ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৫, এপ্রিল ২০২৪ ৭:৫৯:০৩ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

আফগানিস্তান: মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন যে নারী

বিবিসি বাংলা অনলাইন

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০১:৪৭ এএম, ৯ অক্টোবর ২০২১ শনিবার

লায়লা হায়দারি, মাদকের দেশে মাদকের বিরুদ্ধে একা লড়াই করছেন যে নারী

লায়লা হায়দারি, মাদকের দেশে মাদকের বিরুদ্ধে একা লড়াই করছেন যে নারী

সারাবিশ্বে অবৈধ আফিম ও হেরোইনের ৮০ শতাংশেরও বেশি আসে আফগানিস্তান থেকে। বছরের পর বছর ধরে চলা যুদ্ধ এবং আইন শৃঙ্খলার অভাবের সুযোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রগুলো দেশটিতে মাদকের উৎপাদন বিস্তার করেছে। নানা অনিশ্চয়তার কারণে দেশটির ভেতরে দারিদ্র এবং মাদকাসক্তিও নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে।

মাদকাসক্ত লোকজনকে নেশার জগত থেকে ফিরিয়ে এনে তাদের সমাজে পুনর্বাসনের জন্য কাজ করছেন এক আফগান নারী। নাম তার লায়লা হায়দারি। তার ভাই হঠাৎ করে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ার পর তিনি একটি মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।

লায়লার ভাই হাকিমের স্ত্রী তাকে প্রথম তার ভাইয়ের আসক্ত হয়ে পড়ার খবরটি দেন। এরকম আকস্মিক খবরে লায়লা স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। হাকিমের আসক্তির কারণে পুরো পরিবারটিই দিশেহারা হয়ে পড়েছিল।

এরপর ২০১০ সালে রাজধানী কাবুলে মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলেন লায়লা হায়দারি। আফগানিস্তানে এটিই প্রথম বেসরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্র।

তিনি জানান, হাকিমের আসক্তির কথা তিনি তার শ্বশুড় বাড়ির লোকজনের কাছে গোপন রাখতে চেষ্টা করেছিলেন।

লায়লা হায়দারি বলেন, এটা লজ্জার বিষয়। জানাজানি হলে আমাদের সুনাম ক্ষুণ্ণ হতো। কিন্তু এরপর হাকিমের স্ত্রী আরেকদিন ফোন করে জানালো পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। হাকিম নাকি এখন বাড়িতেই মাদক গ্রহণ করছে।

লায়লা হায়দারি তার ভাইয়ের বাড়িতে ছুটে গেলেন। তাদের তিনটি ফুটফুটে মিষ্টি মেয়ে। তিনি দেখলেন তার ভাইসহ আরো যেসব কাজিন আছে তারা সবাই একসঙ্গে মিলে বাচ্চাদের সামনেই ড্রাগ নিচ্ছে।

লায়লা বলেন, বাচ্চাদের ফুপু হিসেবে আমার মনে হলো যে কিছু একটা করা আমার দায়িত্ব। কারণ আমি চাই বাচ্চারা সুস্থ সুন্দরভাবে বেড়ে উঠুক। তাদের ভবিষ্যৎ ভাল হোক।

এরপর লায়লা প্রথমেই ভাবলেন এসব থেকে বাচ্চাদের দূরে সরিয়ে ফেলতে হবে। তাই তিনি তার ভাইকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। সে তখন কাবুলের কুখ্যাত একটি ব্রিজের নিচে গিয়ে থাকতে লাগল। সেখানে মাদকাসক্ত বহু মানুষ বসবাস করতো।

লায়লা হায়দারি বলেন, তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ায় তার স্ত্রী মোটেও খুশি ছিল না। কারণ সে বাড়িতে একা হয়ে পড়েছে। আমাকে ফোন করে সে কাঁদতে লাগলো। বললো হাকিমকে খুঁজে বের করতে। ওই ব্রিজের নিচে গিয়ে আমি দেখলাম সেখানে চার হাজারের মতো মাদকাসক্ত। সবাইকে অর্ধমৃত বলে মনে হচ্ছিল- রোগা পাতলা, পরনে নোংরা কাপড়। আমি ভাবলাম এই লোকগুলোরও তো স্ত্রী ও বাচ্চা কাচ্চা আছে। তারাও নিশ্চিই তাদেরকে নিয়ে উদ্বিগ্ন।

লায়লা হায়দারি বলেন, জীবনে এরকম মর্মান্তিক দৃশ্য তিনি এর আগে কখনো দেখেননি। মনে হচ্ছিল লোকগুলো যেন নরকে বসবাস করছে। যেভাবে তারা আফিম ও হেরোইন গ্রহণ করছে, দেখে মনে হচ্ছে তারা যেন নরকের আগুনে নিজেদের পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। তাদের চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যেত সবকিছু হারিয়ে তারা নিঃস্ব হয়ে পড়েছে।

লায়লা হায়দারি যখন তার ভাইকে খুঁজে পেলেন তখন তার মুখের দিকে তাকাতে পারছিলেন না। সে ছিল তাদের পরিবারের বড় সন্তান। ফলে তাকে সবাই পিতার মতোই দেখতো। লায়লা তখনই সিদ্ধান্ত নিলেন, তার ভাইসহ আরো যারা আসক্ত তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি কাজ করবেন।

হেরোইন খুবই কড়া নেশা। আফিম গাছ থেকে এটি উৎপন্ন হয়। এর চাষ হয় মধ্য এশিয়ায়। ফলে এই অঞ্চলে বহু শতাব্দী ধরে আফিমের চাষ হচ্ছে।

আফগানিস্তানেও মাদকাসক্তি দীর্ঘদিনের একটি সমস্যা। কিন্তু ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো আফগানিস্তানে অভিযান চালানোর পর সেখানে হেরোইনের চাষ ও মাদকাসক্তি নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়।

আফগান সরকার ও তার আন্তর্জাতিক মিত্ররা মিলে আফিম চাষের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবারই বড় ধরনের অভিযান চালায়। কিন্তু যুদ্ধের কারণে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে আইনের শাসন না থাকায় সেখানে বরং আফিমের চাষ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ অর্থ রোজগারের জন্য জঙ্গিদের কাছে এই আফিম চাষ ও তার পাচারই প্রধান উৎস।

লায়লা হায়দারি বলেন, এটা তো শুধু আমাদের একার সমস্যা না। এটা একটা বৈশ্বিক সমস্যা। আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রগুলো এই মাদকের ব্যবসা করছে। আপনি দেখবেন আফিম-চাষিরা কিন্তু এখনও খুব দরিদ্র। শীতকালে পরার মতো গরম জুতা-কাপড়ও তাদের নেই। তারা কিন্তু আফিম চাষ করে অর্থ রোজগার করছে না। লোকেরা তাদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে এসব চাষ করতে বাধ্য করছে। এর মাধ্যমে তারা কোন রকমে খেয়ে পরে বেঁচে আছে।

অবৈধ মাদক সারা বিশ্বেই বড় সমস্যা। কিন্তু আফগানিস্তানে এজন্য রয়েছে খুবই উপযোগী পরিবেশ-যুদ্ধ, অনিশ্চয়তা, বেকারত্ব, মানসিক ও সামাজিক অস্থিরতা এবং দারিদ্র। এছাড়াও মাদক দ্রব্য সেখানে খুবই সস্তা।

লায়লা বলেন, সবকিছুর উপর যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে। কারণ এর ফলে মানুষ মরিয়া হয়ে ওঠেছে। শিক্ষার অভাবও একটি সমস্যা। মাদকে আসক্ত কিছু মানুষ আছেন তারা নিজেরাও জানেন না তারা কী গ্রহণ করছেন। অনেক নারী না জেনেই এতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। 

তিনি আরও বলেন, নারীদের মাথা ব্যথা করলে, মাসিকের যন্ত্রণা হলে, কিম্বা বাচ্চা না হলে কেউ কেউ তাদের হেরোইন দিচ্ছে। কী খেয়েছে সেটা জানার আগেই তারা এতে আসক্ত হয়ে পড়ছে।

মাদকাসক্তি থেকে বের হয়ে আসার উপায় বিষয়ে একটি বই নিজেও ভাইকে দিয়েছিলেন লায়লা। ভাই হাকিম আসক্তি থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু লায়লা আরো বেশি সংখ্যক মানুষকে সাহায্য করতে চাইলেন। তাই ২০১০ সালে তিনি পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলেন।

নিজের সঞ্চিত সব অর্থই তিনি এর পেছনে ব্যয় করেছেন। স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকেও সাহায্য পেয়েছিলেন তিনি। এই কেন্দ্রটি মায়ের ক্যাম্প নামে পরিচিত।

এই কেন্দ্রটিতে একটি কফির দোকান আছে। এখান থেকে যে অর্থ আয় হয় তা খরচ করা হয়ে পুনর্বাসন কেন্দ্রটি চালাতে।

কফির দোকানটি চালান তাজ বেগম। তিনি জানান, করোনাভাইরাস মহামারির আগে এই কেন্দ্রে ৩০ থেকে ৪০ জনের মতো ছিল। শীতকালে এই সংখ্যা ছিল ৭০ জনেরও বেশি।

লায়লা হায়দারি বলেন, এখানে একটি কফির দোকান চালিয়ে অর্থ সংগ্রহ করা হতো। সরকার আমাদের কোন অর্থ দিতো না। কিছু মেয়ে যাতে স্কুলে যেতে পারে সেজন্যও আমি অর্থ ব্যয় করেছি। কিন্তু কোভিডের পর, এই কফি শপ থেকে আয় রোজগার ৯০ শতাংশ কমে গেছে। ক্যাম্পে এখনও কিছু রোগী আছে। আশা করছি খুব শীঘ্রই আমরা আরো কিছু লোককে সাহায্য করতে পারবো।

কাবুলের একমাত্র বেসরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করে লায়লা হায়দারি একজন সুপরিচিত ব্যক্তিতে পরিণত হন। কিন্তু এটা করতে তার যেমন প্রচুর সাহসের প্রয়োজন ছিল, তেমনি দরকার ছিল লেগে থাকার মতো শক্ত মনোভাবও।

খুবই অল্প বয়সে লায়লার বিয়ে হয়। তার বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। স্বামী ছিল তার চেয়েও বয়সে অনেক বড়। তিনি ছিলেন খুবই ধার্মিক এক মোল্লাহ। এই সংসার টিকে নি। এরপর তিনি শুরু করেন নিজের ব্যবসা। এর মধ্যেই পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন তিনি। এসময় জঙ্গিরা তাকে হত্যার হুমকি দেয়। ফলে তার এই যাত্রা খুব একটা সহজ ছিল না।

তিনি বলেন, বিয়ের সময় আমি শিশু ছিলাম। একজন পুরুষের সঙ্গে থাকার জন্য তখনও শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। আমার স্বামী যখনই আমার সঙ্গে ঘুমাতেন, সেটা ছিল যৌন নির্যাতনের মতো। কারণ আমি তো একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারীর মতো কিছু অনুভব করতে পারিনি।

তিনি বলেন, এছাড়াও তিনি ছিলেন খুবই কট্টর। সবকিছুতেই তার ভিন্ন ধরনের মতামত ছিল। আমি যে পরিবার থেকে এসেছি সেটা ছিল খুব উদার ও খোলা মনের। তিনি আমাকে সৌদি নারীদের মতো কালো বোরকা পড়তে বাধ্য করতেন। চোখ ছাড়া পুরো শরীর আবৃত থাকতো। গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরম পড়তো। আমার পরিবার কখনও আমাকে এটা পরতে বলেনি।

লায়লা বলেন, তার সঙ্গে ঘুমাতে আমি ঘৃণা করতাম। তাই আমি তাকে তালাক দিয়ে দেই। সন্তানদের জন্য এটা ছিল খুব বড় একটা আঘাত। কিন্তু আমি আশা করি তারা বুঝতে পেরেছে যে আমাকে কী কারণে সেখান থেকে চলে আসতে হয়েছে।

লায়লা হায়দারির তিন সন্তান। দুই ছেলে এক মেয়ে। কিশোরী থাকতেই এসব সন্তানের জন্ম হয়। আফগান আইন অনুসারে বিবাহবিচ্ছেদের পর তাদের পিতার সঙ্গেই থাকতে হয়েছে। সন্তানদের তিনি বড় করতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু যে ক্যাম্প তিনি গড়ে তুলেছেন, তার নামই তিনি দিয়েছেন মায়ের ক্যাম্প। সেখানে অনেকেই তাকে মা বলে সম্বোধন করেন।

লায়লা আরো বলেন, তারা যখন মা বলে ডাকে তখন আমার খুব ভাল লাগে। খুশিতে আমি আত্মহারা হয়ে যাই। আমার মনে হয়, যে পরিশ্রম করেছি, আত্মত্যাগ করেছি, সেটা যেন সার্থক হয়েছে।

লায়লা হায়দারি বলেন, জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় আমি পার করেছি মানুষকে সাহায্য করতে যাতে তারা নরক থেকে সুস্থ সুন্দর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। আমার সন্তানরা গর্ব করে যে তাদের ছাড়াও আমি আরো এতো সন্তানের মা হয়ে উঠেছি।

আফগানিস্তান এখন আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় পার করছে। আমেরিকান সৈন্যরা ফিরে যাচ্ছে নিজেদের দেশে। কিন্তু লায়লা এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছেন না।

তিনি বলেন, ২০ বছর পর তারা আসলে দেশটাকে আবার তালেবানের হাতে তুলে দিচ্ছে। তারা বলছে যে এদেশে গণতন্ত্র কাজ করে না। এর ফলে তালেবান আবার ক্ষমতায় চলে আসবে এবং আমার মতো নারীদের কোন কাজ করতে দেবে না। আমি ভয় পাচ্ছি যে যা কিছু অর্জন করেছিলাম তার সবই আমি হারিয়ে ফেলবো।

আফগানিস্তানে পরিবর্তন চান জানিয়ে লায়লা হায়দারি বলেন, দ্রুত সমঝোতার জন্য গণতন্ত্র বাদ দেওয়া ঠিক হবে না। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং বিশেষ করে নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হারিসকে আমি বলবো তালেবানকে ফিরিয়ে আনবেন না। আমাদের তাদের হাতে তুলে দেবেন না। আমরা গণতন্ত্র ধরে রাখতে চাই।

লায়লা হায়দারি জানান, এখন পর্যন্ত পাঁচ হাজারেরও বেশি মাদকাসক্ত ব্যক্তির নিরাময় ও পুনর্বাসনে সাহায্য করেছে তার প্রতিষ্ঠিত মায়ের ক্যাম্প।