ঢাকা, শুক্রবার ২৬, এপ্রিল ২০২৪ ৩:২৫:১৯ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

প্রসঙ্গ পরীমনি: আহা জীবন! জলে ভাসা পদ্ম যেমন...

কামরুন্নাহার মুন্নী 

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১১:৫৮ এএম, ১৫ জুন ২০২১ মঙ্গলবার

কামরুন্নাহার মুন্নী 

কামরুন্নাহার মুন্নী 

পরীমনির গুগল তথ্যানুযায়ী নাম শামসুন্নাহার স্মৃতি, বাড়ি সাতক্ষীরা। পড়াশুনা বা কোনো ধরণের শিক্ষাগত প্রতিষ্ঠানের মৌলিক কোনো তথ্য নেই। অর্থাৎ শামসুন্নাহারের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সে কোন পরিবেশ পেয়েছে কোন ঘরানায় বড় হয়েছে এটা বোঝা যাচ্ছে না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরেও জীবন প্রকৃত শিক্ষা দেয়। সেই বৃহৎ শিক্ষার পাশাপাশি  মানুষ প্রমাণিত হয় পরিস্থিতি পরিবেশ বা নতুন কোথাও গিয়ে। চিন্তা, রুচি, ব্যক্তিত্বের  পরিবর্তন, বিকাশ আরো অন্যান্য যাকিছু সেখানেই হয়। যেহেতু নেই, অতএব আলোচনা অন্যদিকে আগাক।
মডেলিং(২০১১)  দিয়েই তার পথচলা শুরু এরপর টিভি এবং বড় পর্দা "ভালোবাসা সীমাহীন" (২০১৩)  দিয়ে।  সেখানে কাজ করার সময় পরীমনি বলেন" এ দিয়েই বড় পর্দায় পা রাখলাম আশা করি দর্শক পছন্দ করবেন"। 
এরপর "রানা প্লাজা"র (২০১৫)  সফলতা পরীমনিকে সবাই আলাদা করে খেয়াল করা এবং লুফে নেয়া। লুফে নেয়া বলা যায় কারণ যে যেভাবে পেরেছে তার জঘন্য সিনেমাগুলো এই মেয়ের বুক পিঠ ঠোঁট আর নিতম্বের বা কটির  ভাঁজের উপর দিয়ে বানাতে চেয়েছে।
২০১৬ সালে এসে পরীমনি সাক্ষাৎকার দিলেন, "ডিরেক্টর প্রোডিউসার ক্যামেরাম্যান সবার আলাদা চাহিদা থাকত, এমন ড্রেস এমন শট দেয়া লাগবে, হল বা দর্শক সম্পর্কে ধারণা ছিলো না, অ্যাঙ্গেল বুঝতেন না।  কিভাবে ধরা হচ্ছে ক্যামেরা, কোথায় ধরা হচ্ছে। উপর থেকে ধরলে মুখ না অন্য কিছু দেখা যাবে। অড লাগবে অশ্লীল লাগবে, সে বিষয় নলেজে ছিলো না বলে জানান অনেক ভুল সিদ্ধান্ত মানে সিনেমা নির্বাচন ভুল ছিলো, খোলাখুলি বলেন বাংলাদেশের বাইরে কত কত বিকিনি পরা নায়িকা দেখি, তাদের কি অড লাগে? কেন লাগে না কারণ ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল, প্রেজেন্টেশন। আমি একা দায়ী নই বা আমার মেন্টালিটি শুধু  চেঞ্জ না পুরো টিমটার ওয়ার্কিং স্টাইল চেঞ্জ করতে হবে সাথে পরীমনির এরপরের কাজগুলোর ধীরে ধীরে চেহারা পাল্টেছে। যতটা সম্ভব চেষ্টা করেছেন স্ক্রিপ্ট, ডিরেক্টর অন্যান্য দিক দেখে কাজ করবার জন্য।
"স্বপ্নজাল" ২০১৮ ছিলো তার এক অভূত মোড়। এটি তিনি সকল ক্ষেত্রে বলেন যে তিনি গুরু মানেন গিয়াস উদ্দীন সেলিমকে এক অর্থে। 
স্বপ্নজালের পর পরীমনির আপাদই কাজের নির্বাচন পালটে গেছে যেটা আগে ছিলো ধীর গতিতে। অ্যাডভ্যান্সার সুন্দরবন, স্ফুলিঙ্গ এইসব কাতারে যুক্ত হচ্ছে। 
সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তনটা এসেছে তার পোশাক এবং ব্যক্তিত্বে। চেষ্টা করেন গুছিয়ে উত্তর দিতে কিংবা কৌশলী হতে।
এশিয়ার ১০০ জন ডিজিটাল তারকা হিসেবে ফোর্বস-এ নাম প্রকাশ হয় পরীমনির (২০২০)। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ফলোয়ার প্রায় ১০ মিলিয়ান।
এখন আসি গতকাল রাতের ঘটনায়, আসলে ঘটনা আরো পাঁচ ছদিন আগের কিন্তু তা সামনে আসে গত রাতে। তিনি প্রথমে তার সামাজিক মাধ্যমে স্ট্যাটাস দেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর। সন্তান যখন পৃথিবীর কোথাও আশ্র‍য় পান না তখন সে মায়ের কোল খোঁজে, মায়ের বুক খোঁজে, আড়াল চায়, নিরাপত্তা চায়। পুরো স্ট্যাটাসটিতে আমার চোখে এটিই উঠে এসেছে তিনি আশ্রয় চাচ্ছেন। 
এতে আমি শেষ দেখা অবধি ৫৩ হাজার এর উপর হাহা ছিলো। মন্তব্য ঘরে  ইতিবাচকতার বাইরে যে মন্তব্য ছিলো__ সিনেমার প্রচারণা, বুড়া বয়সে আবার কি রেইপ, জীবন যাত্রা আমেরিকার এখন আবার বিচার চায়, কাপড় না পরে থাকলে এই হবে, খেয়ে ছেড়ে দেবে, ইয়াং পাইলি না অবশেষে বুড়া, প্রচুর ভিডিও চাই, ভাইরাল হতে চায়, এই পেশা ছেড়ে দেন, নায়িকা আর বেশ্যা সমান।
সংবাদকর্মীরা এসেছেন তার বাসায়। উনি বিস্তারিত বলার পরেও তারা নিজেরা নিজেদের জ্ঞান বুদ্ধি এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতা জাহির করতে গিয়ে পয়েন্ট মিস করে আবার বলুন, আবার বলুন করা।  শেষে তিনি কি চান এটাও  বারবার জানতে চাওয়া আমায় প্রশ্নেভরা মন জানতে চায়, এটা কি বুদ্ধিতে আসে না একটা মানুষ এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে যখন সবার সামনে এসে এমন ভেঙে চুড়ে পড়ছে, বারবার বলছে আমায় বাঁচান, তিনি কি চাইতে পারেন? উনারা তা বোঝেন নি। 
অবশেষে ওনার মুখ দিয়ে বলতেই হলো " আমি বিচার চাই, আমার সাথে যা হয়েছে তার বিচার চাই"।
পরীমনির প্রতিটা কথা খেয়াল করলে দেখা যায়,
শামসুন্নাহাররা যখন পরীমনি হয় তখন কি কি বলে__
১। আপনারা আমার অবস্থানে না দাঁড়ালে বুঝবেন না 
২। আমার প্রোফাইল ভারী বলে আজ আমি এখানে বলতে পেরেছি, সাধারণ মেয়ে হয়ে চেষ্টা করেছি কিচ্ছু পাইনি
৩। আমি আত্মহত্যা করবার মানুষ না আমি মরে গেলে বুঝবেন আমায় মেরে ফেলা হয়েছে
৪। আপনারা আজ থাকুন আমার কোনো সিকিউরিটি নাই
৫। এফডিসির শিল্পী সমিতি আমায় আশ্বাস দিয়েছেন তারা দেখছেন, আমি এরপর আর পাইনি
৬। আমি বেনজির আহমেদকে(ভাইকে) অনেকভাবে চেষ্টা করেই পাইনি 
৭। আমার চোখের সামনে ভাসছে সবকিছু, জিমিকে মেরেছে অনেক 
৮। আমাকে  দুইটা থাপ্পড় মেরেছে, চেয়ার লাথি দিয়ে ফেলে দিয়েছে, জোর করে গলায় ঢেলেছে, গলা জ্বলে যাচ্ছিলো, অক্সিজেনের অভাব হয় আমার, আমার দাঁতটা এখনো নড়ছে, আমি অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম
৯। আমি এর আগে কোনোদিন তাকে দেখিনি, চিনিও না।
১০। ওসি ছিলেন না। আমার সাথে দশটার পর যোগাযোগ করবেন বলেছেন বনানী থানা থেকে, আজ পাঁচদিন হলো কোনো যোগাযোগ নেই।
১১। আমি কি বলছি জানিনা আমি পাগল হয়ে গেছি, আমি বলতে চাচ্ছি বলতে পারছিনা। আসছে না।
১২। আল্লাহ আমারে কই এনে ফেলছো
১৩। আমারে মারেন,  মেরে ফেলেন 
১৪। আমি বেঁচে আছি ক্যান 
এবার যদি এই শামসুন্নাহার বা পরীকথন কিঞ্চিৎ  ব্যাখ্যা করি, 
১.আমাদের সবার সাথে না হলে আমরা কথা বলবো না? এমনকি অন্যের ব্যথা অনুভব পর্যন্ত করবো না! আমরা খুঁজবো না মানুষ কখন এমন ভাঙে! 
২. প্রোফাইল নেই যাদের,  তার মানে এমন অজস্র ঘটনার যে মেয়েগুলো; কোথায় যায় তারা! কি পায় তারা? তাদের সাথে কি কি হয়! 
৩. আত্মহত্যা না করার কথাটিতে কি পাই আমরা! কত মেয়েরা এভাবে মারা গেছে! আর পাতায় পাতায় নাম ছেপেছে আত্মহত্যা বলে। রোজ এইসব ঘটনা খবর হয় আত্মহত্যার মলাটে!
৪. কাউকে মেরে ফেলা কত সহজ তাইনা?
জীবন কত ঠুনকো আমাদের! একজন পাবলিক ফিগার আর্তনাদ করছেন আজ রাতটা থাকার জন্য। তার  থাকার ঘরটাও নিরাপদ লাগছে না আর।
৫. এইসব আশ্বাসে কি ব্যক্তির সাথে হওয়া অন্যায়ের বিচার হয়? নাকি ব্যক্তি মানসিক সক্ষমতা পায়!
এইসব নিরবতা গুলো কি কি কারণে ঘটে!
৬. মানলাম নাসিরউদ্দিন এমনিই মদের ঘোরে অল্প পরিচিত বন্ধু বেনজির আহমেদকে জড়িয়ে বলেছে কিন্তু উনার ফোন না ধরা কি প্রমাণ করে! 
৭. মানুষ ট্রমাটিক হয় কখন? কিভাবে মানুষ এইসবের ভেতর ঢুকে যায় আর তার যুক্তিবাদীতা হ্রাস পায়, এমনকি তার সবচেয়ে কাছের মানুষের নির্যাতন চোখের সামনে যখন হয় তার ভেতর কি কি চলে!! 
৮. অত্যাচার গুলোর বর্ণনা আরো বিস্তারিত চাই আমরা! আরো চুলচেরা বিশদ বিবরণ। 
৯.আগে থেকে পরিচয় লাগেনা, আগের কোনো হিসাবনিকাশ থাকা লাগে তাও না। যেকোনো পরিস্থিতিতে "নারী" (নারীর শরীর) মুড তৈরি করে ফেলতে পারে এবং সে না চাইলেও, মেরে দাঁত ভেঙে তাকে ভোগ করতে চাইতে হবে আর চাওয়া যায়।।
তাই না?  আমাদের ওসব যুক্তি কই যে আগে নিশ্চয় কিছু একটা ছিলো দুজনের মাঝে!!
১০. ওসি কেন ওসি??  বাসায় পরিবার নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে থাকার জন্য! তা না হলে তার জন্য দশটা অবধি কিসের অপেক্ষা? এবং সেই অপেক্ষা পাঁচদিন পরে শেষ হয়!! 
১১. না জানি বলাটা আরো কত রসাশ্রিত করে হলে তার সাথে আমাদের চোখের পানিও পড়তে পারে!
আরো অন্য কোনোভাবে সেই ব্যথার বর্ণনা দিতে পারলে, আমরা  আরো চোখ গোল গোল করতে পারতাম!
১২. আমরা কখন বলি এই কথা যে আল্লাহ আমারে কই আইনা ফেল্লা?? 
যখন  চারপাশের কাউকে আমি আমার অসহায়ত্ব বোঝাতে ব্যর্থ হই। বরং তাদের সামনে আমি আরো অসহায় হয়ে পড়তে শুরু করি। যখন আমাদের শব্দ পৌঁছায় না আর কারো কাছে। 
সামনে দাঁড়ানো মানুষের অনুভব দেখিনা, দেখি অসহিষ্ণু জিজ্ঞাসা। 
১৩.  ওখান থেকে বেঁচে ফিরে পরীমনি এখনো স্বাভাবিক হয়ে কথা বলছেন আহা এটা তো উচিত নয় বরং মেরেই ফেলেন আপনারা সবাই মিলে। 
১৪. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আমার কাছে
"আপনি বেঁচে আছেন সকল শামসুন্নাহারদের হয়ে পরীমনি গল্প শোনাবে সেজন্য, সাহস আর উদাহরণ হবার জন্য, শামসুন্নাহার, খাইরুন্নাহার, কেয়া,  রুমা, ঝুমা, রাহা, মিথিলা, সবার হয়ে একবার বলার জন্য আমি আত্মহত্যা করার মেয়ে না"।
গোটা ঘটনাটাকে আবার দেখি, শামসুন্নাহার স্মৃতিরা পরীমনি হতে একটা ভ্রমণ লাগে। প্রত্যকের জায়গা থেকে প্রত্যকে যখন নিজেকে দেখি আমরা আমাদের ক্ষুদ্রতা দৈন্যতা গুলো দেখতে পাই। অথচ আমরা ভালোবাসি অন্যদের খন্ডন করতে। আমরা যেকোনো ভাবেই যেকোনো মন্তব্য ছূড়ে দিতে পারি, যেকোনো কর্ম ঘটিয়ে ফেলতে পারি।
আমরাই পারি, কেননা এইসকল বোট ক্লাবে মদ্যপ হয়ে আমরাই থাকি, মন্তব্য ঘরে আমরাই থাকি সাংবাদিক হয়েও একটা বিরাট অংশ আমরাই থাকি আর শিল্পীসমিতি কিংবা আরো আরো পুলিশি দায়িত্বগুলো নিয়ে আমরাই থাকি। 
দেশের সামগ্রিক চিন্তাকাঠামো এখান থেকে খুব সহজেই অনুমান করা যায়। এর জন্য বিস্তৃত গবেষণারও প্রয়োজন নেই। এই রুচিকাঠামো কিংবা চিন্তার সৌকর্য আমাদের একদিনে নষ্ট হয়নি।
দীর্ঘদিনের একটু একটু করে ক্ষয়ে যাওয়া দেয়ালে আঁকছি আমরা ঝমককে ছবি প্রতিনিয়ত। নাম দিয়েছি উন্নয়নে ভাসছি আমরা, উন্নয়নে ভেসে ভেসে মানুষ সংজ্ঞা থেকে দূরে গিয়েছি চলে।
আমরা অস্তিত্বকে অস্বীকার করি, আমরা আবেগ আর বিবেগ দুই দুরে রেখে অনুসন্ধান করি এই মুহূর্তে কোন ঘটনা চলনসই তার আদিবৃত্তান্ত। 
এক মুনিয়া, সোহাগী, নুসরাত,  পূর্ণিমারাণী, চলে গেলে নতুন ঘটনা খুঁজতে থাকি। 
আমরা অতি পরিচিত সমাজকে অপরিচিত করতে ভয় পাই। ভয় পাই প্রশ্ন তুলতে, কেবল মুখস্থ কিছু বিপ্লব খরচ করি আমরা।  খরচ করি জমানো কাপুরষতাগুলো।
আমরা না আমাদের সাথে হওয়া অন্যায়গুলো/সেই নামগুলো বলি, না কারো সাথে অন্যায় হলে তার পাশে দাঁড়াই। 
আমি পরীমনিকে সম্মান জানাচ্ছি।
কেউ তো বলেছে, সামনে এসে দাঁড়াতে যে কটা মেরুদণ্ডের হাড় লাগে "আমার তা আছে, আমি বলতে পারি আমার ব্যথা, আমার অসম্মান। এইসব যা কিছু হোক আমিই বলতে পারি"
এই সাহস আপনাকে টান টান করে রাখুক দূরে দাঁড়ানো তালগাছটার মতন যাকে দেখতে একলা লাগলেও সেই শক্তিশালী।
শেষ একটা জায়গায় করতে হয়, তাই করছি, পরীমনির সাথে হওয়া অপরাধীরা আটক হয়েছে, এর সুষ্ঠু বিচার হোক। 
যেকোনো জায়গায় যেকোনো পরীমনি কিংবা শামসুন্নাহার কিংবা স্মৃতি কিংবা অন্য কেউ  এভাবে অন্যায়ের শিকার হলে তার পাশে দাঁড়ান।
রাজপথে না নামুন, শব্দ দিয়ে তার সাহস ভেঙে দেবেন না। 
একটা প্রশ্ন-শিল্পী হিসেবে সম্মান না পাই আমরা আমাদের জীবনটা তো নিরাপত্তা পেতেই পারে না?’

কামরুন্নাহার মুন্নী: অভিনেত্রী, লেখক ও গবেষক

(এই লেখার সকল মতামত একান্তই লেখকের)