ঢাকা, সোমবার ০৬, মে ২০২৪ ৩:১৮:২৪ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

জাপানি গ্রীষ্মে শিশুরা

প্রবীর বিকাশ সরকার

উইমেননিউজ২৪.কম

প্রকাশিত : ০৩:৩৬ পিএম, ৬ নভেম্বর ২০১৭ সোমবার | আপডেট: ০৯:০০ পিএম, ১৫ নভেম্বর ২০১৭ বুধবার

জাপানে দৃশ্যমান ঋতু চারটি। যথাক্রমে হারু বা বসন্ত (৫ ফেব্রুয়ারি-৫ মে), নাৎসু বা গ্রীষ্ম (৭ মে-৮ আগস্ট), আকি বা হেমন্ত (৯ আগস্ট-৭ নভেম্বর) এবং ফুইউ বা শীত (৮ নভেম্বর-৪ ফেব্রুয়ারি)। 

জুলাই মাসের শেষদিক থেকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রীষ্মের ছুটি ঘোষণা করে থাকে। আগস্ট মাস পুরোটাই ছুটি থাকে। ফলে এই মাসটি জাপানি শিশু-কিশোরদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় সময়, স্বর্গীয় আনন্দের সময়। কারণ জাপান প্রধানত শীতপ্রধান দেশ। শীতকালটাই এদেশে দীর্ঘতর। শিশু-কিশোর-কিশোরীদেরকে বছরের অধিকাংশ সময়টা ঘরে বসে কাটাতে হয় বা অভ্যন্তরীণ খেলাধুলাই করতে হয়। জাপানের সব জায়গায় বরফ না পড়লেও অসহনীয় প্রচন্ড শীত থাকে।


কাজেই ছেলেমেয়েরা দীর্ঘ প্রতীক্ষায় থাকে কবে গ্রীষ্মকালটা আসবে! বাইরে বনে-বাদাড়ে-নদী-নালায় খেলতে পারবে, ছোটাছুটি করতে পারবে, ঠান্ডা জলে সাঁতার-হইহুল্লোড় করতে পারবে, মাছ-কীটপতঙ্গ ধরতে পারবে সেই আশায় থাকে!


শীতের দেশ জাপানের ছেলেমেয়েদের গ্রীষ্মকালীন আনন্দ-ফুর্তির সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু মিল রয়েছে বৈকি! যেমন খালেবিলে বড়শি দিয়ে, গামছা পেতে বা জাল দিয়ে মাছধরা, বলখেলা, ক্রিকেট খেলাই প্রধান। অবশ্য জাপানে ক্রিকেটের পরিবর্তে বেইজবল, রাগবি, বোরিং খেলা (ইড়ষিরহম) জনপ্রিয়। আর যেসকল পার্থক্য রয়েছে তার মধ্যে জাপানি ছেলেমেয়েরা পুলে সাঁতার কাটে, সমুদ্রে বাবামার সঙ্গে সাঁতার কাটতে যায়। বাংলাদেশের মতো পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপি-দাপাদাপি করার সুযোগ নেই তাদের। পুকুরে মাছধরার রীতিও ভিন্ন। যেমন ৎসুরিবোরিÑÑছোট ছোট দু-তিন প্রকারের ছোট ও মাঝারিগোছের সামুদ্রিক মাছ ছেড়ে দেয়া হয় যেমন নিজি, নিজিমাসু প্রভৃতি মাছ। এগুলো এত ক্ষুধার্ত থাকে যে বড়শি ফেলতে দেরি টপাপট ধরা পড়ে। ভাড়া করা বড়শি দিয়ে যে যতগুলো মাছ ধরবে সেগুলো কিনতে হয় এবং সেখানেই পুড়িয়ে খাওয়াই প্রধান আনন্দ। শিশুরা এই পোড়ামাছ খাওয়ার পাগল আর যেহেতু মাছগুলো তারা নিজেরাই ধরে ফলে আনন্দের সীমা থাকে না। অনেকে অবশ্য বাসায় নিয়েও আসতে পারেন। এটা বহুদিনের রীতি।


বাংলাদেশে যেমন শিশুরা পুকুরে সাঁতার কাটে এখানে সেরকম পুকুরও নেই, সাঁতারকাটাও সম্ভব নয়। এখন তো বাংলাদেশের শিশুরা যারা শহরে বসবাস করে সাঁতার কী তা জানা নেই। কিন্তু গ্রামেগঞ্জে এখনো অবাধে গ্রীষ্মকালটাকে মাতিয়ে রাখে ছেলেমেয়েরা। নগরায়নের কারণে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে ছেলেমেয়েদের বাইরে অর্থাৎ প্রকৃতির মধ্যে মুক্তদেহমনে খেলাধুলার করা সুযোগ। আধুনিকতা, ব্যবসায়িক-অর্থনৈতিক উন্নতি, নগরায়ন জাপানি ছেলেমেয়েদেরকে প্রকৃতি থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে। যন্ত্রপাতি, কস্পিউটারদ্বারা নিয়ন্ত্রিত সীমাবদ্ধ-পদ্ধতির পরিধির মধ্যে জাপানি ছেলেমেয়েদেরকে বড় হতে হচ্ছে। কস্পিউটার গেমস, রোবট নিয়ে খেলা কিংবা রোবট তৈরির প্রতিযোগিতায় মেতে থাকা খুবই সাধারণ এক প্রবণতা এই দেশে। তবে গ্রীষ্মকালে ভিন্নমাত্রার আনন্দ-বিনোদনও রয়েছে যেমন জাদুঘর পরিদর্শন এদেশে প্রতিটি শহরেই নানা ধরনের জাদুঘর রয়েছে। চিড়িয়াখানায় ঘোরাঘুরি করা। রোমাঞ্চকর চলচ্চিত্র দেখা। কৃত্রিম ডাইনোসার পার্কে বিচিত্রসব ডাইনোসারের দেখা পাওয়াÑÑযে অভিজ্ঞতা বুকের রক্ত হিম করে দেয়! উঁচু উঁচু নাগরদোলা, দ্রুততম কোস্টারচড়া তাছাড়া টোকিও ডিজনিল্যান্ড তো আছেই! যে ডিজনিল্যান্ডটি আমেরিকার চেয়েও আনন্দদায়ক এবং বিশ্বনন্দিত, অসম্ভব জনপ্রিয়। ‘ডিজনি সী’ বা ‘ডিজনি সমুদ্র’ নামক কৃত্রিম সমুদ্রাভিযানে জাহাজে ঘুরে ঘুরে বনজঙ্গলপাহাড়ের ভেতর দিয়ে পরিভ্রমণ করা আর নানা কৃত্রিম ভয়ঙ্কর সব জীবজন্তুর নড়াচড়া, বিকট চেহারার জলদুস্যর খপ্পড়ে পড়তে পড়তে বেঁচে যাওয়ার মতো অ্যাডভেঞ্চার অন্য কোথাও নেই বলেই মনে হয়। সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা বৈকি! কাজেই এসবের প্রতিও ছেলেমেয়েদের আগ্রহ শীর্ষনীয়, ঈর্ষণীয়।


অত্যাধুনিক যান্ত্রিক আনন্দ-বিনোদনের সঙ্গে ঐহিত্যবাহী বা জাতিগত আনন্দফুর্তি তো আছেই যার জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা থাকে শিশুকিশোরদের। আর সেখানেই তাদের আসল তৃপ্তি। যেমন বহু শিশু গ্রামে চলে যায় গ্রীষ্মের ছুটিতে বাবামা বা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে। সমৃদ্ধ প্রকৃতির মধ্যে অবারিত খোলা মাঠ, নদীর তীর, জলাশয়, পাহাড়েচড়া, ধানক্ষেতে চারালাগানো ইত্যাদি কর্মকান্ডের ভেতর দিয়ে তারা ক্ষণকালীন গ্রীষ্মকালীন গ্রামীণজীবনকে তোলপাড় করে তোলে। জাপানে রয়েছে বহু গভীর এবং অগভীর নদনদী। বড় বড় নদীতে জলবাসে চড়ে ভ্রমণ একটা চমৎকার আনন্দ। অগভীর পাহাড়ি নদী বা জলাশয়ে হাঁটুপানিতে মাছধরার মধ্যে কী যে আনন্দ তা স্বচক্ষে না প্রত্যক্ষ করলে বিশ্বাস করা কঠিন! শুধু মাছ নয়, জারিগানি বা জাপানি কাঁকড়া, চিংড়ি, নানা ধরনের মাছ ধরে ছেলেমেয়েরা যার যার প্লাস্টিকের বাক্সে জীইয়ে রাখে। নিয়মিত খাবার দেয় প্রতিদিন। বড়শি ছাড়াও এক ধরনের লাঠিযুক্ত জালি যাকে বলে ‘আমি’ দিয়ে মাছ, কীটপতঙ্গ, ফড়িং ইত্যাদি ধরে বনেবাদাড়ে ঘুরেঘুরে ভাইবোন বা দল বেঁধে অথবা দাদা-দাদুর সঙ্গে। এই জালিটিই জাপানি গ্রীষ্মকালের প্রতীক।
‘গোল্ডফিস’ নামে মাছের কথা আমরা প্রায়শ শুনে থাকি। জাপান হচ্ছে এর জন্য স্বর্গ! বছর বছর প্রচুর পরিমাণে ‘গোল্ডফিস’ যাকে জাপানিরা বলে ‘কিনগিয়োও’র প্রজনন হয়ে থাকে বিভিন্ন স্থানে। নানা আকারের বিচিত্র সব রঙের অদ্ভুত সুন্দর মাছগুলোকে সরবরাহ করা হয় শহরের পেট ফিস বিক্রির দোকানগুলোতে। বিশেষ করে নাতিদীর্ঘ গ্রীষ্মকালে এই কিনগিয়োও মাছে চাহিদা অপরিসীম। ছেলেমেয়েরা শুধু নয়, বড়রাও এই মাছ পোষেণ বাসাবাড়িতে অ্যাকুরিয়ামে। ছেলেমেয়েরা তো ভীড় করেই দোকানগুলোতে প্রিয় কিনগিয়োও কেনার জন্য, আবার গ্রীষ্মকালীন মেলা ও উৎসবের সময় খুলেবসা পথব্যবসায়ীদের দোকান থেকেও এই ছোট ছোট মাছ কিনে শিশুরা। পলিথিনের থলিতে জলের মধ্যে কী চমৎকার সাঁতার কাটে মাছগুলো যা সত্যি দেখার মতো! বাসায় নিয়ে গিয়ে ছোট ছোট খেলনা-অ্যাকুরিয়ামে মাছগুলোকে প্রতিপালনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে শিশুরা। কিনগিয়োওর পাশাপাশি কচ্ছপের ছানাও প্রতিপালনে আগ্রহী বহু জাপানি ছেলেমেয়ে।


আরও একটি বৈচিত্র্য এই দেশের গ্রীষ্মকালে পরিলক্ষিত হয়। সেটা হলো: কীটপতঙ্গ ধরা ও প্রতিপালন করা এবং খেলা। যেমন কাবুতোমুশি বা ইববঃষব যাকে বাংলাভাষায় গোবরেপোকা বা কাঁচপোকাও বলা হয়ÑÑদারুণ জনপ্রিয় শিশুদের মধ্যে। এই পোকাধরার জন্য কী যে প্রাণান্তকর লড়াইয়ে নামে ছেলেমেয়েরা সে এক বিস্ময়কর ব্যাপার! পেট শপেও গ্রীষ্মকালে এই পোকা বিক্রি হয়ে থাকে। কাবুতোমুশির মধ্যে লড়াই বাঁধিয়ে উপভোগ করাই মূল উদ্দেশ্য শিশুদের। এছাড়া জোনাকি পোকা এবং তেনতোমুশি নামে এক ধরনের ছোট্ট পোকা যার রং কমলা বা কালচে লাল সারা শরীরে রয়েছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কালো বিন্দু এদুটোর প্রতি জাপানি ছেলেমেয়েরা অসম্ভব দুর্বল। জোনাকি ধরে প্লাস্টিকের বাক্সে রেখে দিলে রাতে জ্বলেনেভে এটা দেখতেই শিশুদের আনন্দ আর তেনতোমুশি হাতের তালুতে, বাহুতে হাঁটাহাঁটি করে এতেই তাদের যত ভালোলাগা!


উল্লেখ্য যে, কীটপতঙ্গ নিয়ে খেলাধুলা করার এই রীতিটি বড় অদ্ভুত মনে হলেও একটা ধারণা তাদের মনে শৈশবেই জন্মলাভ করে যে, প্রকৃতি আছে বলেই এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীগুলো তাদেরকে আনন্দ দেয়। সুন্দর প্রকৃতি ও পরিবেশ না থাকলে এরা থাকবে না। ফলে পরিবেশরক্ষার গুরুত্বটা তারা বুঝতে উঠতে পারে বিধায় বড় হয়ে তারা প্রকৃতিসচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। নার্সারিতেই শিক্ষকরা এদেরকে প্রকৃতি-পরিবেশ ও জীবজন্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দিয়ে থাকেন। গ্রীষ্মকালে কোনো কোনো প্রদেশে পোকামাকড়-কীটপতঙ্গ-ফড়িং-প্রজাপিত-সাপ-ব্যাঙ প্রভৃতির সংস্পর্শে এসে প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে জানা ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালাভের জন্য কৃত্রিম বনবাদাড় তৈরি করা হয়েছে সরকারি-বেসরকারিভাবে। টোকিওসহ দেশের মহানগরগুলোর উদ্যানে এবং প্রায় মহল্লাতেই কৃত্রিম নালা, উদ্ভিদ-ঘাস-গাছালিযুক্তজলপ্রবাহ তৈরি করেছে নগরপ্রশাসন যাতে করে গ্রীষ্মকালে ছেলেমেয়েরা জলক্রীড়া করতে পারে, ছোট ছোট মাছ ধরতে পারে, প্রকৃতির সংস্পর্শে আসতে পারে। অনেক জায়গায় শিশু-কিশোর-কিশোরীরা এই গ্রীষ্মকালে নদনদী-জলাশয়ের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নায় অংশগ্রহণ করে থাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাও বাদ যায় না। নদনদী থেকে সংগৃহীত উদ্ভিদ, মাছ, ব্যাঙ, ছোট ছোট প্রাণী, শামুক ইত্যাদি পরীক্ষানিরীক্ষার প্রকল্পেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা অংশগ্রহণ করে থাকে মূলত পরিবেশ সম্পর্কে ধারণালাভ ও জলবায়ুজনিত পরিবর্তনজনিত কারণে এসকল উপাদানে কী রকম প্রভাব পড়ছে তা জানার জন্য।


জাপান হচ্ছে শিশুদের জন্য স্বর্গভূমি। তাই সারা বছর তো বটেই, শুধুমাত্র গ্রীষ্মকালেই নানা রকম পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় শিশুদের জন্য। ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, রোবট তৈরি প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞান প্রতিযোগিতা, অরিগামি প্রতিযোগিতা, মনোজুকুরি বা বিভিন্ন জিনিস তৈরির কারিগরি প্রতিযোগিতা যা জাপানি জাতির উন্নতির অন্যতম প্রধান নীতি।


গ্রীষ্মকাল মানেই জাপানে ‘ওবোন’ উৎসব। এই উৎসবটি অন্যতম প্রধান এবং বড় উৎসব। নদীর তীর, খোলা মাঠে বিপুল আয়োজনে আতসবাজি ফোটানো এই উৎসবের প্রধান বৈশিষ্ট্য। যদিওবা জাপানি বৌদ্ধধর্মীয় এই পার্বনটি কিন্তু জাপানের নিজস্ব প্রাচীন ধর্ম শিন্তোও, খ্রিস্টান, ইহুদি এবং অন্যান্য নওধর্মাবলম্বীরাও এই উৎসবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে থাকেন আনন্দলাভের জন্য। জাপানে ধর্ম আনন্দের জন্য, দেশ-জাতিকে রক্ষা, সার্বিক উন্নতির জন্য আদৌ খারাপ কাজের নয় এটা শৈশবেই শিশুরা বুঝতে শিখে যে কারণে ধর্মীয় উৎসবগুলোতে শিশুরাও বড়দের পাশাপাশি অসীম আনন্দ-বিনোদনে মেতে ওঠে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হালকা বিচিত্র বর্ণে ও চিত্রে ছাপা ইউকাতা পোশাকে যখন আতসবাজি পোড়ায় এবং সুশৃঙ্খলভাবে নাচে তখন মনে হয় শীতপ্রধান দেশ জাপানে ক্ষণাযু গ্রীষ্মকালটা সত্যি বড় মধুর এবং আদরণীয়।