ঢাকা, শুক্রবার ২৯, মার্চ ২০২৪ ৭:১৯:০৪ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

সাহিত্যের নতুন দিগন্ত নির্মান করতে হবে তরুণ লেখকদের: ফারুক নওয়াজ

আহমাদ স্বাধীন

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৬:০৩ পিএম, ১১ জুন ২০২১ শুক্রবার

ফারুক নওয়াজ।  ছবি: নেট থেকে।

ফারুক নওয়াজ। ছবি: নেট থেকে।

দেশের স্বনামধন্য শিশুসাহিত্যিক ফারুক নওয়াজ। ছোট-বড় সকল পাঠকের জন্য লিখে চলেছেন অবিরাম। তিনি প্রকৃতির কবি, নিসর্গের কবি। সব্যসাচি এই লেখক একাধারে ছড়াকার, কবি, গল্পকার, উপন্যাসিক এবং প্রবন্ধকার। সম্প্রতি তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন উইমেননিউজ২৪.কম-এর অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ছোটদের প্রিয় পত্রিকা ‘কিশোর লেখা’র। নানা কথা বলেছেন, শিশুসাহিত্য এবং নিজের লেখালেখি নিয়ে। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ছড়াকার আহমাদ স্বাধীন। 

আহমাদ স্বাধীন: কেমন আছেন?

ফারুক নওয়াজ: ভালো আছি। তোমরা ভালো আছো তো?

আহমাদ স্বাধীন: জ্বী ভালো আছি। প্রথমেই জানতে চাইবো আপনার লেখালেখির বিষয় নির্বাচন নিয়ে। সাহিত্যের নানা শাখা থাকলেও শিশুসাহিত্যেই কেন নিজেকে স্থির করে নিলেন। আপনার ভাবনায় শিশুসাহিত্যের বিশেষ বৈশিষ্ট কী?

ফারুক নওয়াজ: বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সব দেশের লেখকেরাই লেখালেখির শুরুতে কবিতা দিয়ে শুরু করেন। তারপর সময়ের সাথে সাথে সে লেখালেখির বিভিন্ন শাখায় ঘুরে বেড়ায়। এক সময় তার ভালো লাগা একটা জায়গায় স্থির হয়। আমিও তেমনি ছোটদের-বড়দের গল্প কবিতা উপন্যাসের বিভিন্ন রঙিন শাখায় ঘুরে বেড়িয়ে এই শিশুসাহিত্যে আনন্দ পেয়েছি। পেয়েছি নিখাদ ভালোলাগা। তাই এখানেই আমি স্থির হয়েছি।

আহমাদ স্বাধীন: বর্তমান সময়ে শিশুসাহিত্যের কোন দিকটা শিশুদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন আপনি?

ফারুক নওয়াজ: শিশুদের কাছে বিশেষ গ্রহণ যোগ্যতা পায় কল্পনার জগৎ। যেমন ধরো রূপকথার গল্প। শিশুরা রঙিন কল্পনার দুনিয়ায় ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে। সেই সাথে ছড়া কবিতার গ্রহণযোগ্যতাও তাদের কাছে কম নয়। ছড়া-কবিতা আসলে চিরকালিন। প্রতিটা শিশু তার কল্পনার জগতে পাখি হতে চায়, মেঘ হতে চায়। এমন অনেক কিছু হতে চায়। তাই কথাসাহিত্য বা ছড়া-কবিতা যেটাই হোক, সেখানে যদি শিশুর সেই ভালো লাগার উপাদানটা পায়, সেটাই সে গ্রহণ করে।

আহমাদ স্বাধীন: শিশুদের জন্য কোনটা বেশি জরুরী, রূপকথাধর্মী জাদুবাস্তবতা নিয়ে রচিত শিশুসাহিত্য, নাকি সময়ের সাথে যায় এমন মৌলিক ধারার শিশুসাহিত্য?

ফারুক নওয়াজ: আসলে শিশুর বয়সের সাথে ভালো লাগা পরিবর্তন হয়। যখন খুব ছোট, তখন শিশুরা মজার মজার রূপকথা পছন্দ করে। রূপকথার জাদুবাস্তবতা শিশুদের যেমন আনন্দ দেয়, তেমন মন্দ ও ভালোর একটা পার্থক্য বুঝিয়ে দেয়। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে রচিত সাহিত্য ছোটরা সে ভাবে ধরতে পারে না। তা দরকার হয় একটু কিশোর বয়সীদের জন্য। যেখানে তারা জীবনধর্মী গল্প বা সায়েন্সফিকশন পছন্দ করে। এক কথায় দুটোরই দরকার আছে।

আহমাদ স্বাধীন: আপনার রচনায় যে রকম নিসর্গ নিয়ে বর্ণনা পাই তা সমসাময়ীক আর কারো লেখায় ততটা দেখা যায় না। এই বিষয়টা আয়ত্ব করার জন্য আপনি কী করেছেন। এধরনের রচনার জন্য অন্যদের কী করতে বলবেন?

ফারুক নওয়াজ: আমার শৈশব কেটেছে শহরে ও গ্রামে। আমার গ্রাম ছিলো অতুলনীয়। আমাদের বাড়িলাগোয়া ছিলো বিরাট অরণ্য। আমি চিলেকোঠায় বসে ঘুঘুর ডাক শুনতাম। তোমরা যেটাকে ঝাউবন বলো সেটাকে আমাদের গ্রামে ঝাবুক বলে। আমার দেখা বড় চারটি ঝাবুক ছিলো আমাদের বাড়িতেই। রাতে সেখান থেকে শনশন ঝিমঝিম সুরধ্বনী তৈরি হতো। এছাড়াও ছিলো শিরিষ গাছ। শিরিষের ফলগুলো পেকে শুকিয়ে যাওয়ার পর বাতাসে ঝনঝনকরে শব্দ হতো। ওই শব্দ বিমোহিত করতো আমাকে। আমাদের গ্রামে নদী আমার বাড়ির খুব কাছে। ছোট নদীর টলমল করে বয়ে যাওয়া, নদীর জলে রোদের ঝিলমিলে চোখ ধাধানো আলো, আকাশে উড়ে যাওয়া গাঙচিল আমার ভেতরে অসাধারণ এক অনুভুতির জন্ম দিতো। আমাকে বিমুগ্ধ করতো। আমি দেখেছি আমাদের ছাদে জোছনার খেলা। এইসব উপাদান আমার ভেতরে সেই শুরু থেকেই গেঁথে গিয়েছে। যে কারণে আমার লেখায় প্রকৃতি উঠে আসে সবচেয়ে বেশি।

আহমাদ স্বাধীন: কিশোর কবিতা বা ছোটদের কবিতায় অধিকাংশ রচনায় আমরা দেখতে পাই, ফুল, পাখি, চাঁদ, নদী ও প্রকৃতি। এর বাইরে লেখা খুব কম আছে। এই গন্ডি থেকে বের হওয়া জরুরী কী না? অথবা বের হবার উপায় কী? 

ফারুক নওয়াজ: আমাদের প্রাপ্তি কিন্তু অনেক। তবে আমরা আসলে এখনো অনেক কিছু থেকে বের হতে পারিনি। আমাদের পূর্ব প্রজন্ম ২০০ বছরের বৃটিশ স্বৈরশাসন দেখেছে। ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের যে প্রাপ্তি তা আমরা দেখেছি। আমরা দেখেছে জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান শেখ মুজিবুর রহমান এনে দিয়েছেন স্বাধীনতার গৌবরউজ্জল দিন। এই যে আমাদের প্রাপ্তি যা সবচেয়ে বড়। যা অন্য দেশ বা ভাষাভাষিদের নেই। কিন্তু আমরা তা সে ভাবে তুলে ধরতে পারিনি। আমাদের মধ্যে লোভলালসা তৈরি হয়েছে। যে কারণে আমরা নতুন করে তেমন কিছু সৃষ্টি করতে পারিনি। তবুও আমাদের লেখালেখিতে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে। এসেছে ভাষা আন্দেলনের কথা। এই প্রাপ্তিগুলোও কিন্তু কম নয়। কিন্তু এখনও আমাদের আরো অনেক বেশি কাজ করতে হবে। 

আহমাদ স্বাধীন: আমাদের বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলাদা একটা সাহিত্যের শাখা তৈরি হয়েছে যা অন্য কোন ভাষার সাহিত্যে নেই। এ বিষয়ে শিশুদের উপযোগী ভালো মানের রচনা কতটা আছে এবং শিশুদের জন্য এর প্রয়োজনিয়তা কী?

ফারুক নওয়াজ: প্রথমত আমাদের গৌরবউজ্জ্ব ইতিহাস জানার জন্য এর প্রয়োজনিয়তা অবশ্যই আছে। তবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা গল্প অথবা সাহিত্য রচনা সব একই রকম হয়ে যাচ্ছে। সবাই ঘুরে ফিরে এক লেখাই লিখছে, যাকে বলে রিপিটেশন। আমরা ভেতরে ঢুকছি না। আমরা জীবন দেখছি না। আমদের স্বপ্ন জয়ের আকাঙ্খা থাকতে হবে। কল্পনার ভেতর থেকে সবকিছু দেখতে হবে। সেজন্য পড়াশোনা করাটাও জরুরী। পড়াশোনাটারই অনেকের অভাব আছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে গেলো এবং সে ফিরে এলো বীরের বেশে, স্বাধীনতা অর্জন করে। সেখানে দুঃখ-সুখ সব থাকবে। এই গল্প একটা শিশুকে, একটা কিশোরকে বীর করে দেয়। লেখককের নিজস্ব ভাষা ও উপস্থাপনক্ষমতা থাকতে হবে। যা এই শাখায় আমরা সেভাবে খুঁজে পাই না। তবে নতুন অনেকেই আসছেন। লিখছেন। সেখান থেকে আশা করছি আমরা কাউকে না কাউকে খুঁজে পাবো। 

আহমাদ স্বাধীন: আপনার নিজের লেখা আপনার পছন্দের সেরা কয়েকটি বইয়ের নাম বলুন?

ফারুক নওয়াজ: আমার কাছে আমার পছন্দের সেরা বই হচ্ছে, ‘আমার একটা আকাশ ছিলো’। এটি কিশোর কবিতার বই। আর গল্পের বই ‘অন্ধ এক মায়ের গল্প’। আরো অনেক বই আছে যেগুলো আমার প্রিয়। আমি প্রচুর লেখালেখির পরেও ভাবি আমার লেখা হয়তো এখনও হয়ে ওঠেনি। 

আহমাদ স্বাধীন: আপনার পড়েছেন এমন কয়েকটি সেরা বইয়ের নাম বলুন।

ফারুক নওয়াজ: আমাকে টেনেছে দক্ষিনারঞ্জন মিত্রের রূপকথা। আমার ভালো লেগেছে মোহাম্মদনাসির আলি। তারপর সাজেদুল করিমের বই, আহমদ ছফার ওংকার আমার পড়া ভালোলাগার বই। হুমায়ুন আহমেদের দূরে কোথাও। ইমদাদুল হক মিলনের চিতার থাবা, আলী ইমামের দ্বীপের নাম মধুবুনিয়া। কখনো কখনো কিছু তরুণ লেখকের লেখাও ভালো লেগেছে আমার। আমি ভিক্টর হুগোর লামিজারেবল পড়েছি ক্লাস সেভেন-এইটের সময়ে। যা আমাকে পরিচয় করিয়েছে বিশ্বসাহিত্যের সাথে। 

আহমাদ স্বাধীন: আপনার ভাবনায় বাংলা শিশুসাহিত্যের নিবেদিত ও সমৃদ্ধ এই সময়ের কজন শিশুসাহিত্যিকের নাম বলুন। তারা কেন সেরা?

ফারুক নওয়াজ: আমি সেভাবে সেরা কাউকে বলতে পারবো না। কারণ সেরা হওয়ার জন্য একটা সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তার মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে বলা যেতে পারে বাংলা একাডেমি পুরস্কারের কথা। যা সাহিত্যিকের সেরা সার্বিক সাহিত্যের উপর মান নির্ধারণ করার কথা। কিন্তু আমি জানি একদম নতুন একজন লিখছে, যার বয়স হয়নি তাকেও দেয়া হচ্ছে এই পুরস্কার। এটা তো সার্বিক সাহিত্য মূল্যায়ণ হলো না। একজন লেখক তার একটা জীবনের সম্পূর্ণ আয়ুকাল অপেক্ষা করে একটা সেরা লেখার জন্য। তাই আমি এখানে কাউকে সেরা বলবো না, সেটা সময় বলবে। আমার সময়েও অনেক ভালো লিখেছেন অনেকে। আমার চাওয়া সবার ভাবনায় যেন নতুনত্ব থাকে। তবে এ সময়ের অনেক তরুণরা খুব ভালো লিখছে। যা দেখে আমার ভালো লাগে। কিন্তু এখানে আমি বলতে চাই তরুণদের আরো এগিয়ে থাকতে হবে। তাদের স্পর্দ্ধা দেখাতে হবে যে, আমি রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করবো। আমি কাজী নজরুল ইসলামকে অতিক্রম করবো। এই অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা থেকে যখন পর্যন্ত নতুন কিছু সৃষ্টি না হবে তখন পর্যন্ত আমি কাউকে সেরা বলা নয় শুধু, তাকে আলাদাই করতে পারবো না। আমি জানি আহমাদ স্বাধীন ভালো লেখে, সাজিদ মোহন ভালো লেখে। কিন্তু তাদের আলাদা হবার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। 

আহমাদ স্বাধীন: আপনার এখন পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কত?

ফারুক নওয়াজ: আমার প্রকাশিত মোট বইয়ের সংখ্যা ২৬৭ টা। পর্যন্ত নতুন কিছু সৃষ্টি না হবে তখন পর্যন্ত আমি কাউকে সেরা বলা নয় শুধু, তাকে আলাদাই করতে পারবো না। আমি জানি আহমাদ স্বাধীন ভালো লেখে, সাজিদ মোহন ভালো লেখে। কিন্তু তাদের আলাদা হবার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। এই বইগুলোর মধ্যে গদ্যের বই ২০০-ও বেশি। বাকিগুলো ছড়া-কবিতা।

আহমাদ স্বাধীন: তরুণ শিশুসাহিত্যকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন, তারা নিজেদের সাহিত্য রচনায় কীভাবে সমৃদ্ধ করবেন?

ফারুক নওয়াজ: তরুণরা সবাই লিখছে। সেখান থেকে ৫/৭জন সবাইকে অতিক্রম করে বেড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তবে নিজেদের এ জগতে আরও সময় দিতে হবে। সবাই নিজেদের নানা ব্যস্ততায় শুধু ছুটছে আর ছুটছে। এই ছোটাছুটি কমিয়ে প্রচুর পড়তে হবে। তরুণ লেখকদেরই সাহিত্যের নতুন দিগন্ত নির্মান করতে হবে।

আহমাদ স্বাধীন: আইরীন নিয়াজী মান্না ও তার সম্পাদিত ছোটদের পত্রিকা ‘কিশোর লেখা’ নিয়ে কিছু বলুন।

ফারুক নওয়াজ: আইরীন নিয়াজী মান্না ৮০-র দশকের একজন সাহিত্যিক। সেই সময় থেকে এ জগতে তার পথচলা শুরু। তার কিশোর কবিতা ও গল্প আমার খুব ভালো লাগে। সে লেখালেখি ছাড়াও সাংবাদিকতায় বেশ সফল। তার জীবনবোধ বেশ ভালো। আর সম্পাদক হিসেবে তার ভালো দিক হচ্ছে সে চাইলেই যে কারো কাছ থেকে লেখা তৈরি করিয়ে নিতে পারে তার পত্রিকার জন্য। কিশোর লেখা পত্রিকাটি মান্না ব্যক্তি উদ্যোগে প্রকাশ করে ভালোবাসার জায়গা থেকে। যা অনেকের করা সম্ভব হলেও করে না। সে অনেকের লেখা নিয়ে পত্রিকাটা করতে চায়। তবে আমার মনে হয় প্রতি সংখ্যায় ভালো মানের ৫/৭টার বেশি ছড়া-কবিতা না থাকাই ভালো। নবীন-প্রবীণ বিচার না করে লেখার মান অনুযায়ী লেখা সাজনো যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে অনেকেই উৎসাহিত হবে। আর একটি কথা, মান্নার এই পত্রিকায় যদি কারো পৃষ্টপোষকতা থাকে তা হলে আরো বড় কলেবরে এটাকে সাজানো যাবে বলে আমার মনে হয়। এভাবেই একদিন কিশোর লেখা একটি সমৃদ্ধ কিশোর পত্রিকা হতে পারে।

আহমাদ স্বাধীন: সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

ফারুক নওয়াজ: তোমাকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ কিশোর লেখাকে।