ঢাকা, শুক্রবার ২৬, এপ্রিল ২০২৪ ১২:২৭:০১ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

বীর মুক্তিযোদ্ধা ফরিদা খানম সাকি

অনু সরকার

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৯:৪০ পিএম, ১০ এপ্রিল ২০২১ শনিবার

বীর মুক্তিযোদ্ধা ফরিদা খানম সাকি।  ছবি-সংগৃহীত।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ফরিদা খানম সাকি। ছবি-সংগৃহীত।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ফরিদা খানম সাকি। একাত্তরের উত্তাল সময়ে ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। অংশগ্রহণ করেছেন সমুখযুদ্ধে। শুধু তিনি নন; তার এক ভাই এবং এক বোনও মুক্তিযোদ্ধা। তার মামা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালীর প্রত্যন্ত গ্রাম এবং ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পরে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ-এই তিনটি ধাপ জুড়ে রয়েছে সংগ্রামী নেত্রী সাকীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস৷

১৯৪৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীতে জন্ম ফরিদা খানম সাকীর৷ মা লুৎফুন নাহার বেগম এবং বাবা আবদুল আলীম৷

সাকীর নানা উকিল সেকান্দার মিয়া নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন৷ মামা শাহাব উদ্দিন ইস্কান্দার কচি এমসিএ ছিলেন৷ মামীও ছিলেন সাংসদ৷ এমন রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হওয়ায় ছোট্ট থেকেই আন্দোলন আর সংগ্রামের ছোঁয়া পেয়েছেন তিনি৷

রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেওয়ার কারণেই সাকি ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখতেন রাজনীতি করার। বঙ্গবন্ধু`র ছয় দফা যখন দেশের মানুষকে নতুন প্রেরণায় উজ্জ্বীবীত করে তখন থেকেই নোয়াখালীর মিটিং, মিছিলে বিচরণ শুরু করেন এই সাহসী নারী।

১৯৬৫ সালে নোয়াখালী কলেজে ভর্তির পর থেকেই ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত হয়ে পরেন৷ '৬৯ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়তেন বাংলা বিভাগে, থাকতেন রোকেয়া হলে। বঙ্গবন্ধুর স্নেহ পাওয়া ফরিদা খানম সাকির ছাত্ররাজনীতির স্মৃতি মানেই ছয়দফা, গণঅভ্যুথান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সহপাঠী হিসেবে পেয়েছেন শেখ হাসিনাকে (আজকের প্রধানমন্ত্রী)।

১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচারে তিনি ছিলেন তখনকার ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে নোয়াখালীর এমন কোন বাড়ি নেই যেখানে তিনি নৌকা`র পক্ষে গণসংযোগ চালাননি। সেই থেকেই দেশের প্রতিটি আন্দোলনে মিছিল মিটিংয়ে সরব উপস্থিতি ফরিদার৷ তখন থেকেই যুদ্ধের জন্য মানসিক প্রস্তুতি শুরু৷

১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের উদ্যোগে আয়োজিত যুদ্ধের প্রশিক্ষণে অংশ নেন৷ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীর চর্চা কেন্দ্রে৷ মার্চের উত্তাল দিনগুলোতেও আন্দোলনে সক্রিয়তার স্বার্থেই বাড়িতে না থেকে রোকেয়া হলে অবস্থান করতেন ফরিদা এবং তার সহকর্মীরা৷

২৫ মার্চ সেই কালরাতে পাকিস্তানি সেনারা যখন রোকেয়া হল আক্রমণ করে, তখন তারা আশ্রয় নেন হাউস টিউটরের বাসায়৷ সেই কালরাতে তিনিসহ সাতজন মেয়ে অনেকটা অলৌকিক ভাবে হানাদারদের বুলেট থেকে বেঁচে যান। কিন্তু নোয়াখালীতে তার পরিবার ভেবেছিলো, সাকি আর বেঁচে নেই। তিনি জীবিত আছেন এ খবর নিশ্চিত হতে তাদের সময় লেগেছিল এক সপ্তাহ।

সে সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ফরিদা খানম সাকি বলেন, ‘২৫ মার্চের রাতে রোকেয়া হলের হাউস টিউটর সায়রা বেগম আমাদের সাত-আটজন মেয়েকে স্টোররুমে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তা না হলে সেদিন আমাদের অবস্থাও অন্যান্য হলের ছাত্রদের মতো হতো’।

তিনি আরও বলেন, ‘২৭ মার্চ কিছু সময়ের জন্য সান্ধ্য আইন শিথিল করা হয়। এ সময় ছাত্রলীগের নেতারা রোকেয়া হলে আমাদের খোঁজে যান৷ তাদের ধারণা ছিল, আমরা হয়তো কেউ বেঁচে নেই৷ কিন্তু পথেই তাদের সঙ্গে দেখা হলে সবাই খুব অবাক হন৷’

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ফরিদা খানম সাকি ঢাকা শহরে বিভিন্ন আত্মীয়ের বাসায় লুকিয়ে ছিলেন। পরে নিজ এলাকা নোয়াখালীর মাইজদীতে চলে যান। এপ্রিলের শুরু থেকে নোয়াখালীতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করতে থাকেন সাকী৷ শহর থেকে যেসব মানুষ প্রাণ বাঁচাতে গ্রামে ফিরে যাচ্ছিল তাদের সেবায় জড়িয়ে পড়েন। তাদের খাওয়ানো, তাদের জন্য পোশাক সংগ্রহসহ নানা কাজে নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য ভারত পাঠাতেন৷ তাদের জন্য টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড় সংগ্রহ করতেন ফরিদা এবং তার সহযোগীরা৷

পাকবাহিনী এপ্রিলের শেষে মাইজদীতে প্রবেশ করে৷ প্রথমেই ফরিদার নানাবাড়ি পুড়িয়ে দেয় হানাদাররা৷ সেখানে থাকতে না পেরে নানার গ্রামের বাড়ি কাদিরপুরে চলে যান৷ সেটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি৷ ফরিদার কাজ ছিল খবরাখবর আদান প্রদান করা৷

এরমধ্যে একদিন স্থানীয় রাজাকারদের প্ররোচনায় তার মামা সাহাবুদ্দিন এসকান্দর ভুলুকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে যায় এবং হত্যা করে।এরপর রাজাকারদের অত্যাচারে আর সেখানে থাকতে পারেননি তিনি৷

এরপরই আসম আব্দুর রব-এর চিঠি পান। চিঠির নির্দেশনা অনুযায়ী ছোট বোন শিরিন জাহান দিলরুবা এবং ছোট ভাই তাহের জামিলকে নিয়ে ভারত রওনা হন৷ ফেনীর বিলোনিয়া হয়ে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে আগরতলা পৌঁছান৷   

পরে সাকি তার এক বোন ও ভাইসহ লেম্বুছড়া শিবিরে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি নিখুঁতভাবে স্টেনগান চালানো আয়ত্ব করেন। পরবর্তীতে সেনবাগ গেরিলা যুদ্ধে তা ভাল কাজ দেয়।

প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অপারেশনে যেতেন তিনি৷ ফরিদা এবং অন্যান্য নারী কর্মীদের কাজ ছিল রেকি করা৷ রেকি করে খবর নিতেন৷ এসব তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছাতেন৷

এরপর সাকী সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন আগস্টের শেষ দিকে৷ সম্মুখযুদ্ধের একটি ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমরা সেনবাগের কাছে গিয়েছিলাম৷ ঠিক সন্ধ্যায় সেনবাগের কাছাকাছি আসার পর পাকসেনাদের মুখোমুখি পড়ে যাই৷ তারাই আমাদের ওপর প্রথম গুলি ছোঁড়ে৷ আমরা সবাই মাটিতে শুয়ে পড়ি৷ গোলাগুলি শুরু হয়৷ আমি আর আমার বোন একের পর এক গ্রেনেড ছুঁড়ে মারতে থাকি৷ ওই যুদ্ধে আটজন পাকিস্তানি সেনা ও চারজন রাজাকার প্রাণ হারায়৷ বাকিরা পালিয়ে যায়৷ তাদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রগুলো আমরা কুড়িয়ে নিই৷'

এই বীর যোদ্ধা দেশ স্বাধীনের পর নারী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ মহিলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ৷ এ সংসদের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন তিনি৷ এছাড়া জাতীয় মহিলা সংস্থার পরিচালনা পরিষদের ও মহিলা সমিতির কার্যকরী পরিষদের সদস্য এই বীর মুক্তিযোদ্ধা৷

ফরিদা খানম সাকির বিয়ে হয় রাজনৈতিক পরিবারে। তার স্বামী মাহমুদুর রহমান বেলায়েত দু`বার সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথমবার ১৯৭৩ সালে দ্বিতীয়বার ১৯৮৬ সালে। বঙ্গবন্ধু`র সরাসরি স্নেহ পাওয়া মাহমুদুর রহমান বেলায়েত নোয়াখালী জেলায় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেকে ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ছিলেন নোয়াখালী জেলা মুজিব বাহিনীর প্রধান। চৌমুহনী এসএ কলেজের সাবেক ভিপি ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগেরসহ সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মাহমুদুর রহমান বেলায়েত নোয়াখালী জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

রাজনীতি করতে গিয়ে জীবনে নানা চড়াই উৎরাই পার হয়েছেন। মাঠ ঘাট চষে বেড়িয়েছেন। চুয়ান্ন বছরের রাজনীতিতে  স্বীকৃতি হিসেবে এই প্রথম একাদশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য হলেন। এমন অবস্থায় কী ভাবছেন জানতে চাইলে ফরিদা খানম সাকি জানান, নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে তেমনভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি কখনোই৷ অথচ নারী মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মূল্যায়ন জরুরী।