ঢাকা, সোমবার ২০, মে ২০২৪ ৬:৫৬:৩৪ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

শরণার্থীদের মা একজন অরুণা দেবীর সাতকাহণ

উৎপল কান্তি ধর

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৬:৫৩ এএম, ১৯ অক্টোবর ২০২১ মঙ্গলবার

অরুণা দেবী।

অরুণা দেবী।

পূর্ববঙ্গ থেকে ভিটেমাটি হারিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া হাজারো শরণার্থীকে মাতৃসম ভালোবাসা দিয়েছিলেন একজন মা। তার নাম অরুণা দেবী। তার সারা জীবন কেটেছে মানুষের সেবা করে। এ জীবন যেন গল্পের মত। কি সে গল্প...!

সময়টা ১৯১৬ সালের ৩১ আগস্ট। বিক্রমপুরে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। ফুটফুটে শিশুটি দেবীর মত সুন্দর। বাবা-মা শিশুটির নাম রাখেন অরুণা দেবী। অরুণা যখন বড় হয় পারিবারিক মধ্যস্থতায় বাবা-মা অরুণার বিয়ে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যদুলাল মুখোপাধ্যায়ের সাথে। 

দেশ ভাগের কিছুদিন আগে স্বামীর সাথে অরুণা দেবী ভারতের গুয়াহাটি চলে যান। যদুলাল চাকরি জীবনে কটন কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রধান ছিলেন।

১৯৪৭-এ দেশভাগের সময় উত্তাল চারদিক। তখন গুয়াহাটি স্টেশনে ছিন্নমূল মানুষের প্রচুর ভিড়। উদ্বাস্তুদের জন্য অরুণা দেবীর মন কেঁদে ওঠে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, যেভাবেই হোক অসহায় এ মানুষগুলোর পাশে দাড়াতে হবে। 

যেই ভাবা, সেই কাজ। স্বামীকে সাথে করে দুধ ভর্তি বালতি নিয়ে ছুটে গেলেন গুয়াহাটি স্টেশনে। মানুষগুলোর কষ্ট দেখে  তিনি বাড়িতে ফেরার পথে বেশ কয়েকটি উদ্বাস্তু পরিবার তার সঙ্গেই বাড়িতে নিয়ে আসেন। বাড়ির বাগানে অসহায় মানুষগুলোর মাথা গোঁজার ঠাঁই দিতে পারলেও দু'বেলা দু'মুঠো ভাত সকলের মুখে তুলে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না অরুণা দেবীর। 

সেই আক্ষেপে নিজেও ভাত ত্যাগ করেছিলেন। জীবনে আর কখনো ভাত খাননি। যতদিন বেঁচে ছিলেন শুধু চা এবং বিস্কুট খেয়েই সমাজসেবা চালিয়ে গেছেন এই উদারপ্রাণ নারী।

অদম্য প্রাণশক্তি নিয়ে অরুণা দেবী চালিয়ে গেছেন একটি প্রাথমিক স্কুল, একটি সেলাই শেখানোর স্কুল, আঁকার স্কুল আর গান শেখানোর স্কুল। 

১৯৬৮ সালে মারা যান তার স্বামী যদুলাল মুখোপাধ্যায়। চার ছেলে ও এক মেয়ের সকলেই প্রবাসী ছিলেন। তিন ছেলের মৃত্যু হয়েছে। এখন এক ছেলে ও মেয়ে কানাডা থাকেন। দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবেসে তিনি ভারত ত্যাগ করে কানাডা যাননি। 

অরুণা দেবী আজীবন বলে গেছেন, বাঁচতে হলে এ দেশে বাঁচবো, মরলেও এদেশে। এ দেশ এ দেশের মানুষ ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না।  

গরীব মানুষ খেতে পায় না বলে অন্ন ত্যাগ করা মানবিক কন্যা অরুণা দেবী গরীবদের গরম পোশাক জোটে না বলে শীতেও গরম পোশাক পরেননি।

২০১৬ সালে আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাতকারে তিনি জানান, ‘যত দিন বাঁচব কাজ চালিয়ে যাব মানুষের জন্য। এখনও শুক্লেশ্বরে গেলে ভিখারিদের কষ্ট দেখে কান্না পায়। 
কোন মুখে ফের ভাত খাওয়ার কথা ভাবব? সেই বোধ থেকেই ভূপেন হাজরিকা গেয়েছিলেন ‘মানুহ মানুহর বাবে যদি অকণও নে ভাবে’। আমরা আজকাল তার গান গাই বটে, কিন্তু সেই আদর্শ পালন করি না।’ 

পল্টনবাজারের নিজ বাড়ি আর পাড়ায় চলা স্কুলগুলি ছেড়ে কোথাও নড়তে নারাজ ছিলেন বিক্রমপুরের এই মহীয়সী কন্যা অরুণা দেবী। 

২০১১ সালে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে অরুণা দেবীকে সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ। তার জীবন নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করছেন ববিতা শর্মা। মানুষের জন্য তার এত বড় ত্যাগ সত্যিই  বিস্ময় জাগায় মনে। অনেকেই মনে করেন অরুণা দেবী নোবেল পাওয়ার যোগ্য। 

অরুণা দেবী ২০১৮ সালের ২৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় মারা যান।বিক্রমপুর কন্যা অরুণা দেবীর জন্য অনেক অনেক শ্রদ্ধা রইলো।