ঢাকা, শুক্রবার ২৯, মার্চ ২০২৪ ২০:১৯:৩৪ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

বিয়ের ক’দিন পর যুদ্ধে চলে যান আমিনা

অনু সরকার

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৮:৫২ পিএম, ৬ এপ্রিল ২০২১ মঙ্গলবার

বিয়ের ক’দিন পর যুদ্ধে চলে যান মুক্তিযোদ্ধা আমিনা

বিয়ের ক’দিন পর যুদ্ধে চলে যান মুক্তিযোদ্ধা আমিনা

বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিনা বেগম। কপালে টিপ, পায়ে আলতা আর লাল শাড়ি পরে নববধূ সেজে উৎসব করার সৌভাগ্য হয়নি তার৷ হাতের মেহেদির রঙ মিলিয়ে না যেতেই বিয়ের মাত্র ১১ দিনের মাথায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন আমিনা বেগম৷

একাত্তরের সেই উত্তাল সময়ে যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকেই  এই নবদম্পতি আর পিছু না ফিরে চলে যান যুদ্ধে।  

সে সময় দেশের পরিস্থিতিই তাদের মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে নেয়৷ তার স্বামীও এ সময়ই যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ভারতে চলে যান৷ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বহুবার বিভিন্ন স্থানে তাদের দেখা হয়েছে৷ কিন্তু এসময় তারা দু'জন অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের মতো দেশের সম্ভ্রম বাঁচাতে এতটাই আন্তরিক ছিলেন যে নিজেদের দিকে নজর দেয়ার সময় ছিল না৷ দীর্ঘ নয়মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে পুরোটা সময় নিজে দায়িত্বে সক্রিয় ছিলেন বীর সাহসী মুক্তিযোদ্ধা আমিনা৷

সিরাজগঞ্জে ১৯৫১ সালের ৩০ নভেম্বর জন্ম আমিনার৷ বাবা ডা. আনিসুর রহমান এবং মায়ের নাম জাকেরা বেগম৷

কলেজ জীবনের শুরু থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন আমিনা৷ ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে তৎকালীন সিরাজগঞ্জ মহকুমার বিভিন্ন স্থানে কাজ করেছেন৷ সেসময় সিরাজগঞ্জ কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন তিনি৷ পরে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন৷ ফলে হঠাৎ করে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েননি, মুক্তিযুদ্ধের জন্য একটি পটভূমি তৈরির কাজেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন আমিনা৷ সেই বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের জন্য সকলকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি৷

১৯৭১ সালের উত্তাল ১৪ মার্চ তৎকালীন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক বকুলের সাথে বিয়ে হয় আমিনার৷ বিয়ের ১১ দিনের মাথায় পঁচিশে মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উচ্চারিত শব্দমালা শুনে তাড়িত হন এই নবদম্পতি৷ নতুন সংসারের হাতছানি দূরে ঠেলে দুজনে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন৷ মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন।

মুক্তিযুদ্ধে নিজের সাহসী ভূমিকার কথা তুলে ধরেন আমিনা বেগম বলেন, ‘সিরাজগঞ্জের প্রায় ২০০ মুক্তিযোদ্ধা এবং পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের প্রায় দেড় হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে অস্ত্র সরবরাহের জন্য নির্দেশ আসে৷ সিদ্ধান্ত হয়, মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল নৌকা করে যমুনা নদী পাড় হয়ে ভারতের শিলিগুড়ির পাঙ্গা চর থেকে অস্ত্র কিনে আনবে৷ সিদ্ধান্তমত আমেনা বেগম, তার স্বামী ও অন্য কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা চারটি নৌকা নিয়ে মাইনকারচরের উদ্দেশ্যে রওনা করেন৷ এর মধ্যে একটি নৌকার আরোহী আমিনা একা ছিলেন৷ মাঝপথে যাত্রীবোঝাই একটি নৌকায় তার সাথে দেখা মেলে তার শিক্ষয়িত্রী জ্যোৎস্না দিদি ও তার দেড় বছরের শিশুকন্যা সঞ্চিতার সঙ্গে৷ নানা দিক ভেবে আমিনা এ দুজনকে নৌকায় তুলে নেন৷ এর কিছুক্ষণ পরই পাকিস্তানি দুটি গানবোট তাদের পিছু ধাওয়া করে৷
এক পর্যায়ে আরেকটি নৌকায় থাকা আমিনার স্বামী তাকে অস্ত্র সরবরাহকারীদের নাম-ঠিকানা দিয়ে নদীর পাড়ে নামিয়ে দেন৷ চুক্তি হয়, প্রয়োজন হলে তিনি গ্রেনেড হামলা চালাবেন পাকিস্তানি গানবোটের ওপর। আর এই ফাঁকে আমিনা ও জ্যোৎস্না যেকোনো মূল্যে অস্ত্র আনতে ভারতের শিলিগুড়ি চলে যাবে৷ দীর্ঘ পথ দৌড়াতে দৌড়াতে তারা একটি গ্রামে এসে পৌঁছান৷ উত্তেজনার পাশাপাশি ক্ষুধা-তৃষ্ণায় তখন কাতর হয়ে পরেছেন দুজনের৷ দীর্ঘ সময় পর একটি কিশোরী গৃহবধূ তাদের কিছু মুড়ি ও পানি খেতে দেয়৷ সন্ধ্যায় তোরা নৌকাঘাটে এসে দেখেন তার স্বামী বকুল উৎকণ্ঠিত হয়ে তাদের ফেরার অপেক্ষা করছে৷ বকুল তাদের জানান, পাকসেনাদের গানবোট দুটি খুব কাছে এলেও পরিত্যক্ত নৌকা ভেবে ফিরে গেছে৷ পরে গভীর রাতে তারা মাইনকারচরে পৌঁছান৷

পরদিন সড়কপথে তারা জলপাইগুড়ির পাঙ্গা চরে যান৷ পরে তারা ট্রাকে করে সেখান থেকে ৪০০ রাইফেল, ৪০ হাজার গোলাবারুদ, ১০ ব্যাগ বিস্ফোরক, চারটি আরসিএল এবং কিছু গ্রেনেড নিয়ে আসেন৷ মাইনকারচর থেকে অস্ত্রগুলো তারা তিনটি নৌকা বোঝাই করে সিরাজগঞ্জে নিয়ে আসেন। সেসব অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বণ্টন করেন৷

এরপর রৌমারি ইয়ুথ ক্যাম্পে সিরাজগঞ্জের বেশ কয়েকটি মুক্তিযোদ্ধা দলের হয়ে যোগাযোগ এবং অস্ত্র সরবরাহের কাজ করেছেন আমিনা বেগম৷ অক্টোবর মাসে শিলিগুড়ির পাঙ্গা চর থেকে আরো এক চালান অস্ত্র মাইনকারচরে এসে পৌঁছায়৷ এ সময় বেশ কিছু অস্ত্র নৌকাযোগে সিরাজগঞ্জে পাঠানো হয়৷

এর কিছুদিন পরই আমিনার উপর দায়িত্ব পড়ে, আরো কিছু অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে৷ কিন্তু অস্ত্র নিয়ে নৌকায় করে সিরাজগঞ্জ শহরের কিছুটা উত্তরে ব্রহ্মগাছায় পৌঁছালে আকস্মিকভাবে পাকিস্তানি বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়৷ এ যুদ্ধে সরাসরি অংশ না নিলেও যুদ্ধের পুরো সময় তিনি ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রের কাছেই৷ এক পর্যায়ে অস্ত্রসহ ফিরে আসেন ক্যাম্পে৷ পরে কাজীপুর উপজেলার নাটুয়ারচরে গিয়ে অস্ত্র ও গ্রেনেডগুলো মাটিতে পুঁতে রাখেন৷ নির্দেশ ছিল, বিশেষ প্রয়োজনে নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে অস্ত্রগুলো সরবরাহ করতে হবে৷ সেমতই কাজ করেন আমিনা বেগম।

স্বাধীনতার পর উপজেলা নারী ও শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবে পেশাগত ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন আমিনা৷ ২০০৮ সালে অবসর গ্রহণ করে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা৷