।  কেউ শহীদ হন, কেউ প্রাণ নিয়ে শেষ পর্যন্ত বিজয়ীর বেশে ফিরতে পেরেছেন।  তাদের সকলের কাহিনি আমরা জানি না। পুরুষ যোদ্ধার কথা যেভাবে উঠে আসে সেভাবে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনি জানা যায় না।  জীবনভর তাদের অবদান অজানাই থেকে যায়। তাদের স্বীকৃতি দিতেও কেন যেন জাতি উদার নয়।  এমনই এক স্বীকৃতিহীন বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলা দাস।
নরসিংদী-ভৈরব অঞ্চলে প্রশিক্ষণ নিয়ে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযানে অংশ নেন বীর সাহসী নারী ইলা৷ ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান তিনি। পরদিন গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়।
ঢাকার সূত্রাপুরে সাহসী নারী ইলা দাসের জন্ম৷ বাবা হরলাল দাস ও মা নির্মলা দাস৷ ১৯৭০ সালে তৎকালীন নারী শিক্ষা মন্দির উচ্চ বিদ্যালয় (বর্তমান শেরে বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়) থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করেন তিনি। ভর্তি হন ইডেন কলেজে৷ একাত্তরে মুক্তযুদ্ধ চলাকালে তিনি ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রী ছিলেন। ছাত্র লীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন ইলা৷ স্বাধিকার আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন সব সময়৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের সময় রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) উপস্থিত ছিলেন৷ ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম বাঙালি নিধনযজ্ঞ শুরু হলে গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে চলে যান তিনি। সেখানে স্থানীয়ভাবে গঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের দলে যোগ দেন৷ অস্ত্র হাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা৷
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকসেনাদের অভিযান ঠেকাতে নরসিংদীর রায়পুরার চরসুবুদদি গ্রামের একটি সেতু উড়িয়ে দিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধারা৷ এতে পাকসেনারা ইলাদের চরসুবুদদি গ্রামসহ আরও কয়েকটি গ্রামের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়৷ এসময় একজন পাকসেনা দলছুট হয়ে ইলাদের হাতে ধরা পড়ে৷ পরে ওই পাকসেনাকে গ্রামের ১২-১৪ জন মেয়ে মিলে ধান-চাল ভাঙার ‘গাইলচা' দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেন৷ আর এর নেতৃত্ব দেন ইলা নিজে। এ ঘটনাটি ইলা দাসকে যুদ্ধে যেতে আরো বেশি উৎসাহিত করে৷
একাত্তরে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে সুসজ্জিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন ছাত্রলীগ নেত্রী ইলা দাস। ইলাসহ তার অন্যান্য সঙ্গিদের অস্ত্র চালানো, গ্রেনেড ছোড়াসহ নানা রকম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন দলনেতা গয়েশ আলী মাস্টার৷ ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে পাহাড়িয়া অঞ্চলে প্রশিক্ষণ নিতেন তারা৷ চারদিকে পাহাড় ঘেরা এবং মাঝখানে কিছুটা সমতল ভূমিতে তাদের প্রশিক্ষণ হতো৷ এসময় সাবানির মা নামে পরিচিত এক নারী মহাসড়কের পাশে পাতা কুড়ানোর ছলে তাদের পাহারায় থাকতেন৷ মহাসড়কে পাকসেনাদের আসার খবর ইলাদের কাছে পৌঁছে দেয়া ছিলো এই নারীর কাজ৷ তার খবরের ভিত্তিতে ইলারা পাকিস্তানিদের ট্যাংক লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়ে মারতেন। মহাসড়কে মাইন পুঁতে রাখতেন।
প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে তিন নম্বর সেক্টরের অধীনে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন ইলা দাস৷ তাদের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল শফিউল্লাহ৷ নরসিংদী মহাসড়ক দিয়ে যখন পাকসেনারা যেতো তখন পাহাড়ের ঢালে ও গাছের আড়ালে থেকে তাদের উপর অভিযান চালাতেন ইলারা৷ নরসিংদীর যোশর এলাকা, আশুগঞ্জ সার কারখানা, ভৈরব অঞ্চলে অভিযান চালিয়েছিলেন ইলা ও তার সঙ্গিরা৷
যুদ্ধচলাকালে একবার পাকসেনাদের কবলে পড়েও অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যান সাহসী যোদ্ধা ইলা দাস৷ যুদ্ধের সময় তিনি নরসিংদীর বটতলা গ্রামে একটি বাড়িতে মাঝে মাঝে গিয়ে আশ্রয় নিতেন৷ একদিন রাতে সেই বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি৷ শেষ রাতের দিকে গ্রামে রাজাকারসহ পাকসেনাদের অভিযানের খবর আসে৷ শোনা যায় গ্রামের সব বাড়িতে ঢুকে ঢুকে যুবকদের ধরে নিয়ে একটি বাড়িতে আটকে রাখছে পাকবাহিনী৷ এক পর্যায়ে ইলা দাস যে বাড়িতে ছিলেন সেখানেও তারা চলে আসে৷ লাথি দিয়ে দরজা ভেঙে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে পাকসেনারা৷ ইলা পাকসেনাদের দেখেই পেছনের দরজা দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যান। উঁচু একটি পাঁচিল টপকে বাঁশ বাগানের ভেতর চলে যান তিনি৷ বাগান পেড়িয়েই মধুবিল৷ আর কোনো পথ নেই। তার সামনে দীর্ঘ মধুবিল আর পেছনে ধাওয়া করা পাকসেনার দল। আর কোনো উপায় নেই! ইলা সাঁতার জানতেন না। তবুও প্রাণ বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন সেই বিলের পানিতে৷ এ সময় তাকে তাক করে গুলি চালায় পাকসেনারা৷ কিন্তু ইলা বেশ কিছুক্ষণ শ্বাস বন্ধ করে জলের নিচে ডুব দিয়ে থাকেন। তাই তারা তাকে ঠিকমতো টার্গেট করতে পারেনি৷ এদিকে, তাকে ডুবে যেতে দেখে বিলের অপর পাড় থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এসে উদ্ধার করে নিয়ে যায়৷
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাথে কাজ করেন ইলা দাস৷ ২০১০ সালে জাতীয় মহিলা সংস্থার উদ্যোগে এগারো জন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়৷ তাদের মধ্যে অন্যতম ইলা দাস৷ আর এতটুকুই তার প্রাপ্তি।