ঢাকা, শনিবার ২০, ডিসেম্বর ২০২৫ ১২:৪৭:৪৯ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

করোনাকালে শিক্ষার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে ভার্চুয়াল স্কুল

বাসস

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৬:১৬ পিএম, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ মঙ্গলবার

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

ইশরাত জাহান আনিশা ও নুসরাত জাহান তানিশা (১৪), দুই জমজ বোন। করোনাকালে স্কুল বন্ধ হয়ে গেলেও থেমে থাকেনি তাদের পড়ালেখা। তারা এখন ফেসবুকে ঢুকে লাইভ ক্লাসে অংশ নিতে পারে। প্রয়োজনীয় নোট নিতে পারে।  কোন বিষয় বুঝতে না পারলে প্রশ্ন করে জেনে নিতে পারে। কমেন্ট বক্সে নিজেদের বাড়ির কাজ ও জমা দিতে পারে। 
করোনা মহামারীর সময়ে ভার্চুয়াল পাঠদান পদ্ধতি এভাবেই দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে ঘরে বসে পাঠ গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। 
অনলাইন শিক্ষার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে দুই বোন বাসস সংবাদদাতাকে বলেন, “আমরা যখন ঘরে বসে ল্যাপটপ কিংবা এ্যান্ড্রয়েড ফোনের মাধ্যমে ক্লাসে অংশ নেই, তখন মনে হয় যেন শিক্ষকরা আমাদের সামনে বসেই ক্লাস নিচ্ছেন।” 
‘ভার্চুয়াল’ শব্দটি তাদের কাছে অচেনা ছিলো। কিন্তু করোনা মহামারির সময়ে দেশব্যাপি লকডাউন চলাকালে তাদের বাবা মাওলানা আবু আইয়ুব আনসারি তার এন্ড্রয়েড ফোনে ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে মেয়েদের ডিজিটাল ক্লাস সম্পর্কে ধারনা দেন।
আইয়ুব আনসারি বলেন, শহর থেকে দশ কিলোমিটার দুরে সদর উপজেলার চর মাধবদিয়া ইউনিয়নের জমাদ্দর ডাঙ্গি গ্রামে তাদের বাড়ি। ভার্চুয়াল পাঠদান পদ্ধতির কারণে পথের দূরত্ব ঘুচিয়ে স্কুল এবং শিক্ষক দুইই যেন এখন বাড়িতে চলে এসেছে। 
আনিষা ও তানিশা জেলার সারদা সুন্দরি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। করোনা মহামারীকালে  ভাইরাস সংক্রামণ এড়াতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সারাদেশে গত ১৮ মাস ধরে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। কিন্তু তারা টিভি ও ফোনের মাধ্যমে ক্লাস চালিয়ে যাচ্ছে। 
তারা জানান, যাদের এ্যান্ড্রয়েড ফোন বা ল্যাপটপ নেই, তারাও ইচ্ছে করলে সংসদ টেলিভিশনে এই ক্লাসে অংশ নিতে পারেন। এট্আুই এর কারিগরী সহযোগিতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই ক্লাসগুলো প্রচার করে। 
মাওলানা আইয়ুব বলেন, “এখন আমার মেয়েরা টেলিভিশনে ক্লাস দেখে এবং কোন ঝামেলা ছাড়াই মোবাইল ও ল্যাপটপে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে ও তাদের প্রয়োজনীয় নোট নিতে পারে।” 
জমজ বোন আনিশা ও তানিশা বলেন, “আমরা বাড়ি থেকেই ডিজিটাল ক্লাস করতে পারছি এজন্যে আমরা আনন্দিত। সংসদ টেলিভিশন ছাড়াও আমরা ল্যাপটপ ও এন্ড্রয়েড ফোনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক লাইভে ক্লাস করতে পারি।” 
দেশব্যাপি অনলাইন শিক্ষার ব্যাপক পরিচিতি ও সুবিধার সাথে তাল রেখে ‘ফরিদপুর ভার্চুয়াল স্কুল’ আমার ঘরে আমার স্কুল’ অনলাইন পাঠদান পদ্ধতিকে পরিচিত করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।  কোভিড ১৯ মহামারীকালে হাজার হাজার শিক্ষার্থী এই ভার্চুয়াল স্কুলের মাধ্যমে ঘরে বসেই নিজ নিজ শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত হতে পারছে ।  
ফরিদপুর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক অপূর্ব কুমার দাস তার ব্যতিক্রমী উদ্যোগের মাধ্যমে জেলার শিক্ষার্থীদের এই নতুন ধরনের পাঠগ্রহণ পদ্ধতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের স্কুলের সাথে সংযুক্ত করেছেন।   
কোভিড মহামারী মোকাবেলায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে।  সেসময় অপূর্ব দাসের মনে ভার্চুয়াল পাঠদান পদ্ধতির চিন্তা আসে। তিনি  ২০২০ সালের মে মাসে শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও এটুআই-এর কর্মকর্তাদের সাথে একটি জুম মিটিং-এ অংশ নেন এবং সেখান থেকে এটুআই এর যুগ্ম প্রকল্প পরিচালক (যুগ্ম সচিব) সেলিনা পারভেজের পরামর্শে ভার্চুয়াল ক্লাসের অনুপ্রেরণা পান।
তিনি ‘ফরিদপুর অনলাইন স্কুল’ নামের একটি গ্রুপ খোলেন।  সেখানে তিনি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের তার গ্রুপে আমন্ত্রণ জানান। অপূর্ব তাঁর রঘুনন্দপুরের বাড়ি থেকে হোয়াইট বোর্ড ও মার্কার ব্যবহার করে ফোনে লাইভ ক্লাস নেওয়া শুরু করেন। 
গ্রুপে আগ্রহী শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং শিক্ষকরা যুক্ত হন। অপূর্ব সবাইকে এই ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে যুক্ত থাকার অনুরোধ করেন এবং দিনে ও রাতে নিরলসভাবে বিভিন্ন বিষয়ে ক্লাস পরিচালনা করেন। এই গ্রুপের সদস্য সংখ্যা এখন মোট ৭,৪০০ জন। এই গ্রুপ বিনা খরচে প্রাথমিক থেকে ¯œাতকোত্তর পর্যন্ত যে কোন শিক্ষার্থীকে ডিজিটাল শিক্ষার সুযোগ করে দিচ্ছে।
শিক্ষক অপূর্ব দাস কেবলমাত্র স্কুল চালু করেই থেমে থাকেন নি। তিনি “এ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহার করে ভার্চুয়াল পাঠদান পদ্ধতি”র বিষয়ে শিক্ষকদের জন্য ও একটি প্রশিক্ষণের আয়োজন করেন। এরপর তার সহকর্মী ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও এই নতুন প্লাটফর্মে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে ক্লাস নেয়া শুরু করেন।  
বাসস’র সাথে আলাপকালে অপূর্ব বলেন, আমি ও আমার তিন সহযোগী- সৌরভ বিশ^াস, কৃষ্ণ সাহা ও উদয়ন কর্মকার প্রথম  “ফরিদপুরে অনলাইন স্কুল” নামে ক্লাস শুরু করি, যেখানে বিভিন্ন বিষয়ে বিনা খরচে কোন এডমিশন ফি ছাড়া শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে পারবে।
তিনি বলেন, “আমি এতটা প্রশংসা পাবো তখন ভাবতেও পারি নি।” 
অপূর্ব দাস বলেন, “আমি প্রাথমিক থেকে ¯œাতকোত্তর পর্যন্ত একশ’র বেশি ক্লাস নিয়েছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে তাঁর শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আমার সব ক্লাস আমি তাঁকে উৎসর্গ করেছি।   
জেলা প্রশাসক অতুল সরকার ও ফরিদপুর জেলা প্রশাসন এই ভার্চুয়াল স্কুলকে  কারিগরি সহায়তার পাশাপাশি সার্বিক সহযোগিতা দিচ্ছে। জেলা প্রশাসক নিজে ভার্চুয়াল সভা আয়োজন করে  প্লাটফর্মটির নাম “ফরিদপুর অনলাইন স্কুল”এর পরিবর্তে “ফরিদপুর ভার্চুয়াল স্কুল” নামে পরিচালনার পরামর্শ দেন। তিনি সব শিক্ষকদের একই প্লাটফর্ম থেকে অনলাইন ক্লাস নেওয়ার আহ্বান জানান। যা দেশে ‘আইকনিক’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভার্চুয়াল ক্লাসে সেরা পাঠদানকারী শিক্ষকের ক্লাসগুলো বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচার করা হয়। স্থানীয় ক্যাবল অপারেটরদের পরিচালিত দুটি ভিডিও চ্যানেলেও ক্লাসগুলো প্রচার করা হয়।  
অপূর্ব বলেন, “প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, মাদ্রাসা, বধির স্কুল, পলিটেকনিক ও বিভিন্ন কলেজের শিক্ষকরা প্রথমে নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে ভার্চুয়াল স্কুলে ক্লাস নেয়া শুরু করেন। জেলা প্রশাসক অতুল সরকারের নেতৃত্বে এবং নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই মহামারী পরিস্থিতিতে আমরা শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি।”
ফরিদপুর জেলা শিক্ষা অফিসের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলা প্রশাসনের নিবিড় পর্যবেক্ষণে এতে প্রায় ২৫০ জন শিক্ষক সাপ্তাহিক রুটিন অনুযায়ী ভার্চুয়াল ক্লাস নেন এবং ৩৭১ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এই ভার্চুয়াল স্কুলে যুক্ত হয়ে পাঠ গ্রহণ করেন। 
জেলা শিক্ষা অফিসার বিষ্ণুপদ ঘোষাল বলেন, “অপূর্ব কুমার দাস এই নতুন শিক্ষা পদ্ধতিকে পরিচিত করাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। জেলা প্রশাসক সময়োপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ করায় এই মহামারীকালেও শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।”
তিনি বলেন, প্রাথমিক, মাধ্যমিক এমনকি উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত হাজার হাজার শিক্ষার্থী মানসম্পন্ন শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত এই ভার্চুয়াল ক্লাস থেকে পাঠগ্রহণ করে উপকৃত হচ্ছেন।”  
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মোহাম্মদ সাইফুল কবির বাসসকে বলেন, “ভার্চুয়াল স্কুলের  মাধ্যমে জেলার হাজার হাজার শিক্ষার্থী এই শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছে। এর ফলে মহামারীকালে স্কুল বন্ধ থাকায় পড়ালেখার যে ক্ষতি হয়েছিলো তা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।”  তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীদের উন্নত শিক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে অপূর্ব কুমার দাসসহ জেলার সেরা শিক্ষকরা একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এখন বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এধরনের অনলাইন ক্লাস পরিচালনা করায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অনিশ্চয়তা অনেকটাই দূর হবে।”