ঢাকা, বুধবার ২৪, এপ্রিল ২০২৪ ১২:২৩:২৯ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

মুক্তিযোদ্ধা হেলেন চর থেকে চরে ছুটেছেন হানাদারের তথ্যের সন্ধানে

অনু সরকার

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১০:১৮ পিএম, ৪ এপ্রিল ২০২১ রবিবার

বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা হেলেন করিম৷ ছবি সংগৃহীত।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা হেলেন করিম৷ ছবি সংগৃহীত।

মাত্র তিন মাসের ছোট্ট শিশুকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন মির্জা হেলেন করিম৷ নানা কৌশলে পাকসেনা এবং রাজাকারদের উপর হামলা চালাতে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করেন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে৷ টাঙ্গাইলের চর থেকে চরে ছুটে গেছেন হানাদারদের গোপন তথ্য সংগ্রহ করতে। গোলা-বারুদ আর বুলেটকে উপেক্ষা করে এগিয়ে গেছেন বীরদর্পে।  

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর সময় বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রী ছিলেন তিনি৷ কলেজ জীবন থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সক্রিয়ভাবে কাজ করতেন৷ তবে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর মহিলা পরিষদের সাথে কাজ শুরু করেন৷

১৯৫৮ সালে টাঙ্গাইলে সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম মির্জা হেলেন করিমের৷ তার বাবা মির্জা শুকুর আহমেদ এবং মা আনোয়ারা খাতুন৷ টাঙ্গাইলে জন্ম হলেও বাবার চাকুরির সুবাদে ঢাকাতেই বড় হয়েছেন এবং বসবাস করছেন হেলেন৷  

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ তাকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করে৷ এরপর টাঙ্গাইলে যুদ্ধের জন্য স্বেচ্ছাসেবী দল তৈরির ডাক আসলে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল চলে যান তিনি৷

নিজের তিন মাসের ছেলেকে বাড়িতে রেখে অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ নেন হেলেন৷ টাঙ্গাইলের গয়লাহোসেন চরে এপ্রিলের শেষের দিকে প্রশিক্ষণ শুরু করেন তিনি৷ সেখানে ছেলেদের পাশাপাশি পাঁচজন মেয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন৷ যুদ্ধের নয় মাস টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হেলেন৷

প্রথমদিকে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বন্দুক নিয়ে চর অঞ্চল এবং নদীর তীরবর্তী এলাকায় সতর্ক পাহারা দিতেন তারা৷ পাকসেনা এবং রাজাকারদের গতিবিধি লক্ষ্য করতেন৷ এর মধ্যে রাজাকাররা জানতে পারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসব নারী যোদ্ধাদের তথ্য৷ ফলে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানায় অবস্থিত পাকসেনাদের ঘাঁটি থেকে আট-দশটা গানবোট নিয়ে এসে ওই চর এলাকা ঘিরে ফেলে একদিন৷ সেদিন আত্মরক্ষার জন্য পুরুষ যোদ্ধাদের সাথে ফায়ার করতে করতে নারী যোদ্ধারাও এলাকা থেকে সরে পড়েন৷

কিন্তু এ সময় মনোয়ারা নামের এক নারী যোদ্ধা পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে এবং ধর্ষিত হন৷ এই ঘটনার পর কোম্পানি কমান্ডার ইদ্রিস আলী নতুন করে মেয়েদের নিরাপত্তার কথা ভাবেন। তিনি মেয়েদের কাছ থেকে বন্দুকগুলো ফিরিয়ে নেন এবং তাদের অন্যভাবে কাজে লাগানোর জন্য ভাবতে শুরু করেন৷ শুধুমাত্র হেলেনের উপর দায়িত্ব পড়ে সিরাজগঞ্জ এবং টাঙ্গাইলের চর অঞ্চলে গ্রেনেড পারাপার করার৷

এসময় ওই অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনা এবং রাজাকারদের অবস্থান ও পরিকল্পনা জানার জন্য গোয়েন্দাগিরির কাজ শুরু করেন হেলেন করিম৷ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাঁড়ির ভেতর গ্রেনেড ভর্তি করে তার উপর ডিম সাজিয়ে নিয়ে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পৌঁছে দিতেন তিনি৷ একদিন গরীব গ্রাম্য মেয়ের ছদ্মবেশে নৌকায় করে পাকসেনা এবং রাজাকারদের সাথে এক নৌকায় গ্রেনেড নিয়ে নদী পাড় হয়েছেন হেলেন৷ শত্রুরা তার পরিচয় এবং গন্তব্য জানতে চাইলে তাদের নানা কৌশলে উত্তর দিয়ে সফলভাবে লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন এই সাহসী যোদ্ধা৷

এক সাক্ষাৎকারে সে সময়ের দুঃসাহসী ঘটনার কথা জানান হেলেন করিম৷

তিনি বলেন, নৌকায় রাজাকাররা আমাকে জিজ্ঞেস করতো ডিমের হালি কতো৷ আমি সাহস করে উত্তর দিতাম৷ তখন জিজ্ঞেস করতো, ওপারে তোমার কে থাকে? আমি বলতাম, আমার স্বামী থাকে৷ তখন তারা বলতো, ও সেজন্যই যাচ্ছো৷ আমি বলতাম, হ্যাঁ৷ তখন তারা আর কিছু বলতো না৷

তিনি আরও বলেন, একদিন দুইজন পাকসেনা আর তিনজন রাজাকার নৌকায় উঠেছে৷ আমিও ওই নৌকায় আছি৷ ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কোথায় নামবে? আমি মুক্তিবাহিনীর ভাইদের আগে বলে দেয়া নির্দিষ্ট জায়গার নামই বললাম। সেখানে না নামলে আমি তো আবার রাস্তা চিনতে পারবো না৷ ফলে তারা আমাকে সেখানে নামানোর জন্য তীরে নৌকা ভিড়ালো৷ যেই আমি নৌকা থেকে নেমে গেছি অমনি সেখানে লুকিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উপর ব্রাশফায়ার করেন৷ তাৎক্ষনাত দুইজন পাকিস্তানি সেনা এবং একজন রাজাকার সেখানেই মারা যায়৷ অন্য দুইজন রাজাকারকে ধরে আনা হয়৷ তারা পরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাজ শুরু করে৷

একাত্তরের উত্তাল সময়গুলোতে দিনের পর দিন এভাবে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় ঘুরে ঘুরে শত্রুপক্ষের খবর এনে দিতেন বীর নারী হেলেন৷ তার তথ্যের উপর ভিত্তি করে মুক্তিযোদ্ধারা সফল অভিযান চালাতেন৷ যুদ্ধের শেষের দিকে হেলেন করিমের সংকেত অনুসরণ করে বেলকুচি থানার শক্ত ঘাঁটিতে হামলা চালান মুক্তিবাহিনী৷ সেদিন ৫ থেকে ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়৷ আনোয়ার নামের একজন সেনা আত্মসমর্পণ করে৷ এই একশানের পর থেকেই ওই অঞ্চল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে৷

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলনের সাথে জড়িত রয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা হেলেন৷ এক সময় তার বাসাতেই গঠিত হয় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী৷ উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি৷ খেলাঘরের সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য৷ মহিলা আওয়ামী লীগের ঢাকা উত্তরের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হেলেন করিম৷