ঢাকা, বুধবার ২৪, এপ্রিল ২০২৪ ২০:২৯:৩৫ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

জীবন বাজি রেখে সম্মুখযুদ্ধ করেন মুক্তিযোদ্ধা সালেহা

অনু সরকার

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১০:৪৩ পিএম, ৭ এপ্রিল ২০২১ বুধবার

জীবন বাজি রেখে সম্মুখযুদ্ধ করেন মুক্তিযোদ্ধা সালেহা বেগম

জীবন বাজি রেখে সম্মুখযুদ্ধ করেন মুক্তিযোদ্ধা সালেহা বেগম

অস্ত্র লুট, বোমা বানানো, বোমা পরীক্ষা থেকে শুরু করে সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধ করেছেন যশোরের বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট সালেহা বেগম৷ মাতৃভূমির মুক্তির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সালেহা নিজেকে তৈরি করেন একজন সৈনিক হিসেবে৷

সালেহা বেগমের বাবা মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার৷ মা মমতাজ আরা বেগম৷ জন্ম ১৯৫৩ সালের ৪ মার্চ ৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় যশোর মহিলা কলেজে স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্রী সালেহা ছিলেন৷

ছাত্র জীবন থেকেই বাম ধারার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন সালেহা। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই ১৯৬৯ সালে নিউক্লিয়াস নামে একটি সংগঠন হয়। এই সংগঠনের সদস্য ছিলেন সালেহা৷ নিউক্লিয়াসের উদ্দেশ্য ছিল দেশ স্বাধীন করা৷ সমাজতান্ত্রিক শোষণমুক্ত সাম্রাজ্যবাদমুক্ত একটা দেশ গড়া৷ আর এই মনোভাব নিয়েই সালেহাসহ এ সংগঠনের সদস্যরা সংগঠিত হতে থাকেন৷ গড়ে তোলেন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র৷

১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়৷ সেখানে প্রায় ২০০ ছেলে এবং পাঁচজন মেয়েকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়৷ এই প্রশিক্ষণের মধ্যে ছিল অস্ত্র চালনা, বোমা তৈরি, বোমা নিষ্ক্রিয় করা প্রভৃতি৷

এরপর ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ কালরাতে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নিরস্ত্র-নিরীহ বাঙালির ওপর পাকসেনারা অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঠিক এসময় দেশকে বাঁচাতে নিজের জীবন বাজি রেখে সরাসরি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন সালেহা এবং তার দল৷

যশোরের বিভিন্ন জায়গায় সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন সালেহা৷ কিছু দিন পর ওয়ারলেস এবং গেরিলা হামলার মতো আরো উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে চলে যান৷ ভারতের দত্তফুলিয়া এবং এপারে মহেশপুর অঞ্চলে দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন তিনি৷

এক একান্ত সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধের কিছু ঘটনার কথা জানান সালেহা বেগম৷

তিনি বলেন, ‘আমি একদিন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি৷ এটা ছিল যশোরের বাহাদুরপুর অঞ্চল৷ প্রায় সব প্রস্তুতি শেষ৷ বাহিনীর অন্যান্য সবাই বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে একত্রিত হয়৷ এসময় আমার কাছে ছোট্ট একটা চিরকুট আসে৷ এতে লেখা, ‘আমরা না বলা পর্যন্ত আপনি বেরুবেন না’৷ এটা থানা কমান্ড থেকে আমার কাছে নির্দেশ হিসেবে পাঠানো হয়৷ ফলে আমি ভাবলাম, এটা আমার মেনে চলা উচিত৷ হয়তো মারাত্মক কোন ঘটনা ঘটেছে৷ আমি আর সেখানে গেলাম না৷’

তিনি আরও বলেন, পরে জানতে পারি, সেখানে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা ছেলেরা পাকসেনারা চারপাশ দিয়ে ঘেরাও করে ফেলেছিলো৷ প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়৷ আমাদের মাত্র ৫/৬ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল৷ অথচ তারা কেউ পিছু হটেনি৷ তাদের কি অদম্য দেশপ্রেম! নিজেদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তারা পাকসেনাদের সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে যান৷ আমি সেখানে গেলে আমিও সেদিন মারা যেতাম৷ সেজন্যই আমাকে চিরকুট পাঠানো হয়েছিল৷’

নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে অনেকগুলো সম্মুখযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন সালেহা বেগম৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাকসেনাদের গুলি করে মেরেছেন৷ খুব কাছে থেকে পাকসেনাদের উপর হামলা চালিয়েছেন৷ তবে পাকসেনাদের ধরে আনার ঘটনা ঘটেছে মাত্র একবারই৷ অন্যান্য সময় পাকসেনারা নিহত হলেও তারা নিহত সেনাদের লাশ নিয়ে পালিয়ে যেতো৷ ফলে পাকসেনাদের লাশ পাওয়া যেতো না, বলে জানান এই বীর মুক্তিযোদ্ধা৷

গুপ্ত হামলা, গোয়েন্দাগিরি কিংবা অস্ত্র সরবরাহের কাজও করেছেন এই বীর নারী।

আরেকদিনের এক ভয়ংকর ঘটনার কথা জানিয়ে সালেহা বেগম বলেন, ‘প্রথমদিকের ঘটনা এটি৷ আমরা প্রশিক্ষণ নিলেও সবাইতো আর এক রকমভাবে প্রশিক্ষিত কিংবা যুদ্ধে অভিজ্ঞ ছিলাম না৷ এ অবস্থায় একদিন বারান্দিপাড়ায় আমরা যুদ্ধের জন্য অবস্থান নিয়েছি৷ নিজেদের অবস্থানের জন্য প্রয়োজন মতো মাটি খুঁড়ে ট্রেঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল৷ সেসব ট্রেঞ্চে শুয়ে সেখান থেকে গুলি করতে হবে৷ তবে সবাই ট্রেঞ্চে অবস্থান নিতে না পারায়, অনেকে যে যেখানে জায়গা পেয়েছে শুয়ে অবস্থান নিয়েছে৷ গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে৷ সামনে পাকসেনাদের লক্ষ্য করে আমরা গুলি ছুঁড়ছি৷ কিন্তু হঠাৎ করে দেখা গেল পেছন থেকে কয়েকটি গুলি আসল৷ আমাদের একেবারে কানের পাশ দিয়ে চলে গেল৷ তবে ভাগ্যিস হেলমেট পরা ছিলাম৷ ফলে আমরা কেউ আহত হইনি৷ কিন্তু আমরা তো সবাই হতবাক৷ পাকসেনারা তো সামনে আছে৷ পেছনে তো পাকসেনা নেই৷ তাহলে গুলি আসল কোথা থেকে? পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পেছন থেকে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদেরই কেউ গুলি ছুঁড়েছে৷ বিষয়টা বোঝার সাথে সাথে তাদের থামানো হলো৷ অবশ্য পরে আর এমন ঘটনা ঘটেনি৷'